প্রাচীন ভারতবর্ষে অরণ্য ছিল সম্পদ। বন্য পশু এবং বনবাসী মানুষ, দুইয়েরই কদর ছিল। কবি বাল্মীকি শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে গুহক চণ্ডালের বন্ধুত্বের কথা লিখেছেন। মহাভারতেও আমরা ধীবররাজের কথা জানতে পারি। যার মেয়ে সত্যবতীর সঙ্গে মহারাজ শান্তনুর বিবাহ হয়েছিল। তা ছাড়া, ঋষিদের কথাই বা কীভাবে ভোলা সম্ভব। প্রাচীন ভারতের ঋষিরা তপস্যার জন্য অরণ্যের শান্ত সৌম পরিবেশকে বেছে নিতেন।
অবস্থার পরিবর্তন ঘটল দীর্ঘ ইসলামি শাসনে। তারপর ব্রিটিশ আমলে। মুসলমানের তরবারির ভয়ে এবং মেকলে-প্রবর্তিত শিক্ষানীতির কুপ্রভাবে সনাতন পেশাভিত্তিক বর্ণাশ্রম প্রথা বদলে গেল জাতপাতের ভেদাভেদে। মূলস্রোতের সমাজজীবনে বনবাসী-গিরিবাসী মানুষ হয়ে গেলেন ব্রাত্য। তাদের জন্য সরকারের কোনও উন্নয়ন কর্মসূচি নেই, শিক্ষা নেই। স্বাস্থ্য পরিষেবায় তারা কয়েকশো বছর পিছিয়ে। আছে শুধু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সরকার, রাজনীতির কারবারি আর ধ্বংসকামী নগর সভ্যতার কুশীলবদের হাতে নিপীড়িত হবার ইতিহাস।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৫২ সালে পূর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রমের জন্ম। সেই সময় ভারতে জনজাতি মানুষের সংখ্যা ছিল আট কোটি। মোট জনজাতির সংখ্যা ছিল ৪২৫টি এবং তারা ১৫০টি উপভাষায় কথা বলতেন। নিঃসন্দেহে এই সংখ্যা পরে আরও বেড়েছে। বনবাসী-গিরিবাসী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ছত্তিশগড়ের যশপুর নগরে বনযোগী বালাসাহেব দেশপাণ্ডে প্রতিষ্ঠা করলেন বনবাসী কল্যাণ আশ্রম। ধীরে ধীরে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল কল্যাণ আশ্রমের দরদি স্পর্শ। এই মুহূর্তে তপশিলি জাতি, জনজাতি মানুষের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অবদানের বিচারে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম ভারতের বৃহত্তম সংগঠন। ব্রাত্যজনের সনাতন সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণে কল্যাণ আশ্রমের ভূমিকা এক কথায় অনবদ্য। প্রায় এগারোশো পূর্ণসময়ের কর্মী কল্যাণ আশ্রমে কাজ করেন। তাদের সাহায্য করেন হাজার-হাজার আংশিক সময়ের কর্মী।
সংগঠন তৈরি হওয়ার সময়েই তার কর্মক্ষেত্র নির্দিষ্ট হয়ে যায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে সংগঠনের দর্শন। ভারতের লক্ষ লক্ষ বনবাসী-গিরিবাসী মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম। উদ্দেশ্য, পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে বোঝানো যে তারাও মূলস্রোতের সমাজজীবনের অঙ্গ। যুগ যুগ ধরে এক সমৃদ্ধ কৃষ্টির ধারক ও বাহক হওয়া সত্ত্বেও আজকের বনবাসী যুবক-যুবতীরা সেই পরম্পরা দূরে সরে গেছেন। তাদের আবার ফিরিয়ে আনতে চায় কল্যাণ আশ্রম। শিকড়ে ফিরাতে পারলে তবেই তাঁরা নিজেদের আত্মপরিচয় আত্মগৌরব এবং আত্মসম্মান রক্ষা করতে পারবেন। কল্যাণ আশ্রম চায়, বিদেশি অর্থ এবং ভাবধারায় পুষ্ট যে মাওবাদী আন্দোলন বনবাসী সমাজে দেশদ্রোহিতার বীজ বপনে সচেষ্ট তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সরল মানুষগুলোকে সচেতন করে তুলতে। সেইসঙ্গে দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটানোও কল্যাণ আশ্রমের উদ্দেশ্য। বনবাসী সমাজ যাতে নিজেদের উন্নতির জন্য কাজ করে তার জন্য আশ্রমের কর্মীরা সদাই সক্রিয়। কল্যাণ আশ্রম বনবাসী সমাজে একতা, সৌভ্রাতৃত্ব এবং সাম্যের বাতাবরণ তৈরি করতে চায়। নগরবাসী এবং বনবাসীর মধ্যে কোনও বৈষম্য তাদের কাম্য নয়।
সভ্যতার মধ্যে ভারসাম্য আনার কাজ করছে কল্যাণ আশ্রম। তাদের কাজের পরিসংখ্যান দিলে অতি বড়ো করপোরেট ফার্মেরও চোখ কপালে উঠে যাবে। সারা দেশে আশ্রমের তত্ত্বাবধানে ছেলেদের ছাত্রাবাস রয়েছে ১৯১ টি। মেয়েদের ৪৮টি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৯১ টি। শিশুশিক্ষা কেন্দ্র ৪,৪৪৯টি। শিক্ষাপ্রকল্পে উপকৃত মানুষের সংখ্যা ১,৪১,৫৯৩ জন। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পরিসংখ্যান আরও উজ্জ্বল। আশ্রমের তত্ত্বাবধানে হাসপাতাল রয়েছে ২০৩টি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা আরোগ্য রক্ষক চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে ৩,৯৫৭টি। প্রতি বছর ৫৭৯ টি চিকিৎসা শিবির করা হয়। বাচ্চাদের খেলাধুলার কেন্দ্র ২,৪৬১টি। চিকিৎসা প্রকল্পে উপকৃত ৬, ০০,৫১৫ জন। কল্যাণ আশ্রমের কাজের আর একটি দিক মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলা। আশ্রমের নিজস্ব কৃষি প্রশিক্ষণ সংস্থা রয়েছে ৫১টি। কুটীর উদ্যোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ৯৮টি। স্বয়ং সহায়তা কেন্দ্র ২,৮৮৫টি। গ্রাম বিকাশ প্রকল্প ৭৯টি। আর্থিক বিকাশ প্রকল্পে উপকৃত ৪৬,৬৯৯ জন। এর পাশাপাশি রয়েছে ৫,৭৭২টি শ্রদ্ধাজাগরণ কেন্দ্র, ৬৭০টি লোককলামণ্ডল এবং ৫২,০৩৮টি বনবাসী গ্রাম। | বনবাসী মানুষ জানেন তাদের পাশে কল্যাণ আশ্রম আছে। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা দলিতদের নিয়ে রাজনীতি করেছে। কল্যাণ আশ্রম ‘দলিত’ শব্দটাতেই বিশ্বাস করে না। তাদের কাছে সবাই মানুষ। যার ফলে বনবাসী যুবতী কলকাতার কলেজে পড়তে যায়। আবার বাড়ি ফিরে করোঞ্জের তেল মেখে স্নান করে খোঁপা বাঁধে। আর বনবাসী যুবক ইঞ্জিনিয়ার হয়েও ধামসা মাদল ছাড়ে না।