১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। পরে অবশ্য বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতায় সেটা হয়ে ওঠেনি। তখন শিক্ষিত বাঙালিরা অনেকেই শপথ নিয়েছিলেন যে তাঁরা বিদেশী জিনিস ব্যবহার করবেন না | সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি লিখে ফেললেন একটি দেশাত্মবোধক গান |
“আমরা দেশি পাগলের দল,
দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল,
(যদিও) দেখতে খারাপ টিকবে কম, দামটা একটু বেশী
(তাহোক) তাতে দেশেরই মঙ্গল।”
কিছুদিন পরে আরও একটি লেখা –
“লর্ড কার্জন অতি দুর্জন বঙ্গগগন শনি
কূট নিঠুর চক্রী চতুর উগ্র গরল ফণী।”
এইদিকে সেই মানুষটিই কলেজে থাকতে গড়ে তোলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। ক্লাবের ‘মুখপত্র’ ছিল হাতে লেখা কাগজ – ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ | ননসেন্স ক্লাবের সভ্যদের নিয়ে অভিনয় করার জন্য দু’টি নাটক লিখেছিলেন তিনি, ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। ‘ঝালাপালা’তেই রয়েছে তাঁর সেই বিখ্যাত রসসৃষ্টি,
“পণ্ডিত। বটে! তোর বাড়ি কদ্দুর?
কেষ্টা। আজ্ঞে, ওই তালতলায় – ‘আই গো আপ, ইউ গো ডাউন-’ মানে কি?
পণ্ডিত। ‘আই’ – ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’ – গয়ে ওকার গো – গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ, ‘আপ’ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ জল – গরুর চক্ষে জল – অর্থাৎ কিনা গরু কাঁদিতেছে – কেন কাঁদিতেছে – না উই গো ডাউন, কিনা ‘উই’ যাকে বলে উইপোকা – ‘গো ডাউন’, অর্থাৎ গুদোমখানা – গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না – তাই না দেখে, ‘আই গো আপ’ – গরু কেবলই কাঁদিতেছে …”
শুধু লেখাতেই নয়, খেয়ালরসের জোগান দিয়েছেন তাঁর ছবিতেও। ‘আবোলতাবোল’ বইটির পাতায় পাতায় মজাদার জীবন্ত ছবির ছড়াছড়ি। এদের মধ্যে আছে হাঁসজারু, বকচ্ছপ, কাঠবুড়ো, কুমড়োপটাশ, বোম্বাগড়ের রাজা, রামগরুড়ের ছানা, ট্যাঁশ গরু,পালোয়ান ইত্যাদি। ‘হ য ব র ল’-র ছবিগুলো গল্পের সঙ্গে ভীষণ মানানসই। অমরত্ব পেয়েছে প্রতিটি ছবিই। এগুলির মধ্যে আছে বেড়াল, কাক, বুড়ো, ব্যাকরণ সিং, নেড়া, হিজি বিজ্ বিজ্, কালো ঝোল্লা-পরা হুতোমপ্যাঁচা, মাথায় শামলা-আঁটা শেয়াল, কুমির ইত্যাদি |
তাঁর লেখকজীবন মাত্র কয়েকটি বছরের। শেষের আড়াই বছর আবার শয্যাশায়ী ছিলেন দুরারোগ্য অসুখে। মাত্র ৩৬ বছরের জীবন | এইটুকু সময়ের ভিতরেই বাংলা সাহিত্যকে এমন এক ঝাঁকুনি দিলেন তিনি, যে ধাক্কা আজও সামলাতে বাঙালি হিমশিম | তাঁর মৃত্যুর পরে প্রায় একশো বছর হতে চলল, কিন্তু আজও আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় তিনি অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক | তাঁর বিচিত্র শব্দ-ব্যবহার, লেখার লাইন, চরিত্রের নাম কি অক্লেশে আমাদের কথাবার্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে | গোমড়ামুখো কারও পরিচয় দিতে গেলে ‘রামগরুড়ের ছানা’ বললেই যথেষ্ট। অদ্ভুত ধরনের জোড়াতালি দেওয়া ঘটনা দেখলে শুধু ‘বকচ্ছপ’ বা ‘হাঁসজারু’ বলেই থেমে যাওয়া যায় | ‘সাতদিনের ফাঁসি’ তো কবেই প্রবাদের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে | ‘সাত দুগুনে চোদ্দর নামে চার’ বললে অনেকেই বাকি অংশটা বলে দেবেন – ‘হাতে রইল পেনসিল।’
তিনি সুকুমার রায় | স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবন এবং বিপুল ও বৈচিত্রময় কর্মভাণ্ডার । সামান্য সময়ে প্রতিভার শতপুষ্প বিকশিত | তাঁর চলে যাবার পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের মন্দিরে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। ‘আচার্যের ভাষণে’ তিনি বলেছিলেন, “আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি, এই কথাই বার বার মনে হয়েছে, জীব-লোকের ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মলোক আছে। যে-কোন মানুষ এই কথাটি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসের দ্বারা নিজের জীবনে স্পষ্ট করে তোলেন, অমৃতধামের তীর্থযাত্রায় তিনি আমাদের নেতা। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সে গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।”
প্রয়াণদিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য |
© অহর্নিশ
ছেলেবেলার দিনগুলি, পুণ্যলতা চক্রবর্তী
সুকুমার, লীলা মজুমদার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি (১৯৮৯)
2023-09-19