তারে আমি চোখে দেখিনি…
তার অনেক গল্প শুনেছি।
গল্প শুনে তারে আমি,
ভীষণ ভীষণ ভালোবেসেছি…।।
ইসলামিক পাকিস্তানের করালগ্রাস থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বাঙ্গালীর বাসভূমি এই পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা শ্রদ্ধেয় ভারতকেশরী, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকীতে রইল আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি…।।
আম জনতার স্মৃতি স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল, সামান্য কয়েক সপ্তাহের তফাতেই লোকে সব একদা-রোমহর্ষক ঘটনা ভুলে যায়। আর যদি কারও মৃত্যুর পর চৌষট্টি বছর অতীত হয়ে থাকে, এবং ইতিমধ্যে তাঁর স্মৃতি ভুলিয়ে দেবার প্রচেষ্টাও জারি থাকে, তবে তো কথাই নেই! তাই এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা শ্যামাপ্রসাদকে ভুলে গেছে, আজকের প্রজন্মকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, ‘‘আচ্ছা, ওই টাকমাথা ভদ্রলোক কে-যেন?’’
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কে ছিলেন, তাঁকে মনে রাখার কী প্রয়োজন? উত্তর—অনেক পরিচয় আছে। শিক্ষাব্রতী, রাজনীতিক, অসাধারণ বাগ্মী, সমাজসেবক এবং মানবদরদি। এবং নিতান্ত ব্যাবহারিক নিরিখে, আজকে যে দল অর্থাৎ বিজেপি, কেন্দ্রে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তার পূর্বসূরি ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা; কিন্তু এই সব অস্বীকার না করেও যাঁরা শ্যামাপ্রসাদের নাম শুনেছেন তাঁদের কেউ কেউ বলবেন, সবই বুঝলাম, কিন্তু উনি যে ‘চরম সাম্প্রদায়িক’ ছিলেন! আজকে আমাদের নীতিবোধের এমন বিকৃতি ঘটেছে যে সাড়ে তিন লক্ষ কাশ্মীরি পণ্ডিতকে শুধু হিন্দু হবার অপরাধে নিজের দেশে পথের ভিখারি হতে হয়েছে সেটা বলাও সাম্প্রদায়িকতা! যাক সে কথা।
স্যার আশুতোষের দ্বিতীয় পুত্র হিসাবে শ্যামাপ্রসাদ ধনী পরিবারে রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু পিতার শিক্ষাজগতে যে অবদান ছিল সেটাকে কত অনায়াসে এবং কত অল্প বয়সে আরও এগিয়ে নেওয়া যায় তার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। যে-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি ডিগ্রি দেবার সংস্থা হিসাবে পরিকল্পিত হয়েছিল তাকে সযত্নে লালন করে অধ্যয়ন ও গবেষণার সুউচ্চ শিখরে তুলে এনেছিলেন স্যার আশুতোষ। আজকে ভাবা কঠিন হতে পারে, কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতার মধ্যে অধ্যয়ন বা গবেষণা করে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন তিন-তিন জন—স্যার রোনাল্ড রস, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্করামন এবং অমর্ত্য সেন। রবীন্দ্রনাথেরও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল—প্রধানত শ্যামাপ্রসাদেরই চেষ্টায়। এই স্যার আশুতোষের পুত্র হয়ে শ্যামাপ্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কাজে অত্যন্ত অল্প বয়সে সম্পর্কিত হয়েছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৯২৪ সালে পিতার মৃত্যুর পরে যে-দক্ষতা সাবলীলতার সঙ্গে সিন্ডিকেটের সদস্য হিসাবে পরিচালন ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তা দেখে মুগ্ধ হয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘ইউনিভার্সিটির সাধারণ কাজে তুমি দেখি বাপ কা বেটা হইয়াছ! কেননা এত অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বার্থত্যাগ করিতে কেহই রাজি নয়।’’
১৯৩০ সালে বাংলা সরকার ডাঃ হাসান সোহরাওয়ার্দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত করে। ইনি ছিলেন পেশায় রেলের ডাক্তার এবং শিক্ষার জগতের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য, একে উপাচার্য করা হয়েছিল শুধু মুসলিমদের খুশি রাখার জন্য। কিন্তু তাঁর কার্যকালে তিনি শ্যামাপ্রসাদের কাছ থেকে যে অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছিলেন তার ফলে তাঁর পক্ষে কাজ করাটা সহজ হয়েছিল এবং সেকথা তিনি বারবার কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। এরই তুতো-ভাই হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দি (কলকাতার দাঙ্গার কুখ্যাত নেতা হুসেন শহীদের বড় ভাই) শ্যামাপ্রসাদের চেষ্টাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলার বাগীশ্বরী অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এইভাবে, এত অল্প বয়সে এমন অসাধারণ পারদর্শিতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৪ সালে বাংলা সরকার তাঁকেই উপাচার্য মনোনীত করেন। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে এই পদপ্রাপ্তি তাঁর আগে বা পরে আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি।
ইতিমধ্যে ১৯৩৩ সালে চারটি ছোট ছোট সন্তানকে রেখে তাঁর স্ত্রী সুধাদেবী অকালে গত হয়েছেন। ব্যক্তিগত শোক সামলে শ্যামাপ্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। ২৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে কুচকাওয়াজ ও শোভাযাত্রার প্রবর্তন তিনিই করেন, এবং এই উপলক্ষে তাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ‘চলো যাই, চলো যাই’ গানটি রচনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অন্যতম অবদান রবীন্দ্রনাথকে এর সঙ্গে যুক্ত করা—১৯৩২ সালে এক বছরের জন্য বাংলার রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক পদ অলংকৃত করেছিলেন বিশ্বকবি। এবং ১৯৩৭ সালে শ্যামাপ্রসাদেরই অনুরোধে অশক্ত শরীর সত্ত্বেও কলকাতায় এসে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসনও নিয়েছিলেন কবি—কিন্তু শর্ত ছিল, তিনি বাংলায় বক্তৃতা দেবেন। শ্যামাপ্রসাদ এই শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, বাংলার দুঁদে গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসনকে রাজি করিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে সমাবর্তনের মতো উৎসবে বাংলায় বক্তৃতা প্রায় অকল্পনীয় ছিল।
শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৩৯ সালে আটত্রিশ বছর বয়সে এবং শেষ ১৯৫৩ সালে কাশ্মীরে তার রহস্যময় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তাঁকে রাজনীতিতে যাঁরা টেনে এনেছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যারিস্টার নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টপাধ্যায়ের পিতা), আশুতোষ লাহিড়ী, স্যার মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায় এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘ প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দজি। তাঁকে আসতে হয়েছিল, কারণ ১৯৩৭ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুসলিম লিগ—কৃষক প্রজাপার্টির সরকার সেই সময় বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে অসম্ভব পক্ষপাতিত্ব আরম্ভ করেছিল—কার্যত কোনও হিন্দুর পক্ষে সে-সময় সরকারি চাকরি পাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এছাড়া গ্রামে-গঞ্জে, বিশেষত পূর্ববাংলায় হিন্দুদের ওপর ছড়িয়েছিটিয়ে অত্যাচারও হচ্ছিল। এরই প্রতিবাদে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে এক বিরাট হিন্দু সম্মেলন হয়, তার পরই শ্যামাপ্রসাদ সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। একে যদি কেউ সাম্প্রদায়িকতা বলতে চান বলতে পারেন—তাঁদের মতে হিন্দু সমাজের আত্মরক্ষারও অধিকার বোধহয় নেই।
তার পর থেকে শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবন যেন দৌড়তে আরম্ভ করল। এই সময় তাঁর বউদি তারা দেবী তাঁর নাবালক মাতৃহীন চারটি সন্তানকে যে-মমতা দিয়ে মানুষ করেছিলেন তার ফলেই তিনি মানুষের কাজে এমন আত্মনিয়োগ করতে পেরেছিলেন।
মুসলিম লিগ-কৃষক প্রজা পার্টির কোয়ালিশন সরকার ১৯৪১ সালে ভেঙে যায়। ইতিমধ্যে শ্যামাপ্রসাদ অখিল ভারত হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়েছেন। এবং যোগ দিয়ে প্রায় রাতারাতিই তার সর্বভারতীয় কার্যকারী সভাপতি নিযুক্ত হয়েছেন। ফজলুল হক মন্ত্রিসভা ভাঙার পরে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে আর এক কোয়ালিশন তৈরি করেন যার নাম ছিল প্রগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটিক কোয়ালিশন। এই সরকারে দ্বিতীয় ব্যক্তি হবার কথা ছিল শরৎচন্দ্র বসুর। এই সময় বাংলার গভর্নর ছিলেন অসম্ভব শয়তান ও কুচক্রী জন আর্থার হারবার্ট নামে একজন। তিনি নির্লজ্জভাবে মুসলিম লিগকে সমর্থন করতেন এবং হক সাহেবের মন্ত্রিসভা যাতে কাজ করতে না পারে সেজন্য ভারতরক্ষা আইনে শরৎ বসুকে গ্রেপ্তার করে সুদূর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কুনুর জেলে পাঠিয়ে দেন। তাঁর জায়গায় দ্বিতীয় ব্যক্তি এবং অর্থমন্ত্রী হন শ্যামাপ্রসাদ। এই মন্ত্রিসভায় তাঁর গুরুত্ব এত বেশি ছিল যে, মন্ত্রিসভার চালু নামই ছিল শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা।
উল্লেখ্য, শ্যামাপ্রসাদের মতো হিন্দুনেতাকে মন্ত্রিসভায় নেবার বিরুদ্ধে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে আওয়াজ উঠেছিল। তার উত্তরে হক সাহেব যা বলেছিলেন তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁরই ডান হাত, আবুল মনসুর আহমদ, ময়মনসিংহের প্রভাবশালী নেতা। ‘‘শুন আবুল মনসুর, তুমি শ্যামাপ্রসাদকে চিন না, আমি চিনি। হে স্যার আশুতোষের বেটা। করুক হে হিন্দু সভা। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে তার মত উদার ও মুসলমানের হিতকামী হিন্দু কংগ্রেসেও একজনও পাবা না। আমার কথা বিশ্বাস কর। আমি সবদিক ভাইবা-চিন্তাই তারে নিতাসি। আমারে যদি বিশ্বাস কর তারেও বিশ্বাস করতে হবে।’’ হক সাহেব আরও বলেছিলেন ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুসলিম বাংলার স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব নিয়াছেন। আর আমি নিয়াছি হিন্দু-বাংলার স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব।’’ আবুল মনসুর আরও লিখেছেন, ‘‘আমি তার সঙ্গে কয়েকদিন মিশিয়াই বুঝিয়া ছিলাম, তাঁর সম্বন্ধে হক সাহেব যা বলিয়াছেন তা ঠিক। সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে সত্যসত্যই তিনি অনেক কংগ্রেসি নেতার চেয়েও উদার। হিন্দুসভার নেতা হইয়াও কোন হিন্দুনেতার পক্ষে মুসলমানদের প্রতি এমন উদার মনোভাব পোষণ করা সম্ভব, আমার এই অভিজ্ঞতা হইল প্রথম ডঃ শ্যামাপ্রসাদকে দেখিয়া।’’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা)।
হারবার্টের চক্রান্ত ও হক সাহেবের দুর্বলচিত্ততার ফলে এই মন্ত্রিসভা বেশিদিন টেকেনি। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানকে একত্র করে সরকার চালানোর শেষ প্রচেষ্টা ছিল এই মন্ত্রিসভা। শ্যামাপ্রসাদের জীবনে এর পরের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ১৯৪৩ সালের পঞ্চাশের মন্বন্তর। কিন্তু তার আগে কবি নজরুলকে নিয়ে তাঁর যে পদক্ষেপ ছিল তার কথা বলতে হবে।
১৯৪২ সালে কাজী নজরুল প্রচণ্ড আর্থিক ও শারীরিক দুরবস্থায় পড়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী তখন পাঁচ বছর পঙ্গু হয়ে শয্যাগত, তার নিজের শরীরও খুব খারাপ, চিকিৎসার জন্য মাড়োয়ারি ও কাবলিওয়ালার কাছ থেকে সাত হাজার টাকা ধার করতে হয়েছে—যা সেই আমলে বিশাল একটা অঙ্ক। সেই সময় নজরুল হক সাহেবের কিছু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ফলে প্রচণ্ড অসুবিধায় পড়েছিলেন—পরবর্তীতে তাঁর উদ্ধৃত চিঠি থেকে এটা পরিষ্কার হবে। খবর পেয়ে শ্যামাপ্রসাদ শুধু তাঁকে অর্থ সাহায্যই করলেন না, নিজেদের মধুপুরের বাড়িতে তাঁকে পাঠিয়ে তাঁর ‘চেঞ্জ’-এর ব্যবস্থা করে দিলেন—সে আমলে দীর্ঘস্থায়ী অসুখ-বিসুখ হলে লোকে ‘চেঞ্জে’ যেতেন। এই বাবদে কাজী নজরুল ১৭ জুলাই ১৯৪২ তারিখে শ্যামাপ্রসাদকে যে মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছিলেন তার থেকে একটু উদ্ধৃতি—‘‘শ্রীচরণেষু আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন। মধুপুরে এসে অনেক relief ও relaxation অনুভব করছি… ‘নবযুগের’ সম্পাদনার ভার যখন নিই (নবযুগ ছিল হক সাহেবের দলের মুখপত্র) তার কিছুদিন আগে ফিল্মের music direction-এর জন্য সাত হাজার টাকার কনট্রাক্ট পাই। হক সাহেব ও তাঁর অনেক হিন্দু-মুসলমান supporter আমাকে বলেন যে তাঁরা ও ঋণ শোধ করে দেবেন। আমি film-এর contract cancel করে দিই। পরে যখন দুতিন মাস তাগাদ করে টাকা পেলাম না… তারপর সাতমাস কেটে গেল… হক সাহেব একদিন বললেন, ‘‘কিসের টাকা?’’ আমি চুপ করে চলে এলাম।… আমি জানি, আমরাই এই ভারতবর্ষকে পূর্ণ স্বাধীন করব—সেদিন বাঙালির আপনাকে ও সুভাষ বসুকেই সকলের আগে মনে পড়বে—আপনারাই হবেন এ দেশের সত্যকার নায়ক।
আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ গ্রহণ করবেন। আমি জানি, আমি Hindu-Musilm Equity Fund থেকে ঋণমুক্তির টাকা পাব। আপনার কথা কখনো মিথ্যা হবে না। পাঁচশ টাকা পেয়েছি। আরো পাঁচশ টাকা অনুগ্রহ করে যত শীঘ্র সম্ভব পাঠিয়ে দেবেন… আপনার মহত্ত্ব আপনার আমার উপর ভালবাসা, আপনার নির্ভীকতা, শৌর্য সাহস—আমার অণু পরমাণুতে অন্তরে বাহিরে মিশে রইল। আমার আনন্দিত প্রণাম-পদ্ম শ্রীচরণে গ্রহণ করুন। প্রণত—কাজী নজরুল ইলসাম’’।
শ্যামাপ্রসাদকে যাঁরা ‘সাম্প্রদায়িক’ বলেন তাঁরা এই চিঠিটি মন দিয়ে পড়লে ভালো করবেন—তবে হয়তো পড়ার পরেও তাঁদের মতামত পালটাবে না। তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু এই শ্যামাপ্রসাদই, যখন বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর সংখ্যাগুরু মুসলমানের অত্যাচার হত তখন অন্যান্য তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ক্লীবের মতো বসে থাকেননি—সিংহ গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তার কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, অন্যায় করা কারও একচেটিয়া অধিকার নয়—হিন্দু মুসলিমের ওপর অত্যাচার করলে যতটা সাম্প্রদায়িকতা হয়, মুসলিম হিন্দুর ওপর অত্যাচার করলেও ঠিক ততটাই সাম্প্রদায়িকতা হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একজোট ভোটের লোভে কোনও সম্প্রদায়কে তৈলমর্দন করা দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ (যার নাম পঞ্চাশের মন্বন্তর), ১৯৪৬ সালে বাংলায় প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি-কৃত কলকাতার দাঙ্গা, ওই একই বছরে নোয়াখালিতে (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু-গণহত্যা, তারপর ১৯৪৭-এ মন্ত্রীপদ গ্রহণ, মন্ত্রী থাকাকালীন ডিভিসি., সিন্ধ্রি সার কারখানা, চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা ইত্যাদির রূপায়ণ, তারপর ১৯৫০-এ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আর এক হিন্দু-গণহত্যা এবং সে বিষয়ে নেহরুর ক্লীবতার বিরুদ্ধে মন্ত্রীপদ ত্যাগ, তারপর ১৯৫১-তে ভারতীয় জনসঙ্ঘ (যা আজকের বিজেপিতে রূপান্তরিত) গঠন এবং শেষপর্যন্ত তাঁর কাশ্মীর অভিযান ও সেখানে শেখ আবদুল্লার কারাগারে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু—সব বিষয়ে লেখার পরিসর এই ছোট্ট নিবন্ধে নেই। তাঁর জীবনের অন্যতম মহান কীর্তি, পশ্চিমবঙ্গের সৃষ্টি—এই বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করেই এই নিবন্ধ শেষ করতে হবে।
অনেকে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪৭ সালের দেশ, অর্থাৎ বাংলা ভাগ করাকে এক দৃষ্টিতে দেখেন। আদৌ তা নয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ছিল ব্রিটিশের চক্রান্ত, ‘পূর্ব বাংলা এবং আসাম’ নামে একটি মুসলিমপ্রধান প্রদেশ সৃষ্টি করে মুসলিমদের খুশি করা (যদিও ব্যারিস্টার আবদুল রসুল, আবদুল হালিম গজনভী, আকাতুল্লা প্রমুখ অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন)। আর ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ ছিল শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে একটি ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল এক্সারসাইজ’, যার ফলে বাংলার হিন্দুরা নিজেদের বলতে একটি রাজ্য পায়, এবং মাথা উঁচু করে সেই রাজ্যে বেঁচে থাকতে পারে—সেই সঙ্গে পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ) থেকে হিন্দু হবার অপরাধে বিতাড়িত বাঙালি হিন্দু একটু আশ্রয় পেতে পারে। এটা যদি না হত তাহলে গোটা বাংলা, আসাম সমেত পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে যেত। এবং ১৯৫০, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং তৎপরবর্তী সময়ে এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী হিন্দুর ওপর যে-অত্যাচার হয়েছিল তা এই দুই প্রদেশের সমস্ত হিন্দুর ওপর নেমে আসত।
ঘটনা এইরকম, খুব সংক্ষেপে: যখন জিন্নার অনমনীয় ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেস মাথা নত করে মুসলিম-অমুসলিম ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নিল তখন জিন্না চাইলেন যে, মুসলিম সংখ্যাধিক্যযুক্ত প্রদেশ হিসাবে গোটা বাংলাই পাকিস্তান হয়ে যাবে। তখন বাংলার হিন্দু নেতারা এর প্রতিবাদ করলেন এবং সে-প্রতিবাদের ভাষা দিলেন, নেতৃত্ব দিলেন আর কেউ নন—শ্যামাপ্রসাদ।
এর আগে শ্যামাপ্রসাদ প্রাণপণে ভারত ভাগের বিরোধিতা করে এসেছেন, কিন্তু হিন্দুর সমর্থন পুষ্ট কংগ্রেস এবং মুসলিম সমর্থনপুষ্ট মুসলিম লিগের কাছে তাঁর ক্ষুদ্র হিন্দু মহাসভা দাঁড়াতেই পারেনি। কিন্তু যখন ভারত ভাগ নিশ্চিত হয়ে গেল তখন শ্যামাপ্রসাদই বললেন, ভারত ভাগ করলে বাংলাকেও ভাগ করতে হবে। এর প্রাণপণ বিরোধিতা করেছিলেন জিন্না এবং লিয়াকত আলী—কিন্তু এবার শ্যামাপ্রসাদের ইচ্ছাশক্তির কাছে জিন্নাকেই হার মানতে হল। শুধু বাংলা ভাগ নয়, শ্যামাপ্রসাদ এটাও নিশ্চিত করে ছাড়লেন যে, কোনও মুসলিমপ্রধান জেলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলিকেও ভারতেই দিতে হবে। তাই মুসলিমপ্রধান নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট মহকুমা, যশোহর জেলার বনগাঁ মহকুমা আজকে ভারতে। এই জন্যই শ্যামাপ্রসাদ সংসদে একবার নেহরুকে বলেছিলেন ‘‘আপনারা ভারত ভাগ করেছেন, আমি পাকিস্তান ভাগ করেছি’’।
জিন্না একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম প্রমুখ কিছু মুসলিম লিগ নেতা একটা ‘স্বাধীন সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলা’ তৈরির একটা পরিকল্পনা ভাসিয়ে দিলেন, এবং অতীব দুঃখের বিষয়, এ কাজে সঙ্গে পেয়ে গেলেন নেতাজি-অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুকে। এমনকী শরৎ বসু ভেবে দেখলেন না, মাত্র কয়েক মাস আগে, সোহরাওয়ার্দি কলকাতাকে রক্তস্নান করিয়েছেন। এতে শামিল হলেন বাংলার শেষ ইংরেজ গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক বারোজও। কিন্তু লাভ হল না। শ্যামাপ্রসাদেরই জয় হল। এবং তাই আজ বাঙালি হিন্দু মাথা উঁচু করে পশ্চিমবঙ্গে থাকতে পারছে।
তাই আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর শ্রীচরণে শতকোটি প্রণাম।
[২০১৭ সালের ৬ই জুলাই ‘বর্তমান পত্রিকা’য় প্রকাশিত এই লেখাটি লিখেছিলেন শ্রী তথাগত রায় ]
(প্রীতম চট্টোপাধ্যায় এর টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)