'সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র' পড়তে গিয়ে দেখি শঙ্করীবাবু বলছেন যে -- "যে কোন কারণেই হোক, সাধু-সন্ন্যাসীরা খুবই সুভাষ-অনুরাগী। সারা ভারতেই।"
পঞ্চমুখে নেতাজীর গুণকীর্তন অবশ্য আমার দ্বারা সম্ভব নয়। গুণকীর্তনে আমি কৃপণ নই --- কিন্তু নেতাজীর মহিমা-কীর্তনে আমি দরিদ্র, বড়ই দরিদ্র। কতটুকু আর জানতে পেরেছি তাঁর বিষয়ে। তবে মাধুকরীতে যা পেয়েছি তাতেই আমার হৃদয় পরিপূর্ণ। রাজনীতিতে আমি উৎসাহহীন বরাবরই, তবুও আমি সুভাষ-অনুরাগী। তা কেমন করে? এখন এর উত্তর খোঁজা যাক।
নেতাজীর দিকে তাকালে দেখি, তিনি অভাবনীয় দুঃখ ও বিরাট শক্তির অধিকারী। তাঁর আশেপাশে দাঁড়ায় এমন কেউ নেই। তিনি একা --- বড়ই একা, এজন্য কি তাঁকে ভালবাসি? জানি না। ঠাকুর-স্বামীজীর পরম ভক্ত নেতাজী। শুধু ভক্ত নন্, স্বামীজীর শ্রেষ্ঠ ভাব-শিষ্য। এর জন্য কি আমি নেতাজী অনুরাগী? জানি না।
নেতাজী ঠাকুর ও স্বামীজীর গুণ-গান গেয়েছেন। তাঁর লেখা ও জীবনী পড়ে তাঁর উপর ও ঠাকুর-স্বামীজীর উপর অনেকেরই ভালবাসা বর্দ্ধিত হয়েছে বহুগুণে।... নেতাজীর কথায় ও কর্মে যে সরলতা, সেটা কতজনের মধ্যে আছে? আহা! ঠাকুর যদি স্থূল শরীরে তখন থাকতেন, সুভাষকে তাহলে লুফে নিতেন। এই জন্য কি নেতাজীর উপর আমার ভালবাসা? জানি না।
গুরুভ্রাতাকে গুরুসম মনে করে, যিনি নাকি রাজ্য চালাতে পারেন, সেই রাজা মহারাজের কথাতে বহু বাঞ্ছিত সন্ন্যাস-গ্রহণ স্থগিত রাখলেন সুভাষচন্দ্র। অতঃপর তিনি মহারাজের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। এজন্যই কি তাহলে নেতাজীর উপর অনুরাগ? জানি না।
সিঙ্গাপুরে, পকেটে তাঁর গীতা। আহ্বান করলেন সৈন্যদের --- তোমাদের আমি কিছু দিতে পারব না, জীবিত হয়ে তোমরা ভারতে পৌঁছাতে পারবে এমন আশ্বাসও দেব না, তবু যারা আমার সঙ্গে এগিয়ে আসবে -- এসো এগিয়ে। কি আশ্চর্য! সৈন্যদল এগিয়ে এল কদম কদম।
এ এক অলৌকিক বাস্তব ঘটনা।
কে এই ক্ষত্রীয়? এ কোন নিষ্কাম কর্মী? এত শক্তি পেল কোথায়? এক শরীরে এত শক্তি? এই বিপুল ভারতপ্রেম মানুষের চিন্তাগম্য কি?
প্রশ্ন জাগে, যুদ্ধে কি উনি জিতেছিলেন? যদিও উনি সুখে-দুঃখে, লাভে-লোকসানে, জয়ে-পরাজয়ে -- সমদর্শী।
তবে পকেটে যাঁর গীতা, অর্থাৎ নারায়ণ যাঁর সারথি -- তাঁর কি পরাজয় সম্ভব!
নেতাজী আপোসহীন, কিন্তু বড় ভালোবাসতেন সকল ভারতবাসীকে। আসুন, সকলেই -- তাবড় তাবড় রাজনীতিবিদরাও, যাঁদের রাজনীতি নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলা জন্মগত অধিকার --- আসুন, শুচি করি মন, সকলে মিলে নেতাজীকে করি প্রণাম।
['সমাজশিক্ষা' ৫০ বর্ষ স্মারকগ্রন্থ থেকে, অংশবিশেষ। পূজনীয় স্বামী গোপেশানন্দজী ছিলেন পরমপূজ্য স্বামী আত্মস্থানন্দজীর অনুজ। বরিষা রামকৃষ্ণ মঠের প্রথম অধ্যক্ষ। পরে বরানগর রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক।]
স্বামী গোপেশানন্দ