মহাকাশ গবেষণায় ভারতের ঐতিহাসিক পদক্ষেপ

সাম্প্রতিক অতীতে চন্দ্রযান-২ ভারতের জাতীয় জীবনে সবাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বস্তুত, এক দশক আগেও ভারত কখনো চাঁদের রকেট পাঠাবে, একথা ভাবতে পারা বেশ কষ্টকর ছিল। কিন্তু ২২ জুলাই, ২০১৯, আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব সেই ঘটনাটি ইসরোর বিজ্ঞানীরা সফলভাবে ঘটিয়েছেন। এরপর যে ভারত একদিন চাঁদে নভশ্চরও পাঠাবে, সে ব্যাপারে আশা করি কেউ আর দ্বিমত পোষণ করবেন না।
চন্দ্রযান-২ ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযান। প্রথমটি ছিল চন্দ্রযান-১। এর সাংগঠনিক পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগত কলাকৌশল রচনার যাবতীয় কৃতিত্ব ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন (ইসরো)র বিজ্ঞানীদের। ২২ জুলাই ২০১৯ তারিখে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল মার্ক-৩ (জি এস এল ভি এম কে ৩) চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি দেয়। ইসরোর বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন, পৃথিবী থেকে চাঁদের নিকটতম বিন্দুর দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার এবং দূরতম বিন্দুর দূরত্ব ৪৫,৪৭৫কিলোমিটার। এবার আসা যাক রকেটের পে লোড প্রসঙ্গে। রকেটে রয়েছে একটি লুনার অরবিটার, একটি ল্যান্ডার এবং একটি লুনার রোভার। এই রোভারের নাম প্রজ্ঞান। এটি একটি রোবট। প্রজ্ঞান চাঁদের অভ্যন্তরে ঘুরে ঘুরে মানচিত্র তৈরি করবে এবং চাঁদের জল আছে কিনা তার সন্ধান করবে।
চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে চন্দ্রযান -২-এর ল্যান্ডার। জায়গাটা সম্বন্ধে আগাম ধারণা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এটি একটি সমতলভূমি, চাঁদের দুই আগ্নেয়গিরি ম্যানজিনাস সি এবং সিমপেলিয়াস এনের ঠিক মাঝখানে। অবতরণের দিন অর্থাৎ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ৭০ ডিগ্রি অক্ষাংশে অবস্থান করবে। চাকাবিশিষ্ট প্রজ্ঞান ১৪ দিন (এক চান্দ্র দিন) ধরে চাঁদের মাটির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করবে এবং সেই তথ্য রিলে পদ্ধতিতে চন্দ্রযান-২ অরবিটারের মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠাবে। অরবিটারের কার্যকালের মেয়াদ এক বছর। এই এক বছরে ১০০ গুণিত ১০০ কিলোমিটার ক্ষেত্র জুড়ে অনুসন্ধান চালাবে।
চন্দ্রযান -২-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য চাদের সফট-ল্যান্ডের সন্ধান এবং প্রজ্ঞানকে সঠিক দিশায় চালনা করা। প্রজ্ঞানের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ক্ষেত্রানুসন্ধান এবং চাঁদের মাটি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ। প্রজ্ঞানের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব চাঁদের মেরু অঞ্চলে বরফের সন্ধান করা। বরফের সন্ধান পাওয়া গেলে জলের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অনেকটাই নিঃসংশয় হওয়া যাবে। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, চাঁদে জল থাকা বা না-থাকা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন? বহুচর্চিত আর্টেমিস প্রকল্পে চাঁদে একটি বেস স্টেশন তৈরি করার প্রস্তাব রয়েছে। এই কারণেই চাঁদের জলের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, পৃথিবীতে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে সুদূর ভবিষ্যতে স্থান সংকুলান করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। কথাটা আজ আজগুবি বলে মনে হলেও অনেক বছর পর একদিন মানুষকে সত্যিই চাঁদে বা মঙ্গল গ্রহে গিয়ে থাকতে হবে। সুতরাং, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় দুটি জিনিস— অক্সিজেন এবং জল আছে কিনা সেটা জেনে নেওয়া খুবই জরুরি। চন্দ্রযান-২ সেই জরুরি দায়িত্ব পালনে ভারতের একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলা দরকার। চন্দ্রযান-২ সম্পূর্ণত ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মেধাপ্রসূত। এমনকী, এই প্রকল্পে যে অরবিটার, ল্যান্ডার এবং রোভার ব্যবহার করা হয়েছে তাও ভারতে তৈরি। মোদী সরকারের মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের সীমাহীন সাফল্যের মুখ হয়ে। উঠেছে চন্দ্রযান-২। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইসরোর বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানিয়ে মহাকাশ গবেষণায় আরও সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আপাতত সারা দেশ আগামী ৭ সেপ্টেম্বরের অপেক্ষায়। এদিন চন্দ্রযান-২ চাঁদে অবতরণ করবে। দিনটা যে ভারতের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে উঠতে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অরিন্দম মল্লিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.