শেষ পর্বে ‘পরিযায়ী‘ পশ্চিমবঙ্গকে কিভাবে ‘আত্মনির্ভর‘ পশ্চিমবঙ্গে পরিণত করা যায় তার সম্ভাব্য উপায় ও বিশ্লেষনে আসি l প্রথমে, আরেকবার কলকাতার ভূগোল ও ইতিহাসে নজর দেয়া যাক l কলকাতার ভৌগলিক অবস্থানে একটা যাদু আছে l কলকাতার অবস্থানের সঙ্গে তুলনীয় শুধুমাত্র বিশ্বের কিছু অত্যন্ত সফল মহানগর l তারা হল লস এঞ্জেলস, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, দুবাই, বোম্বে l ঠিক সেই কারণেই একসময় ব্রিটিশরা এই শহরকে ভারতবর্ষের রাজধানী বানিয়েছে l কিন্তু আগেই বলেছি, 1966 তে ইন্দিরা গান্ধী যখন দেশে পুরোপুরি সোভিয়েত মডেল চালু করলেন, তখন ব্রিটিশ ও মার্কিন শিল্পপতিরা কলকাতা ছেড়ে সিঙ্গাপুর, কিনিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইন্দোনেশিয়া চলে যায় l সেই সময়ে মালয়েশিয়া থেকে সদ্য বিচ্ছিন্ন হাওয়া সিঙ্গাপুরের কাছে এ ছিল এক সুবর্ণসুযোগ l আগামী কয়েক বছরে সিঙ্গাপুর একটা লজিস্টিকস ও ফিনান্সিয়াল হাবে পরিণত হয় l যাকে বলে পুরাদস্তুর এক বিসনেজ হাব l স্বাভাবিক ছন্দেই, এরপর একে একে আসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন শিল্পসহ বাকিরা l এবং অবশ্যই উচ্চ প্রযুক্তি l আর কলকাতা পরিণত হয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং পরিযায়ী শ্রমিক সরবরাহের হাবে l ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায় এখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ( MSME), কৃষি, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি একটা সুন্দর সমাজ l
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ভূখন্ড পশ্চিমবঙ্গকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রথম ধাপে চাই তিনটি হাব ( Hub ), যারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত l
এক, লজিস্টিকস হাব : এটা এমন একটা ব্যাবস্থা যেখানে একটি পরিকল্পনামাফিক গভীর সমুদ্র বন্দর ( যেমন সিঙ্গাপুরের জুরং বন্দর), একটি নিকটবর্তী তিন-রানওয়ে আধুনিক বিমানবন্দর, কিছু সংযোগকারী নদীবন্দর, জলপথ ( সমুদ্রবন্দর থেকে নদী বন্দরগুলি পর্যন্ত সুলভে পণ্য পরিবহন), পণ্য পরিবহন রেলপথ ( Dedicated Freight Corridor ) ও সড়কের (Express Highway) সমাহার থাকবে l থাকবে উচ্চপ্রযুক্তির কোল্ডস্টোরেজ ও প্যাকেজিং পরিকাঠামো l এই হাব নিয়ে আসবে জাহাজ, রেল লোকোমোটিভ, অটোমোবাইল এবং বিমান কারখানা l তাঁর সঙ্গে আসবে হাজার হাজার ম্যানুফ্যাকচারিং ও মেইনটেন্যান্স-মূলক MSME শিল্প l কলকাতার সেই সম্ভাবনা ছিল বলেই, স্বাধীনতার পরই ডঃ বিধান রায়ের নির্দেশে ভারত সরকার প্রথম IIT, প্রথম IIM, বেশ কটি শিল্প শহর ও ব্যারেজ, প্রথম মেট্রো রেল, প্রথম কেবল ব্রিজ অনুমোদন করেছিল, এই খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ রাজ্যকে l এই রাজ্যের উপর দেশের এতটাই আশা ছিল যে, ভারত সরকার দুবার ( ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারেজ ) আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে কলকাতা ও শিলিগুড়িকে অতিরিক্ত জলসম্পদ পাঠানোর ব্যাবস্থা করে l কিন্তু দেশের উপর বিশ্বাস হারিয়ে, আমরা ‘দাস ক্যাপিটালে’র উপর ভরসা করে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছি l এই প্রসঙ্গে কবির দাশরথি রায়ের লেখা ও পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া সেই বিখ্যাত ভক্তিগীতিটি মনে পরে যায়,
“আমার ধর্মাধর্ম হল কুদন্ড স্বরূপ
উলু ক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ
সে কূপে বেরিল কাল রূপ জল
কালো মনোরমা…..মা.. “
দুই, প্রযুক্তি হাব l উদাহরণসরূপ, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, পুনে বা গুরগাঁও l আমাদের আগের প্রজন্মের নেতিবাচক আধাবিপ্লবী চরিত্র কলকাতার প্রযুক্তি হাব হবার পথে মূল অন্তরায় ছিল l নইলে কম্পিউটারের অন্যতম পথপ্রদর্শক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট বরাহনগর থাকতে আমাদের 90% কম্পিউটার কর্মী আজ পরিযায়ী? দিঘার সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন আগামী দিনে প্রযুক্তি হাবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে l প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, 2007 এ জমি আন্দোলনে এই প্রকল্প হলদিয়া থেকে বিদায় নেয় l
তিন, ফিনান্সিয়াল হাব: এটি এমন একটি ব্যাবস্থা যেখানে এক ছাতার তলায় অর্থাৎ ক্যাম্পাসে, সবকটি দেশি-বিদেশী-সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, ননব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট, স্টক মার্কেট, শেয়ার ব্রোকার কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানি, বিভিন্ন ফিনান্সিয়াল রেগুলেটরি অথরিটি ও ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন থাকবে l ভারতে গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে এই হাব বর্তমান l বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য চেষ্টাও করেছিলেন নিউটাউনে l কিন্তু লজিস্টিকস হাব ও প্রযুক্তি হাব হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ নিজেকে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারায়, কলকাতার নিউটউনের ফিনান্সিয়াল হাব পরবর্তীকালে দাড় করানো যায় নি l এখন সেখানে একটি ‘ ম্যাডাম ওয়াক্স মিউসিয়াম’ শোভা পাচ্ছে l উপরন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একত্রীকরণ ফলে তাদের কারও সদর দপ্তর আজ কলকাতায় নেই l বন্ধন ব্যাংক আজকের দিনে একমাত্র স্টক এক্সচেঞ্জ লিস্টেড ব্যাংক যার সদর দপ্তর কলকাতায় l যেখানে ইতিহাস বলে, ব্যাংক অফ বেঙ্গল থেকেই স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার জন্ম l এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আবশ্যিক l
একটা SWOT বিশ্লেষণটা করাই যাক কলকাতার সম্ভাবনাকে ঘিরে l দেখা যাক 2020 তে আমরা কোথায় দাড়িয়ে l
Strength:
- কলকাতার ভৌগলিক অবস্থান লজিস্টিকস হাব হবার পক্ষে আদর্শ l জলপথ (গঙ্গা তথা NW -1), রেলপথ (পূর্ব, দক্ষিণ পূর্ব রেল), কলকাতা বিমান বন্দর এখানকার জন্য স্বাভাবিক সুযোগ এনে দিয়েছে l তবে তা পর্যাপ্ত নয় l সড়ক যোগাযোগ এখনো পিছিয়ে l মালগাড়ি তথা ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডোর সরাসরি বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে l বিমান বন্দরে অন্ততঃ তিনটি রানওয়ে প্রয়োজন l
- এতো অধঃপতনের পরও 2011 তে কলকাতার জিডিপি ($ 150 বিলিয়ন) হায়দ্রাবাদ ( $ 76 বিলিয়ন )ও ব্যাঙ্গালোরের ( $84 বিলিয়ন ) মোট জিডিপির সমান l কারণ কলকাতার ট্রেডিং l লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, মুম্বাই বা দুবাই এর মত ফিনান্সিয়াল হাব হবার সমস্ত সুযোগ এখনো কলকাতার আছে l
3. বস্ত্রশিল্প, রত্নশিল্প, স্বর্ণশিল্প, জরিশিল্প ইত্যাদির সেরা কারিগর বাঙালী l কিন্তু এর ফল ভোগ করছে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু l সারাবিশ্বের বাজার ধরার ক্ষমতা বাঙালীর আছে l শুধু বিনিয়োগ এবং তার পরিবেশ প্রয়োজন l সঙ্গে প্রয়োজন কিছু আইনের পরিবর্তন l মনিকাঞ্চন, জরি পার্ক, বস্ত্রপার্কের মত আরও SEZ চাই এই ধারণের শিল্পে MSME বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য l
4. রিলায়েন্স কোম্পানি বাংলাদেশে নিজের লোক বসিয়ে সেই দেশে বস্ত্র উৎপাদন করিয়ে সারা পৃথিবীতে বিক্রি করছে l তাহলে পশ্চিমবঙ্গ নয় কেন? আবার সেই পরিবেশ l বস্ত্রশিল্পের MSME বিনিয়োগের বিরাট সম্ভাবনা আছে এই রাজ্যে l
5.পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের খনি এই রাজ্যকে বহুদিন সুযোগ করে দিয়েছে l কলকাতা খনি প্রযুক্তিতে ( Mining Engineering) দেশের রাজধানী l কিন্তু মাসুল সমীকরণ 27 বছর পূর্বে অবলুপ্ত হলেও তার সদ্ব্যবহারে আমরা ব্যর্থ l কারণ মাফিয়াতন্ত্র l
- অতিরিক্ত জলসম্পদ রাজ্যেকে অতিরিক্ত সুযোগ দেয় l আগেই বলেছি, কলকাতাকে বাঁচতে ভারত সরকার দুবার আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে জল নিয়ে এসেছে l কিন্তু সেই জল এখনো আমরা ব্যাবহার করিনি l না সেচে, না পানীয় জলে না শিল্পে l
- চা বাগান ঠিকমত ব্যাবহার করলে পশ্চিমবঙ্গ সারা বিশ্বের বাজার ধরতে পারে l উচ্চমানের দার্জিলিং উচ্চমানের নিজের একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড l
- দেশের দুটি বৃহৎ কর্মসংস্থানমূলক তথা শিল্প IT এবং পরিকাঠামোতে যেসব প্রযুক্তিবিদ কাজ করেন তাদের অধিকাংশ মূলত বাঙালী l কিন্তু তাঁরা পরিষেবা দিচ্ছেন বাংলার বাইরে l ইনফোসিসের প্রাক্তন কর্ণধার মোহনদাস পাইয়ের মতে পশ্চিমবঙ্গের মানবসম্পদ ব্যাঙ্গালোরের কাছে সুবর্ণসুযোগ এনে দিয়েছে নয়ের দশক থেকেই l এদের ফেরার পরিবেশ তৈরি হলে, এই দুই শিল্পই রাজ্যের বেকার সমস্যা সমাধান করে দেবে l
- চীনের যে ম্যানুফেক্ট্যুরিং কোম্পানিগুলি তাদের নতুন গন্তব্য খুঁজছে তাদের জন্য ভৌগলিকভাবে কলকাতা সেরা জায়গা l কিন্তু জমি, SEZ এবং বন্দর পরিকাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে l
- দেশের ও বিশ্বের কিছু সেরা শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্র এই রাজ্যে অবস্থিত l যেমন IIT, IIM, ISI, IISER, IIEST, JU, CU, SINP, IACS, IICB, VECC ইত্যাদি l
Weakness :
- 43 বছরের নিরবচ্ছিন্ন মেধা পাচার ( Brain Drain)l
- রাজ্যের বহুদিনের নেতিবাচক বাম ভাবমূর্তি l
- রাজ্যের পুনর্বাসন নীতির ( R & R policy ) অভাব l
- কিছু পুরোনো আইন যেমন জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন, কৃষি বিপণন আইন ইত্যাদি রাজ্যের কৃষিউন্নয়নের সব চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা l
- রাজ্যের SEZ বিরোধী নীতি l
- রাজ্যের FDI বিরোধী অতীত l
- অন্যান্য মহানগরীর তুলনায় কলকাতা ও শহরতলির পরিবহন ও প্রযুক্তি পরিকাঠামোয় পিছিয়ে থাকা l
- রাজ্যের অসমাপ্ত সড়ক, বিমান, জলপথ ও বন্দর পরিকাঠামো l
- জনঘনত্ব
- শিক্ষা, স্বাস্থ্যের গুণমানের অভাব, যদিও কিছু ভাল প্রতিষ্ঠান আছে l
11. স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতা l
- অপ্রতুল বিচার ব্যবস্থা ও দুর্বল প্রশাসন l
- রাজধানী দিল্লির রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থায় বাঙালীর অভাব l কারণ গত 43 বছরে কেন্দ্র বিরোধী রাজনীতি ও UPSC ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় গত কয়েক দশক বাংলার ছাত্রদের ধারাবাহিক অকৃতকার্য হওয়া এর অন্যতম কারণ l
Opportunity
- শুধুমাত্র কেন্দ্র সরকার অনুমোদিত সব লজিস্টিকস পরিকাঠামো প্রকল্প শুরু করলে রাতারাতি বহু কর্মসংস্থান হবে এবং উন্নত পরিকাঠামো ভবিষ্যতের শিল্প বিনিয়োগ বাড়াবে l কেন্দ্র গভীর সমুদ্র বন্দর, ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডোর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোর, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, মেট্রো সম্প্রসারণ, জাতীয় ও রাজ্য সড়ক সম্প্রসারনের টাকা অনুমোদন করেছে l এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বন্দর সংযোগকারী মোরগ্রাম-হলদিয়া সড়কে বিনিয়োগে রাজি ছিল l অধিকাংশ প্রকল্প জমি জটে সব আটকে আছে l আগেই বলেছি, লজিস্টিকস হাব সফল হলে, জাহাজ, বিমান, লোকোমোটিভ ও অটোমোবাইল হাব হাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা l সঙ্গে আসবে MSME বিপ্লবের অপরিসীম সুযোগ l
- উচ্চমানের প্রযুক্তি তথা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলেজেন্সে, রোবোটিকস, বিয়োটেক & ফার্মাতে বিনিয়োগ বাড়ান সম্ভব হবে যা বাঙালীর শিক্ষা ও চরিত্রর সঙ্গে খাপ খায় এবং আগামী দিনে পৃথিবীর বাজারে যার চাহিদা আছে l সারা পৃথিবীতে বহু বাঙলি এই সব ক্ষেত্রে ভাল জায়গায় আছে l তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হবে l
- কল্যাণী, দুর্গাপুর, বারাকপুর, খড়্গপুর, জলপাইগুড়ি কিংবা বালুরঘাটের মত শহরে সিঙ্গাপুর, সাংহাই কিংবা কোটার মত আন্তর্জাতিক বা জাতীয় শিক্ষাকেন্দ্র বানানোর সব রকম উপাদান আছে l কোটার পুরো অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কোচিং ব্যবসার উপর l বাংলার অন্ততঃ পাঁচটি শহরের কোটা হবার ক্ষমতা আছে l
- ভেলোরের মত চারপাঁচটি স্বাস্থ্য হাব ও উপরোক্ত বিয়োটেক হাব তৈরি করা যায় এরাজ্যে l ভুটান, নেপাল, বিহার বাংলাদেশের জন্য মেডিক্যাল পর্যটন কেন্দ্র হাতে পারে বাংলা l আয়ুষ্মান ভারতের আওতায় গ্রামবাংলার গরিবরা এলে সেখানে উচ্চামানের বেসরকারি স্বাস্থ্যবিনিয়োগ বহুগুণ বাড়বে l পাঁচটা ভেলোর বানানোর মত মানব সম্পদও এই রাজ্যের আছে l
- অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি গুলোকে বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ( JV বানিয়ে ) ডিফেন্স হাব বানানোর সুবর্ণসুযোগ আছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ পরিকল্পনায় l কাশীপুর, ইছাপুরের রাইফেল ফ্যাক্টরি যদি পাশ্চাত্য দেশের অর্ডিন্যান্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে রফতানিমূলক ব্যবসা শুরু করে, তবে বহু অনুসারী MSME তৈরির সুযোগ আসবে l
- এখুনি পুরোনো কৃষি বিপণন আইন ত্যাগ করে চুক্তি চাষ শুরু করা ও হিমঘরে দেশি -বিদেশী ছুৎমার্গ ছেড়ে বিনিয়োগের বন্যা আনা l এতে কৃষিজীবিদের আয় কয়েকগুন বৃদ্ধি পাবে l খাদ্য প্রকিয়াকরণ, মৎস, ডেয়ারি ও চর্মজাত শিল্পে বিশ্বের বাজার ধরা শুধু সময়ের অপেক্ষায় l
- বিনোদন শিল্পকে চেন্নাই, হায়দ্রাবাদের মত সাজাতে হবে l ‘আমাজন অভিযানে’ মত বহুভাষিক ছবি বানানো যেতে পারে কলকাতায় l ঘনাদা, টেনিদা, নন্টেফন্টে, বাটুল ইত্যাদি বিভিন্ন পুরোনো সাহিত্য/গল্পকে বহুভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বের বহু কোটি টাকার মাল্টিমিডিয়া বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব বাঙালী যুবকদের l
Threat
- এখনি লজিস্টিকস হাব না বানালে, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মত রাজ্যগুলির জন্য ওড়িষ্যার চারটি বন্দর খোলা আছে l বিশেষত ধামড়া বন্দর যা প্রযুক্তি, অবস্থানগত ভাবে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ l একবার যুক্ত হলে, কলকাতা ও হলদিয়ার সম্ভাবনা চিরতরে শেষ l
- বাংলাদেশ এর মধ্যেই বেশ কটা বড় বন্দর বানিয়েছে এবং তাঁদের সঙ্গে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর যোগাযোগ স্থাপণের চেষ্টা করছে l বিশ্বব্যাংক, এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, JICA অর্থ সাহায্য দিচ্ছে l সঙ্গে, চীন প্রচুর বিনিয়োগ করছে l ওদের বিদেশমন্ত্রী প্রত্যেক রাজের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করে চলেছে l লাভ দুপক্ষেরই l কিন্তু একবার বাংলাদেশের বরিশাল বা চট্টগ্রাম নিজেদের বিসনেজ হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলে, কলকাতায় কোন বিনিয়োগকারী ভবিষ্যতে আসতে চাইবে না l
- রেঙ্গুন বন্দর আবার পুরোনো গরিমা ফিরে পাবার চেষ্টা করছে l
- রাজ্যের মানুষের গড় বয়স বাড়ছে l কারণ, মেধা পাচারের ফলে দক্ষ কর্মীরা চলে যাচ্ছে l যারা যাচ্ছে না, তাঁদের জন্য সঠিক কর্মসংস্থান নেই l বহু যুবক বাবা মার পেনশনের উপর বেচে l একটা বড় আর্থিক সংস্কার না এলে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই ভূখণ্ডে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে এবং এক সময় হাতের বাইরে চলে যাবে l তখন কোন টোটকাই কাজ করবে না l
তাহলে কিভাবে এগোতে হবে আমাদের আগামী দিনে? উপরের বিষয়বস্তু থেকেই আগামী পাঁচ বছরের কর্তব্যের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করা যাক l
- প্রথমেই কিছু পুরোনো জমি আইনের সংশোধন করে নতুন R & R policy ( জমি পুনর্বাসন নীতি) ঘোষণা করতে হবে l দরকারে ঝাড়খন্ড বা তেলেঙ্গানার সাহায্য নিতে হবে l বর্তমান কৃষিবিপণন আইন পুরোপুরি ত্যাগ করে কৃষক দের স্বাধীনতা দিতে হবে l চুক্তি চাষ শুরু করতে হবে এবং কৃষিবিপণন দপ্তর কে একটি লাইসেন্স দেবার সংস্থা থেকে রেগুলেটরি অথরিটিতে পরিণত করার আইন প্রনয়ণ করতে হবে l অবিলম্বে SEZ পলিসি গ্রহণ করতে হবে l প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, 2015 তে তৎকালীন ভারত সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ্রীমতি নির্মলা সীতারামন SEZ এ সমস্ত শ্রমিক আইন মানা বাধ্যতামূলক মর্মে আদেশ জরি করেছেন l
- গভীর সমুদ্র বন্দর এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বিশ্বের সমুদ্রবাণিজ্যে এই রাজ্যের তথা দেশেই শেয়ার বাড়াতে l বড় জাহাজ এই বন্দরে পণ্য নামিয়ে চলে যাবে এবং ছোট জাহাজ সেই পণ্য নিয়ে জাতীয় জলপথ-1( NW-1) বরাবর নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, পাটনা হয়ে প্রয়াগ পর্যন্ত চলে যেতে পারে l বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় NW 1 এর কাজ চলছে l ওদিকে উত্তরপ্রদেশে, বিহার এমনকি দিল্লির যে কোন শিল্পজাত দ্রব্য JNPT র চেয়ে অনেক কম খরচে গঙ্গাসাগরের গভীর সমুদ্র বন্দরে পাঠানো যাবে NW 1 হয়ে l পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার ও উত্তরপ্রদেশকে নতুন জীবন দান করবে কপিল মুনির আশ্রমের নিকটবর্তী এই গভীর সমুদ্র বন্দর l 2016 তে কেন্দ্র সরকার এই প্রকল্পে 40000 কোটি দেবার অঙ্গীকার করেছে l কিন্তু এখনো কাজ শুরু হয়নি l
- লজিস্টিকস হুবের বাকি শর্ত পুরো করতে ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডোর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোর, মেট্রো সম্প্রসারণ, বন্দর সংযোগকারী সকল সড়ক সম্প্রসারন ও NW -1 জলপথের কাজ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শেষ করতে হবে l কেন্দ্র এর অধিকাংশেরই আর্থিক মঞ্জুরি দিয়েছে l প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংক, ADB, NDB বা JICA থেকে ঋণ নিতে হবে l হলদিয়া ও খড়্গপুরের মাঝে একটা বিমাননগরী প্রিয়জন l নভির মুম্বাইয়ের সিউড, ভাসি বা নেরুলের মত প্রতিটি লোকাল ট্রেন ও মেট্রো রেল স্টেশনে যদি অফিস, কোল্ড স্টোরেজ বা দোকান বানানো যায়, তাতে রাজ্যের সড়ক পরিবহন সমস্যা বহুগুনে কমে যেতে পারে l
- দীঘার সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন এর কাজ এখুনি শেষ করতে হবে যাতে আগামী দিনে উচ্চপ্রযুক্তির শিল্পের গন্তব্য হয় পশ্চিমবঙ্গ l ফিনান্সিয়াল হবের ক্ষেত্রেও উন্নতমানের ইন্টারনেট পরিষেবার প্রয়োজন l 2007 এ হলদিয়ার মানুষের আত্মঘাতী আন্দোলনে এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায় এবং পরে কেন্দ্র সরকার ( BSNL) দিঘায় এই প্রকল্প স্থানান্তরিত l সম্ভবত এখনো শেষ হয় নি l
- বিদ্যুতের দাম কমাতে অপ্রচলিত বিদ্যুতের উৎপাদন বহুগুণ বাড়াতে হবে l পশ্চিমবঙ্গ যে দামে বিদ্যুৎ বেচে, এখানে উৎপাদন শিল্পে কেউ বিনিয়োগ করবে না l মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্ততঃ 50% অপ্রচলিত হাওয়া উচিৎ l
- প্রশাসনকে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের মত ঢেলে সাজাতে হবে l যেমন, সেচ, ক্ষুদ্র সেচ, জনস্বাস্থ্য দপ্তরকে এক ছাতার ( দপ্তর ) তলায় আনা l এছাড়া সেচ, পানীয় জল, সড়ক, মেট্রো রেল, মেরিটাইম, জলপথ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আলাদা কর্পোরেশন প্রয়োজন, প্রশাসনিক লাল ফিতের ফাঁস থেকে মুক্তি পেতে l
- কেন্দ্রের নতুন কৃষিবিপণন আইন অবিলম্বে রাজ্যে প্রবর্তন করে কৃষকদের লাইসেন্স রাজ থেকে মুক্তি দিতে হবে l এই দপ্তরকে রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে কাজ করতে হবে l হিমঘরে বিনিয়োগে উচ্চপ্রযুক্তির বিদেশী বিনিয়োগ ( ওয়ালমার্ট /ট্রেসকো ) এবং শিক্ষিত যুবকদের MSME ( যেমন ফ্লিপকার্ট ) দুটিকেই উৎসাহ দিতে হবে l সঙ্গে শুরু করতে হবে চুক্তি চাষ l
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিদেশী বিনিয়োগের রাস্তা খুলতে হবে l নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি বানিয়ে রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্রে বিদেশে চলে যাওয়া সেরা মেধা ফিরিয়ে আনতে হবে l
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হল আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে l প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর ঘরানা ছেড়ে IIM ঘরানায় অর্থনীতি ও ব্যবসাকে প্রাধান্য দিতে হবে l পশ্চিমবঙ্গের উপর গত 54 বছরের ( মাঝে অবশ্যই 1972-77 বাদে ) গিনিপিগ পরীক্ষার পর মার্ক্সিয় অর্থনীতির সম্পূর্ণ ব্যর্থতা নিয়ে আমাদের মনে কোন প্রশ্ন থাকা আর উচিৎ নয় l তাই ‘রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প’, ‘জয়েন্ট ভেঞ্চার’, ‘রাষ্ট্রের অধীন’ ইত্যাদি শব্দ আমাদের শব্দকোষ থেকে এখনই মুছে ফেলতে হবে l মুছে ফেলতে হবে দেশি-বিদেশী পুঁজির ছুৎমার্গ l মেনে নিতে হবে, সরকার কোন ব্যবসা করবে না l সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা ও পরিকাঠামোতে মনোনিবেশ করুক l প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী ও বিকেন্দ্রীকরণ করুন l আজ থেকে প্রায় 22 বছর আগে আনন্দবাজারে প্রকাশিত ডঃ অসীম দাশগুপ্ত ও ডঃ ইউনিসের একটি কথোপকথন এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করি l ডঃ ইউনিসকে অসীমবাবু নাকি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা পশ্চিমবঙ্গে খুলতে, কিন্তু সরকারের হাতে কিছু শেয়ার থাকবে l ডঃ ইউনিস বললেন, সরকারের 1% শেয়ার থাকলেও উদ্দেশ্য সফল হবে না l ডঃ ইউনিস পশ্চিমবঙ্গকে নিজের গন্তব্য বানালেন না l কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের একটা স্বাভাবিক বাজারজাত চাহিদা ছিল, যা পূরণ করা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব ছিল না সেই সময় l চাষী, ছোট ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তখনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ পেত না এবং গরিবরা মহাজনদের ঋণের জালে জড়িয়ে নিঃস্ব হতেন l আর, সেই চাহিদা পূরণ করেছিল সারদা, রোজভ্যালি, আইকোর, অ্যালকেমিস্টরা l বাকিটা ইতিহাস l সেই ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে আমাদের শক্ত ভিতের উপর ভবিষ্যৎ বানাতে হবে l
উপরের নয়টি পদক্ষেপ আমাদের পরের পাঁচ বছরের মধ্যেই নিতে হবে l 1991 থেকে 1996 এর মধ্যে আনা বিভিন্ন সংস্কার যেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের ছবি সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিয়েছিলো , ঠিক তেমনই কিছু সংস্কার চাই পশ্চিমবঙ্গে l সেক্ষেত্রে 2026 এর মধ্যেই বিশ্বের বিনিয়োগ মানচিত্রে জায়গা করে নেবে আমাদের রাজ্য l শুধু একটা সবুজ সংকেতের অপেক্ষা যে কলকাতা ফিরে এসেছে পুরোনো শক্তি নিয়ে; সামনের সারিতে দাড়িয়ে নেতৃত্ব দেবার জন্য l একবার আস্থা অর্জন করতে পারলেই চাকা গড়াতে থাকবে l বাজারের চাহিদাতেই বিনিয়োগ আসবে l পশ্চিম বা দক্ষিণ ভারতের মত ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা পুঁজি নিয়ে দাড়িয়ে থাকবে দরজার সামনে l একবার শুধু সংকেত দিতে হবে যে কলকাতা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রদর্শিত পথে আবার দক্ষিণমুখী l
সূত্র (আটটি পর্বের জন্য )
- A Better India A Better World by N R Narayana Murthy
- Imaging India by Nandan Nilekani.
- India and the World on Geoeconomics and Foreign Policy Hardcover by Sanjaya Baru
- 1991: How P V Narasima Rao made history by Sanjaya Baru
- The Dramatic Decade: The Indira Gandhi Years by Pranab Mukherjee
- The Turbulent Years : 1980-1996 by Pranab Mukherjee
- Articles fromqThe Telegraph website
- Articles from Anandabazar Patrika website
- Ganashakti website
- Old Bartaman Articles and editorials
- The legecy of Jyoti Basu by Menon Ramdas
- Demolition of Bengal Pride by Asit Chakraborty
- BBC India website.
- Articles from The Economist Magazine
- Biography of Various political Leaders of India as well as West Bengal.
- Bengal Sounds Mckinsey for Industry Study by Renu M R Kakkar
- wbidc website
লেখক : সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)
( লেখক বহুজাতিক পরামর্শদাতা সংস্থা URS কনসাল্টিং ইন্ডিয়ার ভূতপূর্ব চিফ জেনারেল ম্যানেজার? )