হিন্দুদের খ্রিসমাস ও যিশু পুজো

বড়দিন বা যিশু খ্রিস্টের তথাকথিত জন্মদিনে হিন্দু বিশেষত বাঙালীদের উন্মাদনা তাদের নিজেদের পালা পার্বণের চেয়ে কম নয়। এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, খ্রিস্টানরা তো আমাদের পুজো পার্বণ উদযাপন করে না, তাহলে আমরাই বা কেন এক্সমাস নিয়ে আদেখলাপনা করব? খ্রিস্টান প্রথায় কেক না খেয়ে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির কেক খাব, নকল ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর পরিবর্তে আসল তুলসী গাছের পুজো করব — ইত্যাদি নানা প্রস্তাব ভেসে আসছে। সেই প্রসঙ্গে কিছু মনে এল।

যিশুর জন্মদিনে হিন্দুদের উচ্ছ্বাস নিয়ে রাগ করে লাভ নেই। ইংরেজরা আমাদের দেশ শাসন করেছিল, আমরা ইংল্যান্ড দখল করিনি। বিজেতার সংস্কৃতিই বিজিতের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, উল্টোটার সম্ভাবনা খুব কম। তাছাড়া হিন্দুধর্ম সাম্রাজ্যবাদী ছিল না। হিন্দুরা নিজেদের বিশ্বাস প্রসারের চেষ্টাও করেনি যেটা বৌদ্ধরা অনেকটা করে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অধুনা করেছে ইস্কন।


তাছাড়া আব্রাহামিক মতবাদগুলোর মধ্যে যিশুর বাণী বিস্ময়কর রকম আলাদা। মরূ দেশের সর্বশক্তিমান যেখানে সবাইকে ভয় দেখায়, ‘আমাকে ও আমার পাঠানো দালালকে না মানলেই কিন্তু থার্ড ডিগ্রী–‘, সেখানে যিশু প্রথম বলেন, ‘ঈশ্বর তোমাদের ভালোবাসেন’। প্রেম ও শান্তির এই মনোভাব মনে করা হয় তাঁর ভারত ভ্রমণ ও বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফল। ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে বৌদ্ধদের কিছু সংঘাত হয়ে থাকলেও বৌদ্ধ দর্শন এই দেশের সনাতন সংস্কৃতির আধারেই সৃষ্ট। দয়া, ক্ষমা, শান্তি, প্রেম — কোনওটাই হিন্দু ধর্মের থেকে নতুন কিছু নয়। ধর্ম রক্ষায় যুদ্ধ প্রয়োজন হলে করতে হবে, এটা যেমন ছিল শ্রীকৃষ্ণের বাণী; তেমনি গীতা মন দিয়ে পড়লে অনুভব করা যায়, মানুষকে মোহমুক্ত শান্তি লাভের পথর্নির্দেশ করাই এর লক্ষ্য। সেই দিক দিয়ে দেখলে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট বা যিশুর জন্ম পরবর্তী অধ্যায়ের ওপর আব্রাহামিক সন্ত্রাসবাদ নয়, সনাতনী প্রেম ও শান্তির বার্তার প্রভাবই বেশি।


মিশনারিরা যেমন একদিকে বাইবেলের প্রাচীন অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস প্রচার করে, তেমনি যিশুর প্রেমময় চরিত্র ও তাঁর নিদারুণ পরিণতির কথা বলে মানুষের চোখে জলও এনে দিতে পারে। শুধু প্রথমটা করলে ইসলামের মতোই তাকে বল প্রয়োগ করতে হত। কিন্তু দ্বিতীয়টা করে অর্থাৎ যিশু খ্রিষ্টের জীবন কাহিনী তুলে ধরে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানুষকে আকর্ষণ করতে পেরেছে। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জনসেবামূলক কাজকর্ম করে সহজেই প্রান্তিক মানুষের সমর্থন অর্জন করেছে। এভাবেই তাদের দ্বারা ধর্মান্তকরণ সহজ হয়েছে।


প্রসঙ্গত ধর্ম ও সমাজ পরস্পর প্রভাবিত হলেও সমার্থক নয়। হিন্দু সমাজের কুপ্রথাগুলো কিন্তু মোটেও শাস্ত্রসম্মত নয়। বরং শাস্ত্র সেসব থেকে উত্তোরণের পথই দেখায়।
আর রামকৃষ্ণ মিশনের যিশু পূজো? কী করা যাবে? স্বামীজীকে মঠ প্রতিষ্ঠার সময় বিদেশী খ্রিস্টান মিশনই অনেকটা সাহায্য করেছিল, কোনও হিন্দু প্রতিষ্ঠান নয়। তাই নামটাও রাখতে হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন। লক্ষ্যণীয় সমাপতন, রামকৃষ্ণ মিশন কুমারী পূজোর অন্যতম হোতা। ওদিকে যিশুর মা মেরিকেও বলা হয় কুমারী মাতা। তার আগে আব্রাহামিক ধর্ম গ্রন্থে আদমের বংশ লতিকায় মায়েদের নামগন্ধ নেই একমাত্র আদি মাতা ইভ ছাড়া। ইভ আবার সেখানে পাপিয়সী হিসাবে সনাক্ত। যিশুর বেলাতেই প্রথম মায়ের ভূমিকা বাবার চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। এর পেছনেও ভারতীয় মাতৃপূজার কোনও সম্পর্ক আছে নাকি আমার কষ্টকল্পনা, জানা নেই।

শুরুর প্রসঙ্গে ফিরি। দক্ষিণ ভারতের শিক্ষায়তনগুলোতে খ্রিস্টমাসে সপ্তাহভর ছুটি থাকে না, থাকে পোঙ্গাল বা মকর সংক্রান্তিতে। পশ্চিমবঙ্গে উল্টো। তবে এটাও ঠিক, বড়দিনের কেক বা নিষ্প্রাণ ক্রিসমাস ট্রি কিন্তু বাঙালীর জীবন থেকে পৌষের পিঠে বা সম্বৎসরের তুলসীকে কেড়ে নিতে পারেনি, নিছক একটা বাড়তি আনন্দ ও হুজুকের উপলক্ষ্য হয়ে আছে মাত্র।

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.