সাপ দেখলেই মারতে উদ্যত হবেননা তা সে বিষাক্ত হোক বা বিষহীন, তাড়িয়ে দিন

বর্ষা মানেই সাপের উৎপাত… এই কথা টা হামেশাই শোনা যায়। হ্যাঁ, ঠিকই এই সময় সরীসৃপ, উভচর, কীট-পতঙ্গদের জন্যে যেনো উপযুক্ত সময়। কারণ এই প্রজাতির প্রাণীরা বছরের এই বর্ষার সময় সর্বাধিক সক্রিয় থাকে। কারণ শীতের সময় এরা শীতঘুমে যায় পুরো শীতকাল। তাই এই সময় ওঁরা খাদ্য সংগ্ৰহ, মিলন ও বংশবিস্তারে কাটিয়ে দেয়। আর তাই এদের আনাগোনা সহজেই চোখে পড়ে।
সাপ…. এই কথা শুনলেই প্রায় অধিকাংশ মানুষই আঁতকে ওঠেন। কিনতু আপনি কি জানেন এই প্রাণীটা না থাকলে এ পৃথিবীতে উভচর ও কীটপতঙ্গদের উৎপাত এতো বেশি হতো যে আপনি টিকতে পারতেন না। এরা বায়োলজিক্যাল ব্যালেন্স রক্ষা করতে দারুন ভাবে উপকারী এক প্রাণী। কিনতু অযথা আতঙ্কের বশে ও সঠিক ধারণা না থাকায় সকলেই সাপ মাত্রই আতঙ্কে তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করে।
আসুন জেনে নিই…. সাধারণত কি ধরণের সাপ সচরাচর আমাদের সামনে এসে পড়ে। রং ও গঠনের সৌসাদৃশ্য থাকায় আমরা অনেক বিষহীন সাপকেও সন্দেহর বশে মেরে ফেলি। এই ভাবে মারতে মারতে আজকাল প্রকৃতিতে সাপের অস্তিত্ব সংকটে। কিছু কিছু সাপ তো আজকাল আর চোখেই পড়েনা, জানিনা তাঁরা আদৌ আছে… নাকি লুপ্ত হয়েছে।
সাপেদের দুভাগে ভাগ করা হয় — বিষহীন আর বিষাক্ত।

বিষহীন সাপের সংখ্যাই এই পৃথিবীতে বেশি, মানে অধিকাংশ সাপের কামড়েই মানুষের মৃত্যু হয়না। সে সব শুধুই ছোটো ছোট প্রাণীর হত্যা ও শিকার করতে সাপেদের কাজে আসে। কিনতু বিষাক্ত সাপের কামড়ে সঠিক সময়ের মধ্যে চিকিৎসা করালে ও আন্টি ভেনম প্রয়োগে মানুষ বেঁচে যায়। তাই অযথা আতঙ্কিত হবেন না। আর সাপ কামড়ালে উত্তেজিত হয়ে উঠবেন না বা দৌড়াদৌড়ি করবেননা। পেসেন্ট কে এসময় শান্ত ও সজাগ থাকতে হবে। সাপে কাটা স্থানের উপরে কিছুটা অন্তর অন্তর বাঁধন দিতে হবে। ক্ষত স্থানে ব্লেড বা ধারালো কিছু দিয়ে কেটে অযথা রক্তপাত ঘটাবেননা। অনেকেই এইরূপ মতে বিশ্বাসী কিনতু এ মত সম্পূর্ণ ভুয়ো ও লোকপ্রচলিত মাত্র।
গ্রামঅঞ্চলে আজও অনেকেই সাপে কামড়ালে মনসা মন্দির বা এজাতীয় কোন ঝাড়ফুক তুক তাকে বিশ্বাস করেন। কিনতু এসবে কোন কাজ হয়না। তাই সাপে কাটা ব্যক্তিকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করান।

এবারে চলে আসি- সাপেদের কথায়, প্রথমে বলি বিষহীন সাপেদের কথা, এর মধ্যে হেলে, জল ঢোড়া, দাঁড়াশ, বালি বোরা, ঘর গিন্নি, এসবই বেশিরভাগ চোখে পড়ে। এদের বিষ স্বল্প থাকলেও তা মানুষের হত্যাকারী নয়।
কিনতু যে সব বিষাক্ত সাপ আমাদের দেশে চোখে পড়ে তার মধ্যে — কেউটে, গোখুরো, চন্দ্রবোরা, কালাচ, রাজ সাপ বা ব্যান্ডেড ক্রেট এগুলো উল্লেখযোগ্য। এদের কামড়ে সঠিক চিকিৎসা না হলে মানুষের কয়েক ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু অবধারিত। বিষাক্ত ও বিষহীন সাপেদের চেনার সুবিধের জন্যে লেখনীটির সাথে বিষহীন ও বিষাক্ত উভয় সাপেদেরই ছবি নাম সহ নিচে দেওয়া হলো।

চন্দ্রবোরা কামড়ালে – ক্ষত স্থানে অসম্ভব জ্বলুনি, কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্ষত স্থান ফুলে ইনফেকশন, অনবরত রক্তপাত, যৌনাঙ্গ – নাক-মুখ-কান-পায়ু দিয়ে রক্তপাত, প্রেসার নেমে যাওয়া, এবং অবশেষে প্রেসার কমতে কমতে রুগীর হার্ট এটাক ও মৃত্যু।

কেউটে ও গোখুরো কামড়ালে – ক্ষত স্থানে অসম্ভব জ্বলুনি… ধীরে ধীরে তা সমগ্র শরীরে অনুভব করা, মাথা যন্ত্রনা, চোখে ঝাঁপসা দেখা, স্বাদ চলে যাওয়া, চোয়ালের পেশী দুর্বলতা অনুভূতি, অবশেষে… রোগী এলিয়ে পড়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে ও সব শেষে হার্ট ও স্নায়ু কাজ করা বন্ধ হয়ে মৃত্যু।

কালাচ কামড়ালে — কালাচের বিষদাঁত খুব ছোটো হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারেনা… অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে ভাবে মশা বা কোন পোকা কামড়েছে… তাই এড়িয়ে যায় ও অবশেষে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। কালাচ সাধারণত স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে…আনাচে কানাচে, আসবাব এর ফাঁকে ফোঁকরে থাকে এবং রাত্রি হলে বাইরে বেরোয়। তাই অধিকাংশ মানুষ এদের সেরকম একটা দেখতেই পায় না। অধিকাংশ মানুষই ঘুমের ঘোরেই বিছানায় কামড় খায়। মানুষের ঘামের গন্ধে এ সাপ প্রায়ই বিছানায় চলে আসে। আর ঘুমে অচৈতন্য মানুষ এর কবলে পড়ে। এ সাপের কামড়ে প্রথম আধ ঘন্টায় কিছু অনুভূত না হলেও কিছুক্ষনের মধ্যেই তলপেটে খিঁচুনি, যন্ত্রনা, বমি বমি ভাব, চোখ ঝাপসা হওয়া, পায়খানা হওয়া, এসব লক্ষণ দেখা যায়। অবশেষে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে চেতনা হারায় ও স্নায়ু কাজ করা বন্ধ করে দেওয়ায় দেহের ইন্টারনাল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয় ও মৃত্যু নেবে আসে। কালাচের এই ভয়ঙ্কর বিষ অথচ বুঝতে না পারার জন্যে কালাচের কামড়ে মৃত্যু সংখ্যা সর্বাধিক। কালাচের কামড়ে প্রায় ৮০% মানুষই মৃত্যু বরণ করে। তাই কালাচ কে সাইলেন্ট কিলার বলা হয়।
কিনতু দেখতে কিছুটা সৌসাদৃশ্য থাকায় ইদানিং কালাচের আতঙ্কে মানুষ বিষহীন নিরীহ ঘরগিন্নি বা কমন উলফ স্নেক কেও নির্মম ভাবে মেরে ফেলছে। আবার অনেকে ঘরগিনি ভেবে কালাচের কামড় কে উপেক্ষা করে মৃত্যু বরণ করছে। চেনার সুবিধাতে ছবি সহ এই post টি লিখলাম। আশাকরি সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে।

অন্তিমে সকলের কাছে আবেদন — সাপ দেখলেই মারতে উদ্যত হবেননা তা সে বিষাক্ত হোক বা বিষহীন, তাড়িয়ে দিন। প্রকৃতিতে ওঁদের অবদান অনেক। ওঁদের বাঁচতে দিন, আসলে জল জঙ্গল এসব আমরা গ্রাস করে ফেলছি বাড়ি ঘর কমপ্লেক্স বানিয়ে তাই ওঁদের জায়গা ক্রমশ কমছে, তাই ওঁদের সাথে আমাদের সামনাসামনি হচ্ছে। তাই ওদেরও বাঁচতে দিন।

✍️: Sourav Goswami

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.