কোন্ দূর শতাব্দের কোন্-এক অখ্যাত দিবসে
নাহি জানি আজি
মারাঠার কোন্ শৈলে অরণ্যের অন্ধকারে ব’সে,
হে রাজা শিবাজি,
তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎপ্রভাবৎ
এসেছিল নামি–
“একধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেঁধে দিব আমি।”
রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিই যথার্থ ছিল। বিবাদমান দেশে বিভিন্নতার মধ্যে একতার জয়ের মর্ম উপলব্ধি করেই শিবাজী মহারাজ বিদেশী শত্রুর সঙ্গে বারংবার যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিলেন । পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে জয়ের নেশায় আবার ঝাঁপিয়েছিলেন আর বিজয় কেতন উড়িয়েছিলেন ।
জৈষ্ঠর শুক্ল ত্রয়োদশীর পুন্য দিবসে শিবাজীর রাজ্যাভিষেক এবং রাজ্যপাট ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় । শিবাজীর মধ্যে স্বদেশ প্রেম এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শ শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে । তাঁর ন্যায়পরায়ণতা, স্বদেশনিষ্ঠা তাঁকে এক মহা সম্মানের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেছিলো।
মহম্মদ বিন কাসিমের ভারত আক্রমণে দেশে এক সংকটপূর্ন আবহের সৃষ্টি হয়। বিজয়নগর সাম্রাজ্য বিলোপের কারনে দেশে নিরাশাজনক পরিস্থিতি তৈরী হয়। শিবাজীর পূর্বে এমনই ছিল সম্যক চিত্র । শিবাজীর রাজ্যাভিষেক শুধু তাঁরই বিজয়ের বার্তা বহন করে না। ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে হিন্দুরাষ্ট্রর সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য যা যা কষ্টসাধ্য প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল শিবাজীর রাজ্যাভিষেকের মধ্য দিয়ে তার সম্পুর্ন সফল পরিনতি প্রাপ্ত হয় ।
১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে শিবনেরি দূর্গে পিতা শাহজী ভোঁসলে ও মাতা জীজাবাঈয়ের ঘরে শিবাজি জন্মগ্রহণ করেন। শিবাজির পিতা শাহজী বিজাপুরের সুলতানের অধীনে কার্যভার গ্রহণ করে চলে যাওয়ার পর শিশুপুত্র শিবাজীসহ জীজাবাঈ দাদাজী কোণ্ডদেবনামে এক বিচক্ষণ ব্রাহ্মণের তত্ত্বাবধানে পুনায় থেকে যান। ধর্মপরায়ণ মায়ের প্রভাব শিবাজীর জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিল।রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী শুনে শিশুকালেই শিবাজী বীরত্ব ও দেশপ্রেমের আবেগে মথিত হয়েছিলেন। মায়ের মতো কোণ্ডদেবও শিবাজীর চরিত্র গঠনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। শিবাজীকে বাল্যবয়স থেকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ হতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন মা ভবানীর পুজারক এবং নিজের মাতৃদেবী জীজা বাঈয়ের প্রতি অনুগত ও একান্ত শ্রদ্ধাশীল। শত্রুর প্রতি তিনি ছিলেন নির্মম, কিন্তু মহিলা, শিশু এবং নিজেদের লোকের প্রতি ছিলেন দয়াল। সমস্ত ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। সমস্ত ধর্মগ্রন্থের প্রতি তাঁর ছিল অটুট শ্রদ্ধা। ১৬৪৭ সালের ৭ মার্চ দাদাজী মারা যান। ফলে শিবাজী মাত্রই কুড়ি বছর বয়সে নিজেই নিজের কর্তা হয়ে বসেন। আর এর মধ্যেই তিনি সামরিক ও সাধারণ প্রশাসনে নিজেকে শিক্ষিত করে। নিয়েছিলেন। তিনি মাউলি জাতির লোকেদের নিয়ে এক সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন।
শিবাজীর রাজ্যাভিষেক কেবলমাত্র একটি বিজয় উতসব হিসাবে গন্য করা ঠিক নয়। কাবুলের আক্রমণ থেকে শুরু করে তাঁর রাজ্যাভিষেক পর্যন্ত শিবাজীর ধর্ম , সংস্কৃতি ও সমাজের ভিত্তিতে দেশকে হিন্দুরাস্ট্র করার প্রয়াস বারংবার বাধাপ্রাপ্ত হয়। বহুপ্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষাও চলে। রাজারা প্রচুর রনকৌশলে যুদ্ধে অবতীর্ন হন। সাধুসন্তরা দেশ ও সমাজকে শান্তিপুর্ন ও একাত্ম রাখার জন্য সচেষ্ট হলেন , ত্যাগের আদর্শে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর হলেন। ফলে কিছু ক্ষনস্থায়ী সফলতা এলেও সমাজের যা প্রয়োজন ছিল তা অধরাই রয়ে গেল।শিবাজী মহারাজজীর রাজ্যাভিষেকের মাধ্যমে সকল প্রচেষ্টার সফলতা পরিপূর্ণতা পেল । এই জয় কেবলই শিবাজীর নিজস্ব একক জয় ছিল না, এই জয় শত্রুর বিরুদ্ধে হিন্দুরাস্ট্র গঠনের লক্ষে সংগ্রামরত অগনিত দেশবাসীর জয় হিসাবে সুচিত হলো ।
এর সঙ্গেই এক নতুন যুগের সুচনা হলো যার লক্ষ্য কখনোই ছিলনা ক্ষমতার দখল বা সম্পদ লুন্ঠন। বরং মুল উদ্দেশ্য ছিল দেশবাসীর বোধশক্তির রূপান্তর ঘটানো, পরিবর্তন বিরোধীদের উচ্ছেদ করে শান্তিকামী, অহিংস, সহনশীল ও ভারতীয় দর্শনে আস্থাশীল এক নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করে আক্রমণকারী দেশ বিরোধী অসহিস্নু আগ্রাসী বিদেশী ও তাদের সমর্থনকারীদের পরাজিত করা। তাঁর শাসননীতির লক্ষ্য ছিল উদারতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যাতে উনি সফলও হয়েছিলেন।
শিবাজী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সামান্য এক জায়গিরদারের অবহেলিত পুত্র শিবাজী নিজের প্রতিভায় এক স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সততই গোষ্ঠীদন্ধে বিবাদমান মারাঠাদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে একতার সুত্রে এক শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ জাতিতে রুপান্তরিত করেছিলেন।
ভারতের বেশিরভাগ অংশকে তখন প্রবল প্রতাপান্বিত বিদেশি মোগল রাজশক্তি তার। তরবারির জোরে পদানত করেছে। দার-উল-হরব-কে দার-উলইসলামে পরিণত করার জন্য গোঁড়া, যুদ্ধবাজ, ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে ইসলামিক আক্রমণ দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার দিকে ধাবিত হয়েছে। এই ধরনের এক পটভূমিকায় শিবাজীর উত্থান হয় দাক্ষিণাত্যের মহারাষ্ট্রে।
এরই মধ্যে বিজাপুরের সুলতান অসুস্থত হতে পড়েনএবং শিবাজীর সামনে সুযোগ উপস্থিত হয় এবং শিবাজী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তোরনা দুর্গ দখল করেন। তাছাড়া, তিনি সরকারি তহবিল থেকে ২ লক্ষ হুনের প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি রাজগড়ে এক দুর্গ নির্মাণ করেন। এরপর তিনি একে একে বড়মতি, রায়গড়, পুরন্দর, প্রভৃতি স্থানের দুর্গগুলি দখল করে নেন। এইভাবে শিবাজী তার কাঙ্খিত পথে এগোতে শুরু করেন। এরপরে একের পর এক যুদ্ধে লিপ্ত হন। মোগলদের সঙ্গে তার সংঘর্ষ শুরু হয় ১৬৫৭ সালে।
ঔরঙ্গজেব শাহজাহানের অসুস্থতার সংবাদে দিল্লী চলে গেলে, বিজাপুরের সুলতান শিবাজীকে দমন করার জন্য সেনাপতি আফজল খাঁকে পাঠান। আফজল খাঁ প্রতারণার আশ্রয় নেন এবং আফজল খাঁ শিবাজীকে তার শিবিরে আমন্ত্রণ জানান। শিবাজী আফজল খাঁর দুরভিসন্ধিরর কথা আগেই জানতে পেরেছিলেন। সুতরাং তিনি প্রস্তুত হয়েই আফজল খাঁর শিবিরে আসেন। আফজল খাঁ আলিঙ্গনের সুযোগে শিবাজীকে ছুরির আঘাত করতে উদ্দ্যত হলে শিবাজী লোহার তৈরি ‘বাঘনখ‘ অস্ত্রের সাহায্য-এ আফজল খাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে সেনাপতি আফজল খাঁকে হত্যা (১৬৫৯) করেন, শায়েস্তা খাঁকে রাত্রে অতর্কিতে আক্রমণ, দক্ষিণ কোঙ্কণে রাজ্যবিস্তার, সুরাট বন্দর লুণ্ঠন, ১৬৬৪ সালে মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ, জয়সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পুরন্দরের সন্ধি, আগ্রায় আওরঙ্গজেবের সাক্ষাৎ ও বন্দি হওয়া, বন্দি অবস্থায় পলায়ন ও স্বদেশে প্রত্যাগমন ইত্যাদি ঘটনা পর পর ঘটে যায়। বন্দিদশা থেকে ফিরে শিবাজী ১৬৬৭ থেকে ১৬৬৯ এই তিন বছর কোনো যুদ্ধে অবতীর্ন হননি। ১৬৭০ সালে যুদ্ধ শুরু করলেন মোগলদের সঙ্গে। মোগলদের কাছ থেকে একের পর এক দুর্গ দখল করলেন তিনি। গোষ্ঠি কোন্দলে লিপ্ত মোগলরা শিবাজীর সহসা আক্রমনে আর তার সঙ্গে পেরে উঠল না। এরপর শিবাজী অবিরত থাকলেন সুরাট লুণ্ঠন, ডিনডোরির যুদ্ধ, বেরার ও বাগলানা লুণ্ঠন ও দখল, কোলি কব্জা করা ইত্যাদি কাজে। প্রবল প্ররাক্রমশালী মোগলেরা শিবাজীর সঙ্গে যুদ্ধে নাস্তানাবুদ হয় এবং জাতীয় ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে ।
শিবাজীর রাজ্যাভিষেক হয় ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন রায়গড় দুর্গে। তিনি ছত্রপতি উপাধি ধারণ করেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে ‘রাজা’ উপাধি দিলেন এবং বেরারে একটি জায়গীর প্রদান করেন। তাঁর রাজ্যাভিষেক হিন্দু এবং মারাঠাদের মধ্যে বিপুল উন্মাদনার সঞ্চার করে। তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি কোনও বিদ্বেষভাব পোষণ করতেন না। তাঁর সেনাবাহিনী কোনও মসজিদে লুঠতরাজ চালায়নি বা মসজিদ ধ্বংস করেনি। তাঁর সেনাবাহিনীতে পাঠান, পর্তুগিজ, ফরাসী, মোগল প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের মানুষদের গ্রহণ করেছিলেন।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ জয়ন্তী শিব জয়ন্তী নামেও জনপ্রিয় যা মহারাষ্ট্র সহ অনেক প্রদেশেই জাতীয় উত্সবের মতোই পালিত হয়। ১৮৬৯ সালে জ্যোতিরাও ফুলে শিবাজী মহারাজের সমাধিটি আবিষ্কার করেন এবং তখন থেকেই শিবাজী জয়ন্তী পালিত হয়ে এসেছে। পরবর্তী কালে বাল গঙ্গাধর তিলকও জাতি ধর্মের উর্ধে উঠে সকল শ্রেনীর মানুষকে সম্মিলিত করে দিকে দিকে শিবাজী জয়ন্তী মহা সমারোহে পালন করে এসেছে। অনুরুপ ভাবে বাবা সাহেব আম্বেদকারও প্রচুর উদ্দীপনার সাথে শিবাজী জয়ন্তী পালন করে এসেছিলেন।
শিবাজী মহারাজ যুদ্ধ রচনা ও সেনাবাহিনী পরিচালনার এক নিখুঁত শিল্পী ও যোদ্ধা ছিলেন।তদুপরি তাঁর রাজত্বকালে হিন্দু ধর্ম পুনরুজ্জীবনে তাঁর অবদান অদ্বিতীয়। শিবাজী জয়ন্তীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম ।শত্রু দমন কালে তাঁর শৌর্য্য, অদম্য সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রনতি জানাতে সারা দেশের দিকে দিকে মহা সাড়ম্বরে পালন করতে সবাই মিলে এগিয়ে আসুন ।
সৌমিত্র সেন (Soumitra Sen)