নদিয়ায় কিশোরীর ধর্ষণ ও পরে রক্তক্ষরণে মৃত্যুর মামলায় সোমবার এই ধারা দিয়েই ধৃত সোহেল ওরফে ব্রজ গয়ালিকে রানাঘাট আদালতে হাজির করেছে পুলিশ।
এ দিন জেলার পুলিশ সুপার সায়ক দাস বলেন, “বার্থ-ডে পার্টিতে কতজন ছিলেন, তা জেরা করে জানা হবে। এখনও পর্যন্ত ব্রজকে নিয়ে তিন-চার জনের কথা জানা যাচ্ছে। তারা কারা, তাদের ভূমিকা কী ছিল বা আদৌ ছিল কি না, তা দেখা হচ্ছে।”
সোমবার ব্রজকে রানাঘাট আদালতে হাজির করা হলে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সুতপা সাহা তাকে ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। মৃতার মা, দুই জেঠা, এক গ্রামীণ চিকিৎসক ও গ্রামের শ্মশানে ঘর বেঁধে থাকা এক প্রৌঢ়ার গোপন জবানবন্দি নেন দ্বিতীয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। তবে সোহেল গ্রেফতার হলেও এখনও বেশ কিছু ধন্দ রয়েই গিয়েছে। তার অন্যতম কারণ, সে দিনের ঘটনায় যুক্ত নানা জনের বয়ানে অসঙ্গতি এবং গ্রামের মানুষের কার্যত চুপ মেরে যাওয়া।
যাঁর ‘প্রতাপে’ মৃতার পরিবার টুঁ শব্দটি না-করে তড়িঘড়ি মৃতদেহ দাহ করে দিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠছে, তিনি ধর্ষণের অভিযোগে ধৃত সোহেল ওরফে ব্রজ গয়ালির বাবা সমরেন্দু গয়ালি। স্থানীয় পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য সমরেন্দুর নামে পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি মৃতার পরিবার। তবে রবিবার সকালে সোহেল গ্রেফতর হওয়ার পর থেকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী বাড়িতে নেই।
মৃতার বাড়ি নদিয়ার যে থানা এলাকায়, সেখানে এ দিন বিজেপির ডাকে ১২ ঘণ্টার বন্ধ পালিত হয়। দুপুরে বিজেপি মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী তনুজা চক্রবর্তী ও মুখপাত্র অর্চনা মজুমদারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল দুপুরে গ্রামে গিয়ে মৃতার প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে। পরে থানায় গিয়ে তাঁরা দাবি করেন, যারা তড়িঘড়ি মৃতদেহ পুড়িয়ে দিয়ে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছিল, তাদেরও গ্রেফতার করতে হবে। বিকালে গ্রামে মিছিল ও পথসভা করে সিপিএম।
পুলিশ সূত্রের খবর, তারা নানা জনের বয়ান থেকে গোটা ঘটনা উদ্ধার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে নানা বয়ানের অসঙ্গতি।
মৃতার মায়ের বয়ান অনুযায়ী, গত সোমবার সন্ধ্যায় এক জন মাঝবয়সি মহিলা তাঁর অসুস্থ মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এসে হুমকি দেয়, পুলিশ-পড়শি কাউকে জানালে তাঁদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে মারা হবে। সেই সময়ে দুই যুবক মোটরবাইক নিয়ে বাড়ির বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।
সোমবার সকালে খোঁজ করতে করতে পুলিশ মৃতার বাড়ি থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে সেই মহিলার সন্ধান পায়। মোটরবাইক আরোহী দুই যুবকেরও খোঁজ মেলে। পরে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে পলি বিশ্বাস নামে বছর তিরিশের ওই মহিলা দবি করেন, “মেয়েটির মা মিথ্যা কথা বলছেন। আমি কেন হুমকি দিতে যাব? আমার কী স্বার্থ? আমি বরং মেয়েটিকে ভাল ডাক্তার দেখাতে বলে আসি।”
পলি জানান, তাঁর দিল্লিতে বিয়ে হয়েছে। তিন বছর পর দিন কয়েক আগে বাপের বাড়িতে এসেছেন। তাঁর জবানিতে, “ওই সন্ধ্যায় ভাইপোকে সাইকেলের কেরিয়ারে বসিয়ে পাশের পাড়ায় মামার বাড়ি যাচ্ছিলাম। পাড়ার এক ভাই রাস্তায় বসে থাকা মেয়েটিকে দেখিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলে। মেয়েটি বলে, এক দাদার বার্থ-ডে পার্টিতে গিয়েছিল। ওর খুব শরীর খারাপ, প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে। বাড়ি পৌঁছে দিতে অনুরোধ করে।”
পলির দাবি, মেয়েটিকে তাঁরই সাইকেলের কেরিয়ারে চাপিয়ে তিনি বাড়ি পৌঁছে দেন। আর পাড়ার সেই ভাই আর তাঁর এক বন্ধু মোটরবাইক নিয়ে তাঁদের পিছন পিছন আসেন। পলির কথায়, “মোটরবাইকের আলোয় রাস্তা দেখে সাইকেল চালিয়ে মেয়েটির বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছই।” একই কথা জানিয়েছেন, পলির ভাইপোও।
যে দুই যুবক মোটরবাইকে পলির সঙ্গে গিয়েছিলেন বলে দাবি, তাঁদের এক জন আনিস মণ্ডলের বয়ান: “সে দিন সন্ধ্যায় আমি সদ্য মাঠ থেকে ফিরে বাড়ি ফিরেছিলাম। সঙ্গে আমার বন্ধু অনিমেষ মজুমদারও ছিল। বাড়ি থেকে মোটরবাইক বার করতে গিয়ে দেখি, রাস্তার মাঝে একটা সাইকেল দাঁড় করিয়ে রাখা। আর একটা মেয়ে রাস্তার পাশে মাটিতে বসে আছে। আমি মেয়েটিকে সাইকেলটা সরিয়ে নিতে বলি। সে উঠে সাইকেল নিয়ে দু’পা এগিয়ে আবার রাস্তার উপরেই বসে পড়ে।” তিনি জানান, তখনই তিনি পলিকে আসতে দেখে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করেন। বাকি বয়ান পলির সঙ্গে এক। রবিবার মৃতার মা জানিয়েছিলেন, বাড়ি ফেরার পরে মেয়ের মুখে তিনি মদের গন্ধ পেয়েছিলেন। কিন্তু পলি জানান, মেয়েটি পিছনে কেরিয়ারে ছিল, তিনি মদের গন্ধ পাননি। পুলিশ সূত্রের দাবি, পলি ও কিশোরীর মাকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হতে পারে। সায়ক দাস বলেন, “যাঁরা বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন, আগামিকাল (মঙ্গলবার) তাঁদের আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দি দেওয়ার জন্য।”
মেয়েটির মা জানিয়েছেন, রাতে মেয়ের পেটে খুব যন্ত্রণা হতে থাকলে তিনি কাছেই এক গ্রামীণ চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ এনেছিলেন। কিন্তু ফিরে দেখেন, মেয়ে মারা গিয়েছে। অর্থাৎ, ওষুধ খাওয়ানোর সুযোগ তিনি পাননি। কিন্তু মেয়েটিকে গর্ভপাতের ওষুধ খাওয়ানো হয়ে থাকতে পারে তদন্তকারীদের একাংশের সন্দেহ। এ দিন সমীর বিশ্বাস নামে ওই গ্রামীণ চিকিৎসকের গোপন জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।
আর একটি যে বয়ানের কথা জানা যাচ্ছে, তা ধৃত সোহেলের। পুলিশের দাবি, জেরায় সে জানিয়েছে যে ওই কিশোরীর সঙ্গে মাস ছয়েক আগে তার ‘সম্পর্ক’ তৈরি হয়। গত ৪ এপ্রিল তার জন্মদিন ছিল। বাবা-মা বাড়িতে ছিলেন না। সেই সুযোগে সে তার দুই বন্ধু আর ওই কিশোরীকে নিয়ে ‘পার্টি’ করে। তারা সবাই মিলে মদ খায়। এর পর বন্ধুরা চলে গেলে ফাঁকা বাড়িতে সে কিশোরীর সঙ্গে তার সম্মতিতেই সহবাস করে। যদিও ‘সম্মতি’ সত্ত্বেও নাবালিকার সঙ্গে সহবাস আইনের চোখে ধর্ষণই। সোহেলের বয়ান অনুযায়ী, এর পর মেয়েটি বাড়ি চলে যায়। সে যে এ রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তা সোহেল জানত না।
কিন্তু এই বয়ান যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, পুলিশ গণধর্ষণের ধারা কেন দিল? রানাঘাট পুলিশ জেলার সুপার সায়ক দাস বলেন, “অভিযোগের ভিত্তিতেই গণধর্ষণের মামলা রুজু করা হয়েছে। সংখ্যা বলা নেই অভিযোগে, ব্রজ ও কয়েক জন বলা হয়েছে।”