জিম্মি, জিজিয়া জিহাদ একটি ধর্মের কুৎসিত ও নির্মম আচার বিচার হিসেবে আমাদের দেশে প্রবেশ করেছিল। জিম্মি ও জিজিয়ার প্রচলন এখন না থাকলেও জিহাদ কিন্তু এখনো নানারকম ছদ্মরূপে তার জাল বিস্তার করে চলেছে।
একটি বিশেষ ধর্মের সঙ্গে এই শব্দগুলি জড়িয়ে আছে— এই ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ। তিনি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার পৌত্তলিক কোরেশ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ইসলামের মূল মন্ত্র হলো—“লা ইলাহা ইল্লাল্লা, মহম্মদুর রসুলাল্লা’ অথাৎ আল্লা ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, মহম্মদ আল্লার রসুল বা পয়গম্বর। এটা যারা মেনে চলেন তারা হলেন মোমেন বা ইমানদার মুসলমান। মুসলমান ছাড়া অন্য সবাই হয় জিম্মি নয় কাফের।
মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী মহম্মদের যখন ৪০ বছর বয়স তখন মক্কা থেকে কিছু দূরে হেরা পর্বতে সাধনা করবার সময় তিনি আল্লার কৃপা লাভ করেন এবং নবিত্ব প্রাপ্ত হন। আল্লার দূত জেব্রাইল নবির কাছে আসেন স্বর্গীয় গ্রন্থ (আসমানী কেতাব) কোরান নিয়ে যেখানে আল্লার নির্দেশাবলী লিপিবদ্ধ করা আছে। মহম্মদ লেখাপড়া জানতেন না বলে জেব্রাইল কোরান থেকে আল্লার নির্দেশাবলী পড়ে শোনান। এইভাবে পরবর্তী ২৩ বছর ধরে মাঝে মাঝেই জেব্রাইল এসে মহম্মদকে আল্লার বাণী বা নির্দেশাবলী পড়ে শুনিয়ে যেতেন। এগুলোকে বলা হয় আল্লার ‘ওহি’ বা আল্লার প্রতাদেশ। মহম্মদ সেইসব প্রত্যাদেশ তাঁর অনুগামী মোমেনদের মধ্যে প্রচার করতেন। তারা সেগুলি চামড়া, পাতা ইত্যাদিতে লিখে রাখত বা স্মৃতিতে ধরে রাখতো। নবি মহম্মদ মারা যাবার পর খলিফা আবু বক্করের সময় এই সমস্ত ওহি লিপিবদ্ধ হয়ে তৈরি হয় কোরান। ইসলাম অনুযায়ী সরাসরি আল্লার বাণী হওয়ায় কোরান অপরিবর্তনীয়। প্রত্যেক মুসলমানকে আল্লার কোরান ও আল্লার রসুলকে বিশ্বাস করতেই হবে। যারা আল্লার কোরান ও আল্লার রসুল মহম্মদকে বিশ্বাস করে না তারা হলো কাফের। আরবি শব্দ কুফর থেকে কাফের। কুফর মানে অবিশ্বাস করা বা বিরোধিতা করা।
ইসলামি তত্ত্ব অনুযায়ী অমুসলমানদের দু’ ভাবে ভাগ করা হয়েছে। জিম্মি আর কাফের। যাদের নিজস্ব পয়গম্বর এবং আসমানি কেতাব বা স্বর্গ থেকে নেমে আসা ধর্মগ্রন্থ আছে তাহা হলো জিম্মি। যেমন ইহুদিদের পয়গম্বর মুসা বা মজেস এবং তাদের আসমানি কেতাব। তৌরাত; আর খ্রিস্টানদের পয়গম্বর যিশু, তাদের আসমানি কেতাব বাইবেল। তাই ইহুদি আর খ্রিস্টানরা হলো ‘জিম্মি’। পৌত্তলিক হিন্দুদের না আছে পয়গম্বর না আছে আসমানি কেতাব। তাই তারা হলো কাফের। ইসলামের চোখে জিম্মিরা নিকৃষ্ট আর কাফেররা নিকৃষ্টতম। ইসলামি শাস্ত্র মতে জিম্মিরা জিজিয়া দিয়ে তাও বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু হিন্দুদের মতো পৌত্তলিক কাফেরদের মাত্র দুটি পথই খোলা আছে— হয় ইসলাম গ্রহণ, না হয় মৃত্যুকে বরণ।
হজরত মহম্মদের নবিত্ব প্রাপ্তির পর থেকে এইরকম সব নিয়মকানুন সংবলিত ওহি (আল্লার প্রত্যাদেশ) জিব্রাইলের মাধ্যমে মহম্মদের কাছে আসতে লাগল; আর তিনি সেইগুলি তাঁর অনুগামী মুসলমানদের মধে প্রচার করতে লাগলেন এবং কঠোর ভাবে তা কার্যকরী করতে লাগলেন। কোরানে লিবিপদ্ধ এই প্রত্যাদেশগুলোকেই কোরানের আয়াত বলা হয়। কোরানের কয়েকটি আয়াত লক্ষ্য করুন— “হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা আল্লা ও তাঁর রসুলে বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লার পথে জিহাদ কর। ইহাই তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর। আল্লা তোমাদের সব পাপ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদের জান্নাতে দাখিল করবেন। ইহাই মহা সাফল্য (৬১/১১-১২)”। “কাফেরদের মধ্যে যারা তোমার নিকটবর্তী তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ওরা তোমাদের কঠোরতা দেখুক (৯/১২৩)”। “কাফেরদের যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদের জন্য ঘাঁটি গেড়ে ওঁত পেতে থাকবে (৯/৫)”। “তাদের হত্যা কর, কিংবা তাদের শূলবিদ্ধ কর, অথবা তাদের হস্তসমূহ ও পদসমূহ বিপরীতক্রমে কর্তন কর, অথবা তাদের দেশ থেকে বহিস্কার কর (৫/৩৩)”।
জিহাদ হলো সেই যুদ্ধ যার মাধ্যমে এই পৃথিবীকে জিম্মি ও কাফের মুক্ত করে আল্লার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা মুসলমানদের পবিত্র কর্তব্য এবং যা করলে তারা অবশ্যই জান্নাতে (স্বর্গে) যাবে। দার-উল ইসলাম হলো সেইসব দেশ যেখানে পুরোপুরি ইসলামিক শাসন কায়েম হয়েছে। দার-উল-হার্ব হলো সেইসব দেশ যেখানে ইসলাম কায়েম করার জন্য লড়াই চলছে। ‘দার-উল-হার্ব’ থেকে ‘দার-উল-ইসলাম’-এ পরিণত করার জন্য নিরন্তর জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে— এটাই ইসলামের শিক্ষা। জিহাদ যারা করে সেইসব আল্লার সৈনিকদের বলে মুজাহিদ বহুবচনে মুজাহিদিন। জিহাদ করলে মুজাহিদিনদের ইহকালে এবং পরকালে দুতরফেই লাভ। ইহকালে জিম্মি ও কাফেরদের মেরে কেটে ধর্ষণ করে ধ্বংস করলে তাদের নারী-সহ ধনসম্পদ (গণিমতের মাল) উপভোগ করা যাবে আর মৃত্যুর পরে জান্নাতে (স্বর্গে) থাকবে অঢেল সুখ ভোগের ব্যবস্থা, এমনকী প্রত্যেকে ৭০ জন করে সুন্দরী হুরি পাবে; তাদের সঙ্গে অনন্তকাল যৌন-আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। এমনই সব লোভনীয় ব্যবস্থার কথা বলা আছে ইসলাম শাস্ত্রে।
নবিত্ব প্রাপ্তির পরে ২৩ বছর ধরে আল্লার প্রত্যাদেশ পেয়ে, তা প্রচার করে এবং কঠোর ভাবে পালন করে আরব ভূখণ্ড থেকে ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য পৌত্তলিক ধর্মসমূহকে পুরোপুরি নির্মূল করে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নবি মহম্মদ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে পরবর্তী খলিফারা ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে ইসলামের রাজত্ব কায়েম করার জন্য উদ্যোগী হলেন।
দ্বিতীয় খলিফা নবির শ্বশুর ওমরের শাসনকালে ৬৩৬ সালে ভারত সীমান্তে আক্রমণ শুরু হয়। প্রায় আট দশক ধরে বারংবার উদ্যোগের ফলে অবশেষে ৭১২ সালে মহম্মদ-বিন-কাসিম ভারতের দেবালয় (আজকের করাচি)-তে প্রবেশ করে। হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে, হিন্দু পুরুষদের হত্যা করে, হাজার হাজার হিন্দু নারী ও শিশুদের লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। তারপরে ১০০০ সালে গজনির সুলতান মামুদ ভারত আক্রমণ করে। মামুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করে। শতশত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে, হাজার হাজার হিন্দু পুরুষদের হত্যা করে, হাজার হাজার হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করে মামুদ। সুন্দরী রমণীসহ প্রায় দু’লক্ষ লোককে ক্রীতদাস বানিয়ে গজনিতে নিয়ে যায় এবং গুজরাটের সোমনাথ মন্দির পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল মামুদ।
মহম্মদ-বিন-কাসিম থেকে মামুদ পর্যন্ত মুসলমান আক্রমণকারীরা ভারত আক্রমণ করেছে, হিন্দু মন্দির ভেঙেছে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছে, হিন্দুদের ধনসম্পদ ও নারী লুটে নিয়ে দেশে ফিরে গেছে। ১১৯২ সালে ভারত আক্রমণ করে মহম্মদ ঘোরি। সে হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করে ভারতে ইসলামি শাসনের প্রবর্তন করে। তারপর একের পর এক মুসলমান বংশ, যেমন— মামলুক, খিলজি, তুঘলক, লোদি বংশ ভারত শাসন করে ইসলামি কানুনে। ১৫২৬ সালে ভারতে মুঘল শাসনের পত্তন করে বাবর। ১৫২৬ সাল থেকে ১৭০৭ পর্যন্ত চলে মুঘল শাসন। তারা প্রত্যেকেই কোরানের নির্দেশে কাফেরের ধর্ম ধ্বংস করে ভারতে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছে।
মুসলমান শাসকরা ভারতভূমিতে ইসলামের শাসন কায়েম করে কাফের হিন্দুদের ক্ষেত্রে কোরানের নির্দেশে ‘হয় ইসলাম গ্রহণ, না হয় মৃত্যুবরণ’ প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখল এতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এতে নতুন সঙ্কট তৈরি হলো। হাজার হাজার একর জমিতে চাষের লোকের অভাব দেখা দিল, খাদ্য সঙ্কট, দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। বাদশা, আমির, ওমরাও, নাজির, উজির, কাজি, মনসবদার ইত্যাদি সমাজের উচ্চবর্গ ব্যক্তিদের বিলাসবহুল জীবনের রসদ উৎপন্ন করার জন্য, এঁদের খিদমত করার জন্য প্রচুর লোকের প্রয়োজন, তার অভাব দেখা দিল। মুসলমান শাসকরা যখন দেখল এই বিরাট দেশ টিকিয়ে রাখার জন্য যে পরিমাণ লোক দরকার তত পরিমাণ হিন্দুদের মেরেকেটে মুসলমান করা যাচ্ছে না, তখন তারা মুসলমান মোল্লা-মৌলবিদের শরণাপন্ন হলো। তারা কোরান হাদিস ঘেঁটে ইসলামের বিধান করলেন। ইসলামের মহান টীকাকার হানিফার মত হলো— ‘হিন্দুদের উপর জিজিয়া চাপিয়ে দাও’। অর্থাৎ পৌত্তলিক কাফের হিন্দুদের অপৌত্তলিক জিম্মি বলে গণ্য করা যেতে পারে। জিম্মিরা জিজিয়া দিয়ে তাদের জানমান, সম্পত্তি, নারী ইত্যাদি রক্ষা করতে পারে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ভারতের অধিকাংশ মুসলমান শাসক একমাত্র আকবর ছাড়া হিন্দুদের উপর জিজিয়া চাপিয়েছে। আমরা পাঠ্য ইতিহাস বইতে জিজিয়াকরের উল্লেখ মাত্র পেয়েছি। বিশদে কিছু জানতে পারিনি। শুধু মাত্র কর প্রদান করলেই হবে না। জিজিয়া কর দিতে হবে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে। বিনয়ের নমুনা হলো এইরকম— জিজিয়া আদায়কারী মুসলমান কর্মচারী যদি তাদের কাছে রৌপ্যমুদ্রা দাবি করে তবে জিম্মিদের উচিত হবে সসম্মানে বিনয়ের সঙ্গে তাদের স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করা। মুসলমান কর আদায়কারী যদি রেগে গিয়ে তাদের দিকে নােংরা ছুঁড়ে মারে তবে তাদের উচিত হবে হাঁ করে সেই নােংরা গিলে ফেলা।
জিজিয়া শুধুমাত্র বিপুল পরিমাণে কর প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এর আওতায় আরও অনেক অমানবিক ও অপমানজনক শর্তাবলীও ছিল যা মান্য করতে হতো। আমাদের পাঠ্য ইতিহাস বইগুলো তা চেপে গেছে। শর্তগুলি ছিল এইরকম— (১) হিন্দুরা কোনো নতুন মন্দির তৈরি করতে পারবে না। (২) মুসলমানরা ভেঙে দিয়েছে এমন কোনো মন্দির তারা মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করতে পারবে না। (৩) কোনো মুসলমান পথিক কোনো মন্দিরে রাত্রিবাস করতে চাইলে তা করতে দিতে হবে। (৪) কোনো মুসলমান কোনো হিন্দুর বাড়িতে থাকতে চাইলে, সুস্থ অবস্থায় তিনদিন এবং অসুস্থ অবস্থায় যতদিন ইচ্ছা আদর-যত্নের সঙ্গে থাকতে দিতে হবে। (৫) কোনো হিন্দুকে মুসলমান করা হলে তাতে বাধা দেওয়া যাবে না। (৬) কোনো মুসলমানকে হিন্দু করা হলে যে কোনো মুসলমান সেই কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের হত্যা করতে পারবে। (৭) সব মুসলমানকে সম্মান দেখাতে হবে, কোনো মুসলমানকে যেতে দেখলে নতজানু হয়ে সম্মান দেখাতে হবে। (৮) হিন্দুদের কোনো নিজস্ব আলোচনায় কোনো মুসলমান ইচ্ছে করলে উপস্থিত থাকতে পারবে। (৯) কোনো হিন্দু মুসলমানের মতো পোশাক পরতে পারবে না। (১০) সব সময় তাদের হীন পোশাক পরে থাকতে হবে। (১১) মোহর লাগানো যায় এমন কোনো আংটি তারা পরতে পারবে না। (১২) ঘোড়ার পিঠে গদি লাগিয়ে চড়তে পারবে না। (১৩) তারা কোনো অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে করতে পারবে না; আত্মীয়স্বজন মারা গেলেও জোরে কাঁদতে পারবে না। (১৪) তাদের সামাজিক উৎসবাদি মুসলমানদের মধ্যে ছড়াতে পারবে না। (১৫) হিন্দুদের মৃতদেহ মুসলিম কবরখানার কাছে আনতে পারবে না। (১৬) হিন্দুরা মুসলমান এলাকায় বাস করতে পারবে না। (১৭) তারা কোনো অস্ত্র বহন করতে পারবে না। (১৮) তারা কোনো মুসলমানকে ক্রীতদাস রাখতে পারবে না ইত্যাদি। এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রায় ৮০০ বছর ধরে মুসলমান শাসনে আমাদের পূর্বপুরুষদের কী অসহনীয় গ্লানিময় নিম্নশ্রেণীর পরাধীনতার জীবনযাপন করতে হয়েছে।
প্রণব দত্ত মজুমদার
2019-04-21