১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট | ঢাকার মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পুলিশের আই জি মিস্টার লোম্যান-কে গুলি করে হত্যা করে সেই কলেজেরই এক ডাক্তারি পড়ুয়া | নাম বিনয়কৃষ্ণ বসু | এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে তা ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে ছিল কল্পনাতীত | সাড়া পড়ে গেল আসমুদ্র হিমাচল | এক সাহিত্যিক সেই যুবকের বিক্রমে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, “ধন্যি ছেলে, দেখিয়ে গেছে আমরাও জবাব দিতে জানি।”
মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই আসবে স্বাধীনতা । চরকা কেটে স্বরাজ আসবে কোনদিনই মানতে পারেননি | বিপ্লবীদের রিভলবার, গুলির জোগান দিয়ে সাহায্য করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন যখন আত্মগোপন করে আছেন, তাঁকে পাঠানোর জন্য নিজের সঞ্চিত পাঁচ হাজার টাকা বিপ্লবী কালীপদ ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেন তিনি ।
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় দেশ জুড়ে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে তিনিও সেই আন্দোলনে যোগ দিলেন। তিনি হাওড়ায় থাকতেন বলে দেশবন্ধু তাঁকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি পদের দায়িত্ব দেন। সেই পদে তিনি ছিলেন ১৯২১ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত। দেশবন্ধুর বাড়িতে সশস্ত্র সংগ্রামের পথিক অনেক বিপ্লবীর সঙ্গে সেই সাহিত্যিকের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তাঁর বাড়িতে বিপ্লবীরা নিয়মিত যাতায়াত করতেন। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র রায়, শচীন সান্যালের মতো প্রথম সারির বিপ্লবী নেতারা ছিলেন তাঁর বন্ধু। বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর মামা |
পথের দাবী’ লেখার সময়ে তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা বিভি দলের শীর্ষ নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। চার্লস টেগার্ট এই বিপ্লবী টাইপটিকেই ভয় করতেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, ‘পথের দাবী’র সব্যসাচী, বাস্তব সব্যসাচীদের মনে সংগ্রামের বীজ বপন করবে। এই প্রবণতা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে বিপজ্জনক। তাই ‘পথের দাবী’-র সব্যসাচীকে টেগার্ট অঙ্কুরেই বিনাশ করতে চেয়েছিলেন | ‘পথের দাবী’ প্রথম সংস্করণে মোট তিন হাজার কপি ছাপানো হয়েছিল। বই হয়ে বেরনোর সঙ্গে-সঙ্গেই সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। প্রথম দিকে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল বইয়ের লেখক, মুদ্রক ও প্রকাশক— সকলকেই শাস্তি দেওয়া। কিন্তু সে সময়কার পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু এই কাজ থেকে কর্তৃপক্ষকে নিবৃত্ত করেন। তাঁর চেষ্টায় শুধু বইটিই নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিপ্লবের কাজে সহায়তা করতে ‘চরিত্রহীন’ এবং ‘পথের দাবী’ বইয়ের সত্ব তিনি হেমচন্দ্রকে দিতে চেয়েছিলেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’। বাঙালি জীবনের ছোটোবড়ো আনন্দ-বেদনাকে তিনি এমন সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করেছেন, যা সাধারণ পাঠকদের মন ছুঁয়ে গেছে অনায়াসে | কিন্তু সাহিত্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর বিপ্লব সত্ত্বা | তিনি ছিলেন সাহিত্যিকের বেশে এক বিপ্লবী |
আজ জন্মদিবসে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য |