হিন্দু সাম্রাজ্য দিনোৎসব–প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা

জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী , ১৭৩১ বিক্রমসম্বত, ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ৬ জুন, ১৬৭৪ সাল
ছত্রপতি শিবাজি (Chhatrapati Shivaji) মহারাজের ‘হিন্দভী স্বরাজে‘র রাজধানী রায়গড় দুর্গে ভারতীয় ও বিদেশীয় বিপুল সংখ্যক পুরুষ ও মহিলার জমায়েত হয়েছে। মহাপণ্ডিত গাগা ভট্ট এর পৌরোহিত্যে পুরোহিতদের দল যখন বৈদিকমন্ত্র উচ্চারণে আকাশ-বাতাস মুখরিত করলো তখন তারা সকলেই আনন্দে মেতে উঠলো। শিবাজী নিজের গুরু রামদাস স্বামী এবং মাতা জীজা বাঈকে বন্দনা করে তাঁদের আশীর্বাদ গ্রহণ করলেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী এবং কামরূপ থেকে কচ্ছ পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতবর্ষের একতার ইঙ্গিতবাহী পাঁচটি পবিত্র নদী গঙ্গা-সিন্ধু-যমুনা-গোদাবরী-কৃষ্ণা ও কাবেরী এবং সমুদ্রের জল ছিটিয়ে আজ অভিষিক্ত হচ্ছেন শিবাজী মহারাজ।সদ্য ‘ছত্রপতি’ উপাধি তে ভূষিত, রাজ-মুকুট পরিহিত শিবাজী মহারাজের মাথার ওপরে স্বর্ণাভ , অগ্নিবর্ণ ‘ছত্র’ শোভা পাচ্ছে। এই দিন যেন সম্পূর্ণতা পেল শিবাজীর এক দুর্মর প্রতিজ্ঞা –‘এক ধর্মরাজ্য পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি’।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাজ্যাভিষেকের এই দিনটিই ‘হিন্দু সাম্রাজ্য দিনোৎসব’ হিসেবে পালিত হয়।

শিবাজি নিজের অসাধারণ যুদ্ধ কুশলতা ও নেতৃত্বের দ্বারা ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পশ্চিমের এক বিস্তৃত জমি ও সম্পদ অর্জন করেছিলেন। কিন্তু একটি আনুষ্ঠানিক খেতাব না থাকায় তিনি এখনও মুঘলদের অধীন এক জমিদার বা একজন আদিলশাহী জায়গীরদারের পুত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তাই গাগা ভট্ট শিবাজীর ক্ষত্রিয়ত্ব প্রমাণে এবং তার আদিপুরুষরা যে সূর্যবংশীয় চিতোরের মহারাণার বংশ তা লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন এবং অভিষেকক্রিয়ায় নিজে প্রধান পুরোহিত হিসেবে কাজ করতে সম্মত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন পর ঔরঙ্গজেবের কারাগার থেকে সফলভাবে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে নিজেকে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে এই রাজ্যাভিষেকের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। শিবাজী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পরে প্রথম স্বাধীন হিন্দু রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন

ভারতীয় ইতিহাসে শিবাজী মহারাজের আগমনের সময় দাক্ষিণাত্য মুঘলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়েছে। শক্তিশালী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে। হিন্দু রাজাদের মধ্যে কোনো ঐক্য ছিল না। ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করে ব্যাপকভাবে মন্দির ধ্বংস , জিজিয়া করের প্রত্যাবর্তন ও হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করছিলেন। ভারতবর্ষের বাইরের পৃথিবী যখন নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে ,ইউরোপ দারিদ্র ও ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে বের হতে শুরু করেছে তখন ভারতবর্ষ তমসাচ্ছন্ন।ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের দ্বারা তক্ষশীলা, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হওয়ার পর দীর্ঘকাল মুঘল শাসকদের দ্বারা একটিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় নি।মুঘল শাসকদের জন্য একইসাথে হিন্দু ধর্ম ও ভারতবর্ষের গৌরবময় জ্ঞানচর্চার চূড়ান্ত অবনতি হচ্ছিল। অন্যদিকে পর্তুগিজ,ইংরেজ,ডাচ সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতি বানিজ্যের অজুহাতে ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য মুখিয়ে ছিল।

শিবাজি মহারাজের রাজ্যাভিষেক কেবল শিবাজি মহারাজের পক্ষে বিজয়ের বিষয় নয়। মুহম্মদ-বিন্-কাশিমের কাবুল আক্রমণ থেকে শুরু করে শিবাজী মহারাজের রাজত্বের সময় অবধি এই দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজকে রক্ষার জন্য ও জাতির সার্বিক অগ্রগতির জন্য যে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল তা বারবার ব্যর্থ হয়ে পড়েছিল। রাজারা বৈদেশিক শত্রুর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছিলেন, বিভিন্ন ধরণের কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছিল, সাধু-সন্ন্যাসীরা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এবং নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখতে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছু তাৎক্ষণিকভাবে সফল হলেও, দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য ভারতবর্ষের কোথাও দৃশ্যমান ছিল না। এই সমস্ত পরীক্ষার ও প্রচেষ্টার চূড়ান্ত সফল পরিসমাপ্তি হ’ল শিবাজী মহারাজের রাজ্যাভিষেক। যুদ্ধকারী হিন্দু জাতি তার শত্রুদের উপর বিজয় অর্জন করলো

এর আগেও ভারতবর্ষের ওপর বৈদেশিক আক্রমণ অনেক হয়েছে কিন্তু এ এক নতুন ধরণের বর্বর শক্তি এসেছে, যারা কেবল ক্ষমতা দখল এবং সম্পত্তি লুট করেই সন্তুষ্ট হয় না, যারা মানুষের জীবনচর্চা , দর্শন বদলে তাকে ভেতর থেকে পরিবর্তন করে দিতে চায় আর যারা এই পরিবর্তনে অনিচ্ছুক তাদের ভবিতব্য মৃত্যু। এই আগ্রাসনকারীদের হাত থেকে ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান সহনশীলতা, শান্তি ও অহিংসার দর্শন কে রক্ষা করা এবং এই ধর্ম-ধ্বংসকারীদের পরাভূত করার প্রায় পাঁচশ বছরের প্রচেষ্টার এক সফল উপায় শিবাজি মহারাজের রাজ্যাভিষেকের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল

শিবাজি মহারাজের উদ্যম দেখার পরে সকলেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে যদি এরকম কোনও ব্যক্তি থাকেন যার নেতৃত্বে হিন্দু সমাজ, হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি পুনরায় অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারে, তবে তিনি শিবাজি মহারাজ
দেশপ্রেমিক কবি ভূষণ , ঔরঙ্গজেবের স্তুতি গাইতে অস্বীকার করে সুদূর দক্ষিণে শিবাজীর কাছে এসেছিলেন এবং তিনি শিবাজি মহারাজের স্তুতি শিবরাজ-ভূষণ, শিবা-ভবানী শুনিয়ে প্রশংসিত হন। ঔরঙ্গজেব তাকে নিজের প্রশংসা করে গান গাওয়ার আদেশ করলে তিনি সরাসরি এই বৈদেশিক , ধর্মে আঘাতকারী শাসকের স্তুতি করতে অসম্মত হন। শিবাজী-চরিত্রে প্রভাবিত চারণকবি ভূষণ এর কবিতা মহারাষ্ট্রে আজও ধ্বনিত হয়।

কেবলমাত্র মহারাষ্ট্রের লোকেরাই অনুভব করেন নি যে শিবাজির রাজা হওয়া প্রয়োজন। মহারাষ্ট্রের সাধু-সন্ন্যাসী ছাড়াও ,কাশির বিশ্বেশ্বর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখে দুঃখে ভারাক্রান্ত কাশীর ঐতিহ্যবাহী পুরোহিত পরিবারের বংশধর গাগা ভট্টও অনুভব করেছিলেন যে দেশের মন্দিরগুলি কে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে একমাত্র শিবাজীই পারেন। উনি নাসিক থেকে তাঁর শিবাজির সাথে দেখা করার সময় পর্যন্ত শিবাজি মহারাজ সম্পর্কে সমস্ত তথ্য শুনে এবং নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দ্বারা শিবাজী সম্পর্কে সন্তুষ্ট হয়ে শিবাজি মহারাজ কে বলেছিলেন, ‘তোমাকে সিংহাসনাধীশ হতে হবে‘।

শিবাজির রাজ্যাভিষেকের ফল শুধুমাত্র মহারাষ্ট্র পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজস্থানের সমস্ত রাজপুত রাজারা অন্তর্কলহ ছেড়ে দুর্গাদাস রাঠোড়ের নেতৃত্বে নিজস্ব দল গঠন করেন এবং শিবাজী মহারাজের সিংহাসনারোহণের কয়েক বছরের মধ্যেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে সমস্ত বিদেশী আগ্রাসককে রাজস্থান ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তার পরে আর কোনও মোঘল বা তুর্কীরা শাসক হিসেবে রাজস্থানের মাটিতে পা দিতে পারে নি।
ছত্রশাল প্রত্যক্ষভাবেই শিবাজির থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তাঁর বাবা চম্পত রায় এর সময় পর্যন্ত মুসলমান শাসকদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছিলো। শিবাজি মহারাজের কার্যপদ্ধতি সরাসরি দেখে ছত্রশাল শিক্ষা নিয়ে বুন্দেলখন্ডে ফিরে গিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সেখানে স্বধর্মের সাম্রাজ্য তৈরি করেন। আসামের রাজা চক্রধ্বজ সিং বলতেন, ‘শিবাজীর নীতিতে চলে আমি এই আসামে কোনও আক্রমণকারীকে ঢুকতে দেব না।’ সেই মতোই ব্রহ্মপুত্র থেকেই আক্রমণকারী দের ফিরে আসতে হয়েছিল। আসাম কখনই মুঘলদের দাস হয় নি
কোচ-বিহারের রাজা রুদ্রসিংহ শিবাজীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লড়াই করেছিলেন ও সফল হয়েছেন। শিবাজি মহারাজের রাজ্যাভিষেক সমগ্র হিন্দু জাতির কাছে একটি বার্তা ছিল যে এটিই বিজয়ের পথ। এই পথে এগিয়েই ভারতবর্ষে স্বরাজ স্থাপন সম্ভব।

শিবাজি মহারাজ তাঁর ব্যক্তিগত খ্যাতি, সম্মানের জন্য ক্ষমতা দখল করতে চাননি। শিবাজী স্বার্থপরতার দ্বারা বশীভূত হলে,যখন ছত্রশাল দেশসেবার জন্য তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করতে এসেছিলেন, তাকে বলতেন না যে “আপনি কারো চাকর কেনো হবেন?” ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করে অন্য রাজার সেবা কেন করবেন? আপনার নিজের রাজত্ব তৈরি করুন। ” সমস্ত ছোটো রাজ্যগুলোকে গ্ৰাস করে আরো বড় রাজা হওয়া শিবাজীর উদ্দ্যেশ্য ছিল না।

লিসবন এর পর্তুগিজ আর্কাইভে গোয়ার গভর্নর এর একটি চিঠি রয়েছে যা শিবাজীর লক্ষ্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণা দেয়।গোয়ার রাজ্যপালের এক কর্মচারী শিবাজী মহারাজের এক দুর্গরক্ষক রাওজি সোমনাথ পাতকির আত্মীয় ছিলেন। তিনি রাওকে জিজ্ঞাসা করলেন, শিবাজী মহারাজ এত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন কেন? সুখে, শান্তিতে বাঁচতে পারেন, তাঁর উদ্দেশ্য কী? পাতকি শিবাজি মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মহারাজ, আমরা এত কষ্ট সহ্য করে এই সব করছি, এখন তো আমরা স্বরাজ পেয়ে গেছি।আমাদের পুনার জাগীরটি খুব ছোট ছিল, কিন্তু এখন এটি অনেক প্রসারিত হয়েছে, এখন আমরা আর কি করবো? ” শিবাজি মহারাজ জবাব দিলেন “শুনেছি, সিন্ধু নদীর পার থেকে কাবেরীর দক্ষিণ তীর পর্যন্ত আমাদের ভূমি। বিদেশিদের এ অঞ্চল থেকে তাড়াতে হবে এবং তারা যে মন্দিরগুলি ভেঙে ফেলেছে , সেগুলি কে পুনরুদ্ধার করাই আমাদের লক্ষ্য” । রাওজি সোমনাথ এর আত্মীয়ের মাধ্যমে শিবাজীর উত্তর গভর্নর এর কাছে পৌঁছে গেল এবং তিন লিসবনে চিঠি লিখলেন। শিবাজীর লক্ষ্য ছিল , সমস্ত হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির সর্বাঙ্গীন উন্নতি।

তিনি তাঁর ব্যক্তিগত খ্যাতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। বিজাপুরের আদিলশাহ ১৬৫৯ সালে শিবাজী কে পরাস্ত করতে যখন আফজাল খান কে পাঠালেন , শিবাজী আফজলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে প্রতাপগড় দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে আফজলের এতো হাতী,কামান ও সৈন্যের সঙ্গে সমতলে লড়াই করা অসম্ভব। আফজলের সৈন্যরা যখন মন্দিরকে অপবিত্র করছিল, গ্ৰামের পর গ্ৰাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তখন শিবাজীর অপেক্ষারত সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে আলোচনা করতো “বড় বড় কথা বলা শিবাজী এখন কোথায় ?সে তো পালিয়েছে”।এইসব অপবাদ শিবাজি কে বিচলিত করেনি।কারণ খ্যাতি অর্জনের লোভ তাঁর ছিল না, তিনি একটি নির্দিষ্ট রণকৌশল মাথায় রেখে সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন।সন্ধি করার অছিলায়, আফজল খাঁ শিবাজীর সঙ্গে সাক্ষাতে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করলে, দীর্ঘদেহী আফজল কে শিবাজী ‘বাঘনখ’ দিয়ে বিদ্ধ করে অপরাধীর ভবলীলা সাঙ্গ করেন।

শিবাজীর আগমনের আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের খুব সহজ-সরল , ধার্মিক যুদ্ধনীতি বৈদেশিক বর্বরদের শঠতার কাছে পরাজিত হচ্ছিল। শিবাজী মহারাজ এই যুদ্ধনীতির পরিবর্তন করে ধর্মের বিজয়ের জন্য ‘মহাভারতের যুদ্ধে শ্রী কৃষ্ণের’ পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। শত্রুর ছলনার জবাব ছলনা দিয়েই দিতে শুরু করলেন।তোর্না দুর্গ হাতছাড়া হওয়াতে ক্ষুদ্ধ বিজাপুরের আদিলশাহ শাহাজী রাজে কে বন্দি করলে, শিবাজী ঔরঙ্গজেবের সাহায্য প্রার্থনা করে বলেন যে , “আমরা আপনার একনিষ্ঠ সেবক হয়ে , আপনার সীমান্ত সুরক্ষায় কর্তব্যরত।আদিলশাহ আমাদের অযথা বিরক্ত করছেন”। তিনি মুঘলদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাহাজীর মুক্তির জন্য আদিলশাহ কে চাপ দিতে বলেন।শাহাজী মুক্তি পেলেন কিন্তু এর মধ্যেই শিবাজী মহারাজ একের পর এক গ্ৰাম দখল করতে থাকেন। নিজের গতিশীলতা ও সাহসিকতা দিয়ে শিবাজী গেরিলা যুদ্ধপদ্ধতি কে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বিপদসংকুল ও দূরগামী অভিযানে তিনি নিজে নেতৃত্ব দিতেন।

শিবাজি হলেন প্রথম রাজা যিনি সমুদ্রপথেও শক্তিশালী হওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । উপকূলীয় সীমান্ত কে মুঘলরা গুরুত্ব দেয় নি এবং ফলস্বরূপ ইংরেজ ও পর্তুগিজরা সেখানে শক্তিশালী হচ্ছিল। কোঙ্কন জয় করার পর শিবাজী ১৬৫৭-৫৮ সালে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনে নজর দেন। শিবাজী তাঁর উপকূলীয় নৌবাহিনী কে রক্ষার জন্য এবং পর্তুগিজদের ক্রিয়াকলাপে নজর রাখতে পদ্মদুর্গ, বিজয়দুর্গ, সুবর্ণদুর্গ, সিন্ধুদুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। শিবাজী কে ‘ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক’ বললে অত্যুক্তি হবে না।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ শুধু স্বশাসন নয়, সুশাসন স্থাপনেও নজিরবিহীন। সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনার জন্য প্রাচীন হিন্দু রাজাদের ঐতিহ্য অনুসরণ করে শিবাজী অষ্টপ্রধান মন্ডল তৈরি করেছিলেন যার মধ্যে একজন পেশোয়া , একজন হিসাব-রক্ষক বা মজুমদার,একজন সেনাপতি, আধ্যাত্বিক প্রধান বা পন্ডিত রাও, একজন ন্যায়াধীশ, একজন মন্ত্রী ও সচিব ছিলেন। সেইসময় রাজকার্যে ফার্সী ভাষার চল থাকলেও, শিবাজী রাজকার্য পরিচালনার কাজে মারাঠী ভাষার প্রচলন শুরু করেন

শিবাজী মহারাজ তৎকালীন সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় যে কোনো রকমের পরিবর্তন করতে পিছপা হন নি। তিনি নেতাজি পালকার,বাজাজী
নিম্বালকার কে স্বধর্মে ফিরিয়ে এনেছিলেন।শুধু তাই নয়, সমাজ যেন তাদের পুনরায় গ্ৰহণ করে , তার জন্য ওনাদের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। হায়দ্রাবাদের কুতুব শাহের সঙ্গে এই মর্মে সন্ধি করেন যে , তার দরবারে প্রথম দুই মন্ত্রী হিন্দু হতে হবে এবং তার রাজ্যে যেন হিন্দু প্রজাদের ওপর কোনো অত্যাচার না হয়।কাশির বিশ্বেশ্বর মন্দির ভাঙ্গার জন্য ঔরঙ্গজেব কে সাবধান করে চিঠি লেখেন। হিন্দু সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে ব্রতী হলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি শিবাজীর কোনো বৈরিতা ছিল না। তাঁর স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনী তে কর্মরত মুসলিম সেনাপ্রধানরা শিবাজীর প্রতি অনুগত ছিলেন। ঔরঙ্গজেবের সমকালীন ঐতিহাসিক কাফি খানের মতে , শিবাজী কোনোদিন কোনো মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত করেন নি। এমনকি কোথাও মুসলিমদের ধর্মগ্ৰন্থ উদ্ধার করলে তা মুসলমান সৈনিকদের হাতে তুলে দিতেন। শিবাজী মহিলাদের প্রতি সম্মানজনক ব্যবহার করতেন আর কেউ সম্মানহানি করলে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতেন

শিবাজী মহারাজের ৫০ বছরের জীবনকাল কঠোর পরিশ্রম ও অধ‌্যাবসায়ের মাধ্যমে হিন্দু জাতির আত্মবিশ্বাস জাগ্ৰত করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যয়িত হয়েছিল। তিনি মোঘলদের অনবরত যুদ্ধে ব্যতিব‌স্ত করে , ভারতবর্ষে তাদের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অবস্থার অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতায়—–
তার পরে শূন্য হলো ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ নিবিড় নিশীথে দিল্লিরাজশালা—
একে একে কক্ষে কক্ষে অন্ধকারে লাগিল মিশিতে দীপালোকমালা।
শবলুব্ধ গৃধ্রদের ঊধ্বস্বর বীভৎস চীৎকারে মোগলমহিমা।
রচিল শ্মশানশয্যা–মুষ্টিমেয় ভস্মরেখাকারে হলো তার সীমা
।”
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার নিজের ‘শিবাজী’ বই তে শিবাজীর জন্য ঔরঙ্গজেবের ভোগান্তি বুঝিয়েছেন এই ভাবে—“পারস্যের রাজা দ্বিতীয় শাহ আব্বাস আওরঙ্গজীব কে ধিক্কার দিয়া পত্র লিখিলেন(১৬৬৭)– “তুমি নিজেকে রাজার রাজা(শাহানশাহ বাদশাহ) বল আর শিবাজীর মত একটা জমিদারকে দুরস্ত করিতে পারিলে না। আমি সৈন্য লইয়া ভারতবর্ষে যাইতেছি তোমাকে রাজ্য-শাসন শিখাইব।” শিবাজীর স্মৃতি কাঁটার মত আওরঙ্গজীবের হৃদয়ে আমরণ বিদ্ধ ছিল। মৃত্যুর পূর্বে বাদশাহ পুত্রের প্রতি যে শেষ উপদেশ লিখিয়া যান তাহাতে আছে-“দেশের সব খবর রাখায় রাজকার্যের সর্বপ্রধান অঙ্গ। এক দন্ডের অবহেলা বহুবর্ষব্যাপী মনস্তাপের কারণ হয়। এই দেখ , অবহেলার জন্য হতভাগা শিবাজী আমার হাত হইতে পলাইল ,আর তাহার ফলে আমাকে আমরণ এই পরিশ্রম ও অশান্তি ভোগ করিতে হইল।”

প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে , শিবাজী একজন আদর্শ জাতীয় নায়ক হিসেবে পাঞ্জাব থেকে তামিলনাড়ু , গুজরাত থেকে আসাম পর্যন্ত বিভিন্ন বিপ্লবীর মননে , জাতীয়তাবাদী লেখকের লেখনীতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।১৮৯৬ সালে লাহোরে প্রকাশিত হয় লালা লাজপত রায়ের লেখা শিবাজীর জীবনী

বাংলাতেও শিবাজীর আদর্শের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল।১৮৭৬ সালে , বঙ্গদর্শন পত্রিকায় শিবাজীর জীবনের উপর আধারিত প্রবন্ধ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে।আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত , ‘অনুশীলন সমিতি’র প্রাণপুরুষ ,ঋষি অরবিন্দের ভাই বিপ্লবী বারিন্দ্রকুমার ঘোষ ‘শিবাজীর দীক্ষা‘ নামক বই রচনা করেন। স্বদেশী আন্দোলনের আবহে ১৯০৬ সালে লোকমান্য তিলক , বিপিন চন্দ্র পাল , অশ্বিনী কুমার দত্তের উপস্থিতিতে কলকাতায় অনুষ্ঠিত শিবাজী উৎসবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতাটি পাঠ করেন।

উনিশ শতকের শুরুতে ‘লাল-বাল-পাল’ ত্রয়ী , যে স্বদেশনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ শিবাজীর আদর্শে জারিত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত ছিলেন , স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নিজের ‘Glimpses of World History’ তে শিবাজির সেই মহাকাব্যিক জীবনকে ‘Predatory Career’ বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। অন্যদিকে তিনি বর্বর মাহমুদ গজনিকে একজন অসাধারণ সেনানায়ক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন ভারতবর্ষে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের শিক্ষামন্ত্রকের ইতিহাস-পাঠ্যক্রমে শিবাজী উপেক্ষিত হলেন এবং মোঘল-তুর্কী-আফগান দের মহিমান্বিত করা হলো।
শিবাজীর এইরকম অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিবাজীর উৎসব’ কবিতায় বলেছেন….

“অয়ি ইতিবৃত্তকথা, ক্ষান্ত করো মুখর ভাষণ।
ওগো মিথ্যাময়ী,
তোমার লিখন-‘পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন
হবে আজি জয়ী।
যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে
তব ব্যঙ্গবাণী?
যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে
নিশ্চয় সে জানি।
হে রাজতপস্বী বীর, তোমার সে উদার ভাবনা
বিধির ভাণ্ডারে
সঞ্চিত হইয়া গেছে, কাল কভু তার এক কণা
পারে হরিবারে?”

বর্তমান ভারতবর্ষের দুইদিকে যখন দুই ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবাধিকার হননকারী রাজনৈতিক মতবাদ নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে, এমতাবস্থায় বিশ্বের দরবারে ভারতীয়দের এক আত্মনির্ভর ও শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে নিজের গৌরবময় ইতিহাস , সনাতনী সংস্কৃতি ও দর্শন এর প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগ্ৰত হওয়া প্রয়োজন।সেই সনাতনী সংস্কৃতি , কর্মযোগ এর এক মূর্ত রূপ শিবাজী মহারাজ।ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিবাজী মহারাজের গুনাবলী এক সংঘবদ্ধ সমাজ তৈরিতে আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। শিবাজীর মাতৃভক্তি, ইন্দ্রিয়-সংযম,ধর্মানুরাগ , শ্রমশীলতা পারিবারিক জীবনেও অনুকরণীয়। হিন্দু সাম্রাজ্য দিনোৎসব পালনের মধ্য দিয়ে শিবাজী মহারাজের গুনাবলী প্রত্যেক ভারতীয়ের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে , কবিগুরুর ভাষায় আমাদের আশা
এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে” ।।

পিন্টু সান্যাল (Pintu Sanyal)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.