“অতুলপ্রসাদের ‘উঠো গো ভারতলক্ষ্মী’ কথা, সুর এবং লয়বিন্যাসে চমৎকার হলেও তা নিছক পরাধীন ভারতের, তবে তাঁর ‘মোদের গরব মোদের আশা’-কে বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম নতুন করে একটি ঐতিহাসিক পুনরাবর্তন উপহার দিয়েছিল, ফলে তা বাঙালিদের কাছে নতুন করে প্রেরণাদায়ক হয়ে উঠেছিল। এবং ‘বলো বলো বলো সবে’ বা ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’ এই গানগুলি নিছক প্রেরণাদায়ী বলেই এগুলির মধ্যে একটা চিরস্থায়ী আবেদন তৈরি হয়েছে। এগুলি কোনও প্রতিযোগিতার সূত্র দেয় না, বরং দেশের উন্নতিকে দেশবাসীর আত্মদানকে আহ্বান করে।” বলছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-চিন্তক পবিত্র সরকার।

এ দেশের মানুষ প্রত্যেকদিনই নতুন নতুন দেবতা গড়তে আগ্রহী। মানুষকে কিছু গুণের আধার দেখলেই তারা দেবতা বানিয়ে পুজো করতে শুরু করেন। কোনও গুণীজন মারা গেলে বা তাঁর জীবনী লিখতে বসলে সেগুলিতে কোনও মানুষের জীবনের বোধহয় ছাপ পড়ে না, পড়ে একজন পাথুরে দেবতার। অতুলপ্রসাদও এর ব্যতিক্রম নন। সেকারণেই বোধহয় তিনি আজও প্রায় অনালোচিত। অতুলপ্রসাদী গান এ প্রজন্ম ভুলতে বসেছে।

অতুলপ্রসাদ সেন একজন সঙ্গীতকারই নন, কবিও বটে। এছাড়াও তিনি ছিলেন তৎকালীন ব্যারিস্টার। অতুলপ্রসাদকে জানতে-বুঝতে হলে তাঁর জীবনের মূল মন্ত্রটি আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। খুব ছোটোবেলাতেই ঈশ্বর-ভক্ত বাবার সান্নিধ্যে তাঁর ধর্মজীবনের উন্মেষ। পরে জীবনের দুঃখ ও আঘাত তাঁকে আরও ঈশ্বরমুখীন করে তুলেছিল, যেমনটা হয় আর কি! রুদ্রের শিবরূপই হয়েছে তাঁর আরাধ্য। “তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো”-এই ছিল তাঁর প্রার্থনা। আঘাতের পর আঘাত পেয়ে, কোনো অভিযোগ না করে, তিনি প্রার্থনা করেছেন, — “আমারে ভেঙে ভেঙে করো হে তোমার তরী”। এই ঈশ্বরপ্রেমই তাঁর ব্যবহারিক জগতে মানবপ্রেমে রূপান্তরিত হয়েছিল, গেয়েছিলেনঃ- “সবারে বাস্‌ রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে। আছে তোর যাহা ভালো ফুলের মতো দে সবারে”, “আমারে রাখতে যদি আপন ঘরে, বিশ্ব-ঘরে পেতাম না ঠাঁই। দুজন যদি হত আপন, হত না মোর আপন সবাই”।

মা এবং স্ত্রী এই দুই নারী তাঁর অস্থিমজ্জায় মিশে ছিল, মিশে ছিল তাঁর সৃষ্টিতে। অতুলপ্রসাদ জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট জয় করে শেষমেশ কোথায় পৌঁছালেন! অতুলপ্রসাদের জীবন যেন দহনে পোড়া। একটা দগদগে ক্ষত সারাজীবন তাঁকে হনন করেছে। আর সেখানেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন সৃষ্টির চূড়ান্ত রহস্য। একসময় রবীন্দ্রনাথও তাঁর বাড়িতে গেছেন গান শুনতে।  ‘প্রেমে চন্দ্র তারা
কাটে নিশি দিশাহারা
যার প্রেমের ধারা
বহিছে শতধারে
সে ডাকে আমারে।’

সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে অতুলপ্রসাদের এই গানটি নিজের গলায় গেয়েছিলেন পাহাড়ী সান্যাল। সিনেমার জগতে প্রথম প্রবেশের সময়ে তিনি নিজের গলায় কিছু গান অবশ্যই গেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলা সিনেমা তাঁর সঙ্গীত প্রতিভাকে যথোচিত মর্যাদায় কাজে লাগাতে পারেনি।

গায়ক পাহাড়ী সান্যাল যেমন আমাদের কাছে অনেকটা অনালোচিত তেমনি হয়তো তাঁর অন্যতম গুরু অতুলপ্রসাদও। পেশায় আইনজীবী এই মানুষটি জীবনের শেষ ৩২ বছর কাটিয়েছেন লখনৌ শহরে। আর সেই সময়ই লিখেছেন দুই শতাধিক গান। যেহেতু তিনি কলকাতা কেন্দ্রিক ছিলেন না হয়তো সেই কারণেই প্রচারের পাদপ্রদীপে অতুলপ্রসাদ তেমন ভাবে স্থান পাননি।

পাহাড়ী সান্যাল তাঁর পরিচ্ছন্ন রচনায় অতুলপ্রসাদের আন্তরিক ছবি এঁকেছেন। পাহাড়ীবাবুর লেখা ‘মানুষ অতুলপ্রসাদ’ বইতে তাঁর কথা শুরু হয়েছে আজ থেকে একশ বছর আগের লখনৌ শহর দিয়ে। লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার প্রায় চল্লিশ বছর পর তা একটি গ্রন্থের চেহারা পেল। তাতে অতুলপ্রসাদ এবং পাহাড়ী সম্পর্কে আমাদের সীমাহীন উপেক্ষাই আরেকবার প্রমাণিত হয়।সাবেক লখনৌয়ের জীবনযাত্রায় এ.পি সেন ছিলেন একজন পুরোদস্তুর সাহেব। পাহাড়ী সান্যালের স্মৃতিকথায় একজন বিলেত ফেরত বার-অ্যাট-ল, পাশ্চাত্য সঙ্গীতে আগ্রহহীন একজন খাঁটি সংগীত প্রেমী, একজন সম্মানিত সমাজপতি এবং দাম্পত্যজীবনে বহু আঘাতে জর্জরিত এক অসহায় মানুষকে বড় আপন করে পাই।

লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন চাঁদের হাট এবং সেখানে বঙ্গসন্তানদের ছড়াছড়ি। ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায় (কুমারপ্রসাদের বাবা), রাধাকমল মুখার্জী, রাধাকুমুদ মুখার্জী, বিনয় দাশগুপ্ত, নির্মল সিদ্ধান্ত, এমন অনেকে। নির্মল সিদ্ধান্ত পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী চিত্রলেখা সিদ্ধান্ত যে একজন বড়মাপের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিলেন সেই তথ্যও উঠে এসেছে পাহাড়ী সান্যালের লেখায়। সেই আসরের মধ্যমণি যে অতুলপ্রাসাদ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়সরবাগের বাড়ি, উট্রাম রোডের আস্তানা বা শেষমেশ এ.পি সেন রোডের বাসভবন সবসময়েই গুণীজনের সমাবেশে উজ্জ্বল এবং সংগীতই সেখানে প্রধান যোগসূত্র।

পাহাড়ী যখন বিশ্ব বছরের সদ্য যুবক তখন পণ্ডিত ভাতখন্ডের উদ্যোগে লখনৌ-র স্যার উইলিয়াম মেরিস কলেজ অব হিন্দুস্থানী মিউজিক প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই উদ্যোগেও অন্যতম পুরোহিত ছিলেন অতুলপ্রসাদ। পণ্ডিত ভাতখন্ডে নিজে পাহাড়ীকে সেই কলেজে ভর্তি করেন। পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ নারায়ন রতন জংকার পাহাড়ীর শিক্ষক ছিলেন।

বিলেতে আইন পড়ার সময় অতুলপ্রসাদের বন্ধুমহলে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, ডি.এল. রায়, অরবিন্দ ঘোষ, মনমোহন ঘোষ এবং সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়ের(নাইডু) মত মানুষেরা। ফলে অতুলপ্রসাদের কলকাতায় থিতু হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।

কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের এক চরম আঘাতে তিনি কলকাতা থেকে দূরে সরে যান। অতুলপ্রসাদের পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পরেই তাঁর মা হেমন্তশশী বিবাহ করেন চিত্তরঞ্জন দাসের জেঠামশাই ছয় সন্তানের পিতা দূর্গামোহনকে। উদারপন্থী ব্রাহ্মরাও সেই বিবাহ মেনে নিতে পারেনি।
অতুলপ্রসাদ নিজে জড়িয়ে পড়লেন মামাতো বোন হেমকুসুমের প্রেমে। সেই বিবাহ নিয়েও সমাজে ঝড় ওঠে। অতুলপ্রসাদ প্রথমে লন্ডন এবং পরে লখনৌয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে শান্তি আসেনি। লখনৌ শহরে হেমকুসুম পৃথক বাড়িতে থাকতেন। হয়তো জীবনে দুই নিকটতম নারীর কাছ থেকে আঘাত আসায় অতুলপ্রসাদের যাবতীয় সংগীতে বিরহের বিষন্ন ছায়া দীর্ঘায়িত হয়েছে।

পাহাড়ী এই বৃত্তান্ত গভীর মমতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। হয়তো নিজের অজান্তেই শিক্ষক অতুলপ্রসাদের সঙ্গে নিজের একটা সমান্তরালও টেনে ফেলেছেন। মেরিস কলেজে গান শেখার সময়েই তাঁর পরিচয় ঘটে প্রতিভা সেনগুপ্তের সঙ্গে। গানের তরণী বেয়ে সেই সম্পর্ক গভীর প্রেমে পরিণত হয়। কিন্তু তার কোন চূড়ান্ত পরিণতি কোন দিনই ঘটেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.