পৃথিবীর সব দেশেরই বিচারব্যবস্থার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সেজন্যই সব অপরাধের সংবাদ আদালত পর্যন্ত পৌঁছায় না। এমনকি সব অপরাধ আদালতে প্রমাণিত ও হয় না।তবে পারিপার্শিক অবস্থা থেকে জনমানসে অপরাধী সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়, সেটাও মিথ্যা নয়।
১৯৮২সনের ৩০ এপ্রিল শুক্রবার সূর্যোদয়ের মুহূর্তে বাঙালির সবচেয়ে গর্বের শহর কলকাতার বুকে আনন্দমার্গের ১৭ জন সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনীর যে নারকীয় হত্যালীলা সংগঠিত হয়েছিল তার অপরাধীরাও ধরা পড়েনি, বিচার ও হয় নি। (যেটুকু হয়েছে সেটা বিচারের নামে প্রহসন) তবুও সাধারণ মানুষ সেদিন এটা ঠিকই বুঝেছিলেন যে এই গণহত্যার নীলনক্সা (blue print) পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন কমিউনিস্ট সরকারই তৈরি করেছিল। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন পার্টি সেটা কীভাবে তৈরি করেছিল তার বিস্তৃত বিবরণ বিগত চার দশকে প্রকাশিত বহু প্রবন্ধ, পুস্তিকায় ধরা আছে।আমরা একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেই হত্যাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
কমিউনিজমের স্রষ্টা মহামতি কার্লমার্ক্স ১৮৪৮ সনে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে লিখেছেন——“The communists disdain to conceal their views and aims. They openly declare that their ends can be attained only by the forcible over throw of all existing social condition. Let the rulling classes tremble at a communist revolution.” সুতরাং কোনও আড়াল না রেখেই কমিউনিস্টদের ঈশ্বর ১৮৪৮ সনেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন তারা কী, কীভাবে ক্ষমতা দখল করবে আর কীভাবে শাসন করবে। সেই নির্লজ্জ ঘোষণার ছাপ তারা পৃথিবীর যেখানেই পা রেখেছে সেখানেই ছেড়ে এসেছে।
রাশিয়া, চিন, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি পৃথিবীর চৌত্রিশটি দেশে নানা অজুহাতে প্রায় বার কোটি মানুষ খুন হয়েছেন কমিউনিস্টদের হাতে। তারা যে এভাবে মানুষ খুন করবে তার তথ্য প্রমাণ নিজেরাই রেখে গেছে। মহান বিপ্লবী লেনিনের সিক্রেট পুলিশের (যাদের একমাত্র কাজই ছিল বিরোধীদের খুন করা) জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছিলেন—-‘আমরা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি না, আমরা বুর্জোয়াদের বিনাশ করতে চাই। (যদিও বুর্জোয়াদের পা চাটাই কমিউনিস্টদের বড় কাজ) আর তার জন্য আমাদের কোনও প্রমাণের প্রয়োজন নেই।’ অন্তত বারো কোটি মানুষকে খুনের দায়ে যারা অভিযুক্ত তাদের কাছে সতেরো জন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনী হত্যা অত্যন্ত সহজ ব্যাপার।
কিন্তু প্রশ্ন কেন এই হত্যালীলা? সন্ন্যাসীরা তথাকথিত বুর্জোয়া নয়। আর তাছাড়া ১৯৮২ সনে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের ক্ষমতার সূর্য জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে যখন মধ্য গগনে তখন আনন্দমার্গের মত একটি অখ্যাত প্রায় সংগঠনের প্রতি এত বিদ্বেষ কেন?
কমিউনিস্টদের একটি বড় গুণ এই যে শোষিত মানুষকে তারা কার্লমার্ক্সের কল্পনার স্বর্গরাজ্যে আরোহণ করাতে না পারলেও তাদেরকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে নিঃশেষ করার কাজটুকু নিষ্ঠা এবং দক্ষতার সঙ্গে করে এসেছে। তথাপি প্রশ্ন জাগে আধ্যাত্মিক এবং আর্থসামাজিক সংগঠন আনন্দমার্গের সর্বক্ষণের কর্মী সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীরা কেন তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠল? অবশ্য এটাই প্রথম নয় এই সংগঠনের উপর কমিউনিস্টদের বর্বর আক্রমণের শুরু সেই ১৯৬৭ সন থেকেই। সেদিনও পুরুলিয়ার আনন্দনগরের মত একটি উষর, ধূসর, চরম অবহেলিত পশ্চাদপদ গ্রামাঞ্চলে আনন্দমার্গ পরিচালিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী কল্যাণ এবং বহুবিধ জনকল্যাণের কর্মকেন্দ্রে প্রকাশ্য দিনের আলোয় পাঁচ জন সন্ন্যাসী এবং গৃহী কর্মীকে তারা খুন করেছিল। আইন মোতাবেক তাদের সাজাও হয়েছিল। যদি ধরে নেওয়া যায় যে মার্কসবাদীরা যেহেতু ধর্ম মানে না আর আনন্দমার্গ একটি ধর্মীয় এবং আর্থসামাজিক সংগঠন তাই এদের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ এই হত্যআ। কিন্তু এ যুক্তি ও ধোপে টেকে না, কারণ ধর্মীয়সংগঠন বাংলার বুকে আরও অনেক রয়েছে তাদের ব্যপ্তিও আনন্দমার্গের তুলনায় অনেক বেশি। সেখানে তো তারা নীরব। তবে কি আনন্দ মার্গ আদর্শ ও দর্শনের মধ্যে মার্কসবাদীরা এমন কিছু আবিষ্কার করেছিল যার মধ্যে তারা তাদের বিনাশের ছবি দেখতে পেয়েছিল?
মার্কসবাদীদের নিয়ে মুশকিল এই যে তারা পৃথিবীটাকে একবিংশ শতিকায় দাঁড়িয়েও অষ্টাদশ শতাব্দীর চশমা দিয়েই দেখতে চায়। বিগত দুই শতকে বিজ্ঞান, সমাজনীতি, অর্থনীতি রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি বহু বিষয়ে মানুষের চিন্তাভাবনার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে একথা তারা মানতে নারাজ। ঠিক তথাকথিত ধর্মীয় মৌলবাদীদের মত।
মার্কসবাদীদের সন্ন্যাসী হত্যার মূল কারণগুলি একটু দেখে নেওয়া যাক।
(এক) কার্লমার্ক্স ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কে কোনও গবেষণা ছাড়াই কিছু তথাকথিত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করেই বলেছিলেন—–‘ধর্ম জনগণকে নেশাগ্রস্ত করে রাখার আফিম।’ অন্যদিকে আনন্দমার্গ দর্শনের প্রণেতা ‘ধর্ম’ মনস্তাত্ত্বিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগও করেছেন। যাকে কোনও সুশিক্ষিত মানুষের পক্ষে অস্বীকার করা অসম্ভব।
(দুই) মার্কস সমাজের সমস্ত মানুষকে অত্যন্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে শোষক আর শোষিত এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন, যা মানুষের মনস্তত্ত্ব বিরোধী। আনন্দমূর্তিজী সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মানুষকে চার শ্রেণিতে ভাগ করেছেন, যা গীতোক্ত বর্ণ ব্যবস্থা থেকেও স্বতন্ত্র।
(তিন) কার্লমার্ক্স ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাবলীর জন্য অর্থনীতিকেই একমাত্র কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মানবমনীষার এরচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন আর কিছু হতে পারে না। প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, ইতিহাসের ঘটনাবলী মানুষের সামূহিক মনস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ।
(চার) মার্কসবাদ সম্পদের সমবণ্টনের একটি অযৌক্তিক তথা অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব্ব প্রচার করে এসেছে যার প্রয়োগের ভয়াবহ রূপের সঙ্গে পৃথিবী ইতোমধ্যেই সম্যক ভাবে পরিচিত হয়েছে।এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাউটের যুক্তিসঙ্গত বণ্টন ব্যবস্থা
( Rational distribution) র তত্ত্ব্ব অনেক বেশি বাস্তব, বিজ্ঞানসম্মত এবং গ্রহণযোগ্য।
(পাঁচ) মার্কসবাদের ছত্রছায়ায় বিশ্ব জোরে যেসব নেতার জন্ম হয়েছে তারা সর্বহারা বা শোষিত কোনোটাই নয় বরং বিকৃত মানসিকতার, সভ্যতা ধ্বংসকারী, কোটি কোটি মানুষের হত্যাকারী। প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা নেতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলেছেন—-‘ যাঁরা শারীরিকভাবে সুস্থ, মানসিক দিক থেকে উন্নত চিন্তার অধিকারী এবং আধ্যাত্মিকতার জ্যোতিতে ভাস্বর, ত্যাগ ও সেবার মনোভাবে মানবতার সেবায় উৎসর্গীত যাদের জীবন নেতৃত্ব শুধু তাঁদের হাতেই থাকা উচিত। প্রাউট প্রবক্তার পরিভাষায় যাঁদের নাম “সদবিপ্র”। এঁরা প্রজ্ঞায় বিপ্র, তীক্ষ্ম বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন বৈশ্য, কঠিন সংগ্রামী মানসিকতা সম্পন্ন ক্ষত্রিয় এবং দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে প্রদত্ত সেবায় শূদ্র গুণসম্পন্ন, সর্বোপরি কঠোর নীতিবাদী।
এইরকম আরও অনেক পরিকল্পনার লিখিত রূপ ছাড়া ১৯৮২ সনে আনন্দমার্গের হাতে বিশেষ কিছুই তো ছিল না। তথাপি এই সংস্থার প্রতি এতটা হিংস্র হয়ে উঠেছিল কেন? তবে কি ওরা আনন্দমূর্তিজী এবং আনন্দমার্গ দর্শনের মধ্যে কংসের দৈবকীর অনাগত অষ্টম সন্তানকে দেখতে পেয়েছিল? হয়তো বা তাই।
খগেনচন্দ্র দাস