তাঁর লেখা ‘এ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমেস্ট্রি ফর্ম দ্য আর্লিয়েস্ট টাইমস্ টু দ্য সিক্সটিনথ্ সেনচ্যুরি’ রসায়নের উৎবর্তন নিয়ে দেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য দলিল। এই বইতে তিনি লিখে গেছেন ভারতে রসায়নের বিকাশের ইতিহাস। চার যুগেই তিনি ধরে ফেলেছেন গোটা রসায়নবিদ্যার চর্চাকে। প্রথম যুগের শুরু বৌদ্ধ পূর্ব যুগ থেকে। শেষ ৮০০খ্রীষ্টাব্দে। চরক, সুশ্রুত, বাগভট্ট এই যুগের গ্রন্থ। দ্বিতীয় যুগ ৮০০থেকে ১১০০খ্রীষ্টাব্দ অবধি। বৃন্দ ও চক্রপাণি এই যুগের রচনা। তৃতীয় যুগ বিস্তার ১১০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৩০০খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়ের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ রসার্ণব। চতুর্থ যুগ ১৩০০থেকে ১৫৫০খ্রীষ্টাব্দ। রসরত্নসমুচ্চয় এই যুগের প্রামাণ্য গ্রন্থ। পরে এই বইটিকে বাংলায় অনুবাদ করেন ভবেশ চন্দ্র রায়। নাম দিয়েছিলেন ‘হিন্দু রসায়নী বিদ্যা’। ১৯৩২সালে নিজের বৈজ্ঞানিক জীবনের উপলব্ধি নিয়ে লেখেন ‘লাইফ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স অব এ বেঙ্গলি কেমিস্ট’।
হিন্দু কেমেস্ট্রি’র প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯০২সালে। ১৯০৯সালে দ্বিতীয় খন্ড। প্রফুল্লচন্দ্র আর একটা যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন তা হলো ভারতে চিরসমৃদ্ধ রসায়ন তথা বিজ্ঞানচর্চার অধঃপতন কারণ নির্ণয় করা। কেন পিছিয়ে পড়লাম তা নির্ণয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। তিনি বাঙালির বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন জাত-পাতের। তিনি বলেছিলেন হাতে-কলমে বিজ্ঞান চর্চা সবচেয়ে বড় বাধা এই জাতি বিভেদ। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রই সম্ভবত একমাত্র ভারতীয় বিজ্ঞানী যিনি হাতের কাজের সঙ্গে মাথার কাজের দ্বন্দ্বের সম্বন্বয় সাধনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কায়িক শ্রমকে যারা অপমাণ করেন তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই বিরোধিতা করে একটি আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। তিনি দেখিয়েছিলেন কতটা ধর্মান্ধ হলে শল্য চিকিৎসা পড়তে যেতে সঙ্কোচ করতেন উচ্চবর্ণের হিন্দু ছেলেরা। শল্য চিকিৎসার সরঞ্জাম তৈরি করে নিম্নবর্ণের কামার, মৃতদেহ অন্তজ’রা ছোয় বলেই এত বিভেদ। এমনকি রাজাবাজার ক্যাম্পাসের ছাদের হাড় শুকিয়ে কম খরচে ক্যালসিয়াম করতে গিয়ে বারেবারে বিপাকে পড়তে হয়েছে আচার্যকে।
অনেকে বলে থাকেন বাঙালী এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তাঁর যোগ্য সম্মান পান নি। এটা বোধহয় কারো কারো আক্ষেপ। প্রফুল্লচন্দ্র জীবনের শেষা অর্ধে দাঁড়িয়েও কোনদিন এবিষয়ে আক্ষেপ করে নি। তাঁর পরবর্তী সময়র ছায়াসঙ্গী অসীমা চট্টোপাধ্যায় অকপটে সেকথা জানিয়েছেন। তিনি আজ নেই। তবু তাঁর নামকে সামনের রেখে দাপটের সঙ্গে কারিগরী শিক্ষায় নবীনদের উৎসাহ করতে কাজ করে আসছে যাদবপুরে এ পি সি রায় পলিটেকনিকস্। তাঁর নামেই তৈরি হয়েছে উত্তর ২৪পরগনার নিউব্যারাকপুরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ। আর নিজের তৈরি বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডতো রয়েছেই। কীভাবে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের মারফত রাজ্যের শিল্পায়নের ধারাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা করেছিলেন তা এখন ইতিহাস। ১৮৮৩সালে তৈরি হয় বেঙ্গল ক্যামিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের শিল্পোদ্যোগের প্রমাণ হিসাবে শুধু বেঙ্গল কেমিক্যাল নয় বেঙ্গল পটারি, বেঙ্গল এনামেল, বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি একই সঙ্গে তাঁর সাক্ষী বহন করছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৬১সালের ২রা আগস্ট আধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার রারুলি-কাটিপাড়া গ্রামে। বাবা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন জমিদার। বালক প্রফুল্লচন্দ্রের প্রাথমিক লেখাপড়া করেন গ্রামের স্কুলে। পরে পরিবারসহ চলে আসেন কলকাতায়। পড়াশুনা শুরু করেন হেয়ার স্কুলে। ১৮৭৯সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেট্রোপলিট্যান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। এই সময়তেই বিদ্যুতের আবিষ্কর্তা বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের আত্মজীবনী ‘কাইট এক্সপেরিমেন্ট’ তাঁকে খুব প্রভাবিত করে।
১৮৮৯সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। তাঁর উদ্যোগে প্রেসিডেন্সি কলেজে তৈরি হয় অত্যাধুনিক রসায়নাগার। এডিনবড়া ফেরত বিজ্ঞানী তাঁর দেখাকে পুরোদস্তুর এই রসায়নাগার তৈরিতে কাজে লাগিয়েছিলেন। সেখান থেকে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার ক্যাম্পাসে। এখানেই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়েছেন। অবিবাহিত এই বিজ্ঞানী তাঁর জীবনের সবটাই বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন।
তখন ১৯২০সাল। নাগপুরে বসেছে জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন। সেই সময়ে সারা ভারতের সেরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিবিদদের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করলেন কে ? আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সভাপতি হিসাবে তাঁর অভিভাষণের ছিল দারুন চমকপ্রদ। তিনি দেশীয় বিজ্ঞানের নবোদয় কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে বিজ্ঞান চর্চা আমাদের জাগতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য হলেও ভারতীয় যুবসমাজের জন্য এর একটা বাড়তি গুরুত্ব আছে। সেই সময়ে দেশের শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশটা ধমকে গেছিল। বিজ্ঞানকে দূরে রেখে ভবিতব্য, কলাবিদ্যা আশ্রয়ী কলা বিভাগের প্রতি অদম্য টান এই প্রধান কারক। এই পরিস্থিতি সামলাতে ইংরাজী শিক্ষার প্রয়োজন ছিল।
সেকালের বিজ্ঞানীদের মতো প্রফুল্লচন্দ্র কোনদিনই দেশ বিদেশ নিয়ে তেমন প্রতিবাদী হননি। তিনি প্রাচ্যবাদী এবং প্রতীচ্যবাদীদের তর্কে না ঢুকে বরাবরই ব্রিটিশ বিজ্ঞান শিক্ষার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শিক্ষাকে ‘আত্মস্থ’ করার পরামর্শ দিয়েছেন। শিক্ষা যে ভাষার বা যে দেশেরই হোক না কেন, তিনি চাইতেন তা লাগুক দেশ ও দশের প্রয়োজনে।
বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের উৎপত্তি প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছেন — ইউরোপে শিল্প ও বিজ্ঞান পাশাপাশি চলিয়াছে। উভয়েরই একসঙ্গে উন্নতি হইয়াছে। একে অপরকে সাহায্য করিয়াছে। ইউরোপের এডিনবরায় পড়াশোনা করার সময় প্রফুল্লচন্দ্র কেমিক্যাল সোসাইটি’র সদস্য হয়েছিলেন। সেই সূত্রে তিনি ঘুরে দেখেছেন বিদেশের প্রচুর রাসায়নিক কারখানা। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাসায়নিক কারখানাগুলির বিশালতা তাকে মুগ্ধ করেছিল। দেশে ফিরে কলকাতার আশেপাশে কার্তিক চন্দ্র সিংহ, মাধব চন্দ্র দত্ত, এস কে লাহাদের অ্যাসিড তৈরির কারখানা দেখে আচার্য মনে মনে ব্যাথা পেতেন। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে এত কম উৎপাদন যে ভবিষ্যত পর্যন্ত কোন কারখানাকে নিয়ে যাবে না তা প্রফুল্লচন্দ্র রায় আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই প্রযুক্তিকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিতেন।
প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর গবেষণাকে বরাবরই ফলিতমুখী করতে চেয়েছেন। তাঁর গবেষণাগারে স্বদেশী শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টায় রত ছিলেন। সহজলভ্য স্ক্র্যাপ আয়রন কাজে লাগিয়ে সালফেট অফ আয়রন উৎপাদনের দিকে তিনি প্রথমেই আকৃষ্ট হন। কারণ তিনি জানতেন কলকাতায় এর ভালো বাজার আছে। দেশীয় পদ্ধতিতে তিনি সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরির নকশা করেছিলেন। পাতিলেবুর রস থেকে সাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদনের জন্য সচেষ্ট হন। কিন্তু কলকাতার বাজারে পাতিলেবুর পর্যাপ্ত জোগানের অভাবে তাঁকে এই প্রচেষ্টায় বিরত হতে হয়। রাজাবাজার ক্যাম্পাসে থেকে গবাদি পশুর হাড় দিয়ে রকমারী রাসায়নিক বানানো পরিকল্পনা একমাত্র প্রফুল্লচন্দ্রের পক্ষেই করা সম্ভব। হাড় থেকে ফসফেট অব সোডা এবং সুপার ফসফেট অব লাইম উৎপাদনে একদা তিনি যত্নবান হন। কিন্তু তাতেও সমস্যা দেখা দেয়। কারণ বাড়ির ছাদে ওই হাড় শুকানোয় আপত্তি জানায় প্রতিবেশীরা। এরপর তিনি মানিকতলা অঞ্চলে কিছুটা ফাঁকা জমি সংগ্রহ করে সেখানে কাজ শুরু করেন। সেখানেও মূর্তিমান পুলিসের তাকে মৃতদেহ পাচারকারী বলে সন্দেহ করতে থাকে। এর থেকে বোঝা যায় গবেষণাগার এবং জীবনযাপনের বন্দোবস্ত হয়েও কেন আমরা শিল্প করার ক্ষেত্রে বারংবার ভাবি। তবু শিল্প গড়াতে তিনি দেশীয় শিল্পেরই পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানের গবেষণাগারকে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করা না গেলে তা জাতির অর্থনৈতিক অগ্রগতির কাজে লাগবে না। গবেষণাগারে থেকে ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। তিনি বইয়ের সারবত্তাকে জ্ঞানের জন্যও নয় খোদ জীবিকার সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। প্রাণের চেয়ে প্রিয় রসায়নকে তিনি দেশের মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য রেখে গেছেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল সেই পরিচয়ই বহন করে।
খোদ ইংল্যান্ডের বুকে বসে এই মানুষটা শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ বিরোধিতা। তখন সালটা ১৮৮৫। এডিনবরার ছাত্র। এক রচনা প্রতিযোগিতায় তিনি লিখলেন ‘ইংল্যান্ড বিফোর অ্যান্ড আফটার দ্য মিউটিনি’ নামে এক প্রবন্ধ। ঐ লেখায় তীব্র ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক নীতিকে আঘাত করলেন তিনি। সেই শুরু। এরপরে দেশে ফিরে ছাত্রদের মধ্যে দিয়ে তিনি চিরকাল পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন।
তাঁর প্রিয় ছাত্র প্রিয়দারঞ্জন রায় এক লেখায় জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে নতুন ক্লাসে এসেছি। নতুন অধ্যাপক আসছেন, বিদেশে পড়াশুনা। সবাই তটস্থ। লম্বা, সুদর্শন দেখতে অধ্যাপক হবেন নতুন অধ্যাপক এসে কেমনতর সাহেবী কেতা দেখাতে শুরু করবেন। ইতোমধ্যে এলেন একজন শীর্ণকায় মানুষ। পরনে কুমিল্লার কটন মিলের কাপড়ে তৈরি অতি সাধারণ গলাবন্ধ কোট। সবাই ভাবলো— নতুন অধ্যাপকের কোনো সহকারী হবেন বোধহয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিই যখন রোল কল করতে শুরু করলেন তখন ভুল ভাঙলো সবার। বিলেত ফেরত অধ্যাপকের নিখাদ দেশীয়ানা আরও ফুটে উঠলো যখন ইংরাজীর সঙ্গে বাংলাতেও পড়াতে লাগলেন তিনি। বিস্মিত হলো ছাত্ররা যখন সেই অধ্যাপক বিজ্ঞানচর্চার ইউরোপীয় ইতিহাসের সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসও মেশাতে শুরু করলেন। এই মানুষটাই সাহিত্য পরিষদের মাসিক অধিবেশনে পাঠ করেন এক নিবন্ধ যার শিরোনাম— চরক ও সুশ্রুতের সময় নিরূপণ। এই অনুসন্ধানে তিনি মহাভারত থেকে ত্রিপিটক কোনো সংশ্লিষ্ট গ্রন্থকেই বাদ দেন না। ‘দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’ লিখতে গিয়ে তোলপাড় করে ফেলেন বৈদিক যুগ, তান্ত্রিক যুগ, আয়ুর্বেদের যুগ, আধুনিক যুগ প্রভৃতি সময়কালকে। সেই তিনিই আবার গবেষণা অধ্যাপনা তুলে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন খুলনার বন্যাত্রাণে যখন শতসহস্র আর্ত দেশবাসীর কান্না তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ করে। সেই কাহিনী জানার পর বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না যে তিনি আদ্যন্ত দেশী একজন মানুষ, একজন খাঁটি ভারতীয়।
প্রফুল্লচন্দ্র বহুমাত্রিক। একজন মানুষের মধ্যে এতরকম গুণ বা উদ্যোগের প্রকাশকে ব্যাখ্যা করা ইতিহাসবিদ্ বা চিকিৎসক কারো পক্ষেই বোধহয় সহজ নয়। সমসাময়িক বিজ্ঞানী যেমন জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখের সঙ্গে তাঁর মিল যেমন অনেক, অমিলও প্রচুর। বাংলার বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে একটা চমৎকার বিষয় দেখা যায়। উনবিংশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে নাম করা অনেক বিজ্ঞানীই ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের। জগদীশচন্দ্র, তাঁর ভাগ্নে দেবেন্দ্রমোহন, ডাক্তার নীলরতন সরকার, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ এমন অনেকেই। ব্রাহ্ম ধর্মের কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতা এবং ব্রাহ্ম সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহ নিশ্চিতভাবেই এঁদের সাফল্যের পথে এগিয়ে দিয়েছিল। এ সত্ত্বেও এই সব সফল বিজ্ঞানীদের মধ্যে বৈদান্তিক ভাববাদ বেশ শিকড় গেড়েছিল। প্রফুল্লচন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেও নিজের মানসিকতাকে ভীষণভাবে বস্তুবাদী করে তুলেছিলেন। অন্য প্রমাণের কথা বাদ দিলেও বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর টান এবং ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সঙ্গে তাঁর মিতালি এর উৎকৃষ্ট নির্দশন। বিদ্যাসাগর ডঃ জে আর ব্যালান্টাইনের সঙ্গে লড়ে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বেদান্ত এবং বার্কলের ভাববাদী দর্শনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দের সহপাঠী ব্রজেন্দ্রনাথ ছিলেন আদ্যপান্ত বস্তুবাদী। তিনি তো ব্রাহ্ম ধর্ম ত্যাগই করেছিলেন বিজ্ঞানের জন্য। ফলে এই দুই মণীষীর ভাবশিষ্য বা সহমর্মী প্রফুল্লচন্দ্রকে উপনিষদের মায়া সেভাবে বাঁধতে পারেনি। তাঁর রচনায় ছত্রে ছত্রে ঝরে পড়েছে বস্তুবাদের প্রতি আস্থা। সেটাই পরিণতি পেয়েছে যখন তিনি লিখেছেন ‘আ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’। ভারতীয় সমাজের বিজ্ঞান চর্চায় যে অধঃপতন, তাকে তিনি যুক্ত করেছিলেন বর্ণাশ্রমের সঙ্গে। সমাজের উচ্চবর্ণ যখন কায়িক শ্রমকে হীন মনে করতে শুরু করলো, মস্তিষ্কের চর্চাকে বিচ্ছিন্নভাবে মহান করে তুললো— তখনই শুরু হলো বিপর্যয়। নিম্নবর্ণের মানুষজন প্রচলিত কারিগরি ব্যাপারটা ঠিকঠাক চালিয়ে নিলেও যে কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল তাদের মধ্যে। ফলে নতুন বিজ্ঞান তৈরি হলো না ভারতীয় সমাজে, থমকে রইলো প্রযুক্তি। উচ্চবর্ণের মানুষ যাগযজ্ঞ, ঈশ্বর ভাবনা, ভাববাদে গা ভাসানোর ফলে এগোতে পারল না বিজ্ঞানের গবেষণা। এটা নতুন করে বলার কোনও বিষয় নয় যে প্রফুল্লচন্দ্রের এই দু’খণ্ডের ইতিহাস গ্রন্থ গবেষণার গভীরতা এবং বিশ্লেষণে আজও অতুলনীয়। তথ্যের অপূর্ব সমাবেশের কথা যদি ছেড়েও দিই তাহলেও উজ্জ্বল হয়ে থাকবে হাত ও মস্তিষ্কের বিচ্ছেদের তত্ত্বটি এবং তার ফলস্বরূপ বিজ্ঞানের অধঃপতনের করুণ কাহিনী। অথচ কী আশ্চর্য, প্রফুল্লচন্দ্রেরই এক প্রিয় ছাত্র ওই গ্রন্থের এক সংস্করণের সম্পাদনা করতে গিয়ে বাদ দিয়ে দিলেন এই গুরুত্বপূর্ণ অংশকেই ! একে স্পর্ধা বলব, না ভারতীয় সমাজকে শেকল পরানো মায়াবাদের প্রতি আজন্ম ভক্তি হিসাবে দেখবো ?
প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনের এই দিকটাকে আর একটু বিস্তারিত করলে হয়তো পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না। এটা প্রয়োজন মহান বিজ্ঞানীর মনের দ্বন্দ্বকে বুঝতে। ‘দ্য ব্রাহ্ম সমাজ অ্যান্ড দ্য শেপিং অব দ্য মডার্ন ইন্ডিয়ান মাইন্ড’ গ্রন্থে ডেভিড কফ মন্তব্য করেছেন যে, বিজ্ঞানের অবদানে প্রগাঢ় আস্থাশীল হয়েও প্রফুল্লচন্দ্র ধর্ম থেকে বিশ্বাস সরাননি। এমনকি এক প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, বিজ্ঞান গবেষণার একটা সীমা আছে। যেমন মহাজাগতিক সব বস্তুর চলাচলকে অভিকর্ষের ফলাফল বলে মেনে নিলেও অভিকর্ষ জিনিসটা যে কী তা তো বোঝা হয় না, মন্তব্য করেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। বোঝা যায়, প্রফুল্লচন্দ্রের সময় আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের যে শৈশব অবস্থা ছিল তাতে পুরোপুরি বিজ্ঞানকেই তিনি আঁকড়ে ধরতে পারেননি। আজ নিশ্চয়ই পারতেন যখন দেখতেন ইউরোপে লক্ষ কোটি ডলার ব্যয়ে, মাইলের পর মাইল জুড়ে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার বসেছে পদার্থের ভরের রহস্য খুঁজতে। তিনিই হয়তো কলাম ধরতেন হিগ্স বোসনের অনুসন্ধানকে স্বাগত জানাতে। এ বিশ্বাস আমাদের আছে কেননা নিজের জীবনে অতি সহজে তিনি পেরিয়ে গেছেন বিধিনিষেধের বেড়া। একে শুধু ব্রাহ্ম মত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। ক্লাস ঘরে হাড়ের গুঁড়ো মুখে পুরে ছাত্রদের বলেছেন— এই তো আমি মুখে দিলাম, এতে কি আমার জাত গেল ! শরীরের জৈবিক সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া হাড় বা তা পুড়িয়ে গুঁড়ো করা পদার্থকে নেহাতই তার রাসায়নিক পরিচয়ে জানতেন, চেনাতেন তিনি। এতটাই বস্তুবাদী হতে পেরেছিলেন !
আমাদের গর্বের পরিচয় হোক না কেন, সব ভারতীয় তো আর আচরণে, দৃষ্টিভঙ্গিতে এক নন। প্রফুল্লচন্দ্র আলাদা ছিলেন। আমরা উচ্ছ্বসিত হই বেঙ্গল কেমিক্যালের কথা বলতে গিয়ে। সোচ্চারে বলি, দেখো কীভাবে আমাদের ব্যবসা শিখিয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র! কিন্তু নেহাত জাতির মনে ব্যবসাপ্রীতি ঢোকাবেন বলে তো তিনি বিলিতি ওষুধের রমরমা বাজারে দেশী ওষুধের প্রচার চালাননি। বন্ধু ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু থেকে শিষ্য রাজশেখর বসুকে নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠানকে বড় করেছিলেন বাঙালীকে অর্থলোলুপ করার জন্য নয়। আজ তাই বাঙালীর ব্যবসামুখীনতার আলোচনায় যখন তখন প্রফুল্লচন্দ্রের নামকে টেনে আনাটা অসঙ্গত। তিনি চেয়েছিলেন যুগ যুগ নির্ভরতার মোহে আচ্ছন্ন একটা জাতিকে বলিষ্ঠ, স্বনির্ভর, সাহসী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে। রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো হঠাৎ শখে ব্যবসা করেননি তিনি। প্রতিযোগিতার নিয়কানুন বুঝে, বাজারের প্রভূত সমীক্ষা করে তিনি ব্যবসাতে নেমেছিলেন। কিন্তু অন্তরে তিনি সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞানী, তাই বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসকে বহুবার অসৎ পথে চলা থেকে আটকেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। হয়ত সব ক্ষেত্রে সফল হননি।
এর মধ্যেই যেন ধরা রয়েছে প্রফুল্লচন্দ্রের চরিত্র। অবশ্যই আজকের ব্যবসায়িক শেখানো ছকে বড়ই বেমানান। প্রফুল্লচন্দ্র বলতেন, ব্রিটিশ এদেশে আসার আগে হাজার বছরের সময়কালে আমরা ছিলাম উদ্যোগহীন, শাস্ত্রমুখী— ঠিক এই জায়গা থেকেই আধমরা সেই জাতকে ঘা মেরে বাঁচার পক্ষে ছিলেন আচার্য।
পেরেছিলেন কি? ২০০১সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রায় সবক’টা বাংলা দৈনিকে এই মর্মে একটা খবর ছিল যে ফের খুলতে চলেছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি লিমিটেড। ১৯৯৪সাল থেকে বন্ধ ছিল এই কারখানা। রাজ্যের শিল্প পুনর্গঠন দপ্তর সাতষট্টি লক্ষ টাকার এক পুনরুজ্জীবন প্রকল্প তৈরি করে বাঁচায় কারখানাকে। গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রফুল্লচন্দ্র কয়েকজন ঘনিষ্ঠকে নিয়ে এই কারখানা তৈরি করেছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নড়বড়ে হয়ে গেল সে কারখানা। ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৩, তাঁর স্মৃতি বিজড়িত অন্য এক কারখানা, ‘বেঙ্গল পটারিজ লিমিটেড’ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস (পরে নাম পরিবর্তিত) ধুঁকতে ধুঁকতে অবশেষে সরকারের সহায়তায় বেঁচে ওঠে। আজ সে সংস্থার অতি বড় শুভাকাঙ্ক্ষীও মনে হয় বলবেন না যে কোম্পানির অবস্থা দুর্দান্ত। এই সব উদাহরণের ব্যাখ্যা কী? গোড়ায় গলদ না উত্তরাধিকারের অপব্যবহার? আচ্ছা বেশ, না হয় মেনে নিলাম যে সমাজ অর্থনীতি বাণিজ্যের স্বাভাবিক নিয়মে দুর্বল হয়ে গেছে প্রফুল্লচন্দ্রের তৈরি আদি প্রতিষ্ঠানগুলি। কিন্তু তাঁর শিক্ষা, তাঁর স্পিরিট? সেগুলিও কি কালের প্রবাহে হীনশক্তি হয়ে গেল, যোগ্য আধার না পেয়ে বিলীন হলো? তা যদি না হবে তবে উদ্যমী, সাহসী, সৎ বাঙালী শিল্পপতি একটা বিরল প্রজাতি কেন? খুঁজে পাই না কেন এমন কিছু বাঙালী কারখানা মালিককে যাঁরা নিজের উদ্ভাবনের জোরে যথেষ্ট মুনাফা করেন, সমাজের প্রয়োজন মেটান অথচ কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে অর্থ সরান না!
ব্যবসার শিক্ষা না হয় প্রফুল্লচন্দ্রের বহুমাত্রিকতার একটা মাত্রা কেবল। গবেষণার কথা বলি তবে! ১৯২৪সালে তিনি ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অনেক আশা নিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানের তরফে একটি সাময়িকী ছাপানো হতো। নানা ধরণের গবেষণাপত্র এখানে প্রকাশিত হতো। অন্যরা যাতে বাঙালি বিশেষত কলকাতার বিজ্ঞানীদের বিশিষ্ট গবেষণা পড়ে উৎসাহিত বোধ করেন তাই ছিল প্রফুল্লচন্দ্রের উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তবিকী আমাদের দেশের জার্নালে নিজের প্রথম সারবত্ত গবেষনাকে প্রকাশ না করে বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশকে অনেক মোক্ষ লাভ বলে মনে করেন। একটু ভাবলে দেখা যায় এখনো ব্রিটিনের ‘নেচার’ বিজ্ঞান পত্রিকা যতটা জনপ্রিয় সেই সময় ছিল, এখনো তাই আছে। আমাদের সেই একমাত্র বিজ্ঞান পত্রিকাটি কালের যাত্রায় শেষ হয়ে গেছে।
স্বয়ং প্রফুল্লচন্দ্রকে স্মরণ করার ক্ষেত্রেও আমাদের ঔদাসীন্য এবং শিথিলতা এক মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ১৯৬১সালে রবীন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মের একশো বছর পূর্তি হয়। পালিত হলো কেবল রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ। তাঁর রচনা-গান-নাটক ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রশংসনীয় উদ্যোগ দেখা গেল সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রে। প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে উচ্চারিত হলো না একটা কথাও। ১৯৮৬সালে তাঁদের জন্মের একশো পঁচিশতম জয়ন্তীতেও ব্যাপারটা একই থাকলো। সার্ধশতবর্ষে এসে কোথায় যেন একটা ক্ষীণ গ্লানিবোধ জেগে উঠেছে আমাদের মধ্যে। কিছু একটা করা দরকার প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে। বহু ব্যাপারে একটা কথা ব্যবহার করি আমরা— সময়ের থেকে এগিয়ে। প্রফুল্লচন্দ্র কি সময়ের থেকে এতটাই এগিয়েছিলেন যে তাঁকে যথার্থ মর্যাদায় স্মরণ করতে আমাদের এত বছর লেগে গেল?
আরও একটা বিষয় রয়েছে এখানে। একান্ত নিজের কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকলে কেমন যেন মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে মনীষীদের কথা মানুষের মধ্যে বলার আগ্রহ দেখা যায় না। ‘বিশ্বভারতী’ ছিলো বলেই রবীন্দ্রনাথের অমূল্য লেখাগুলি নির্ভুল ছাপার অক্ষরে নিয়মিতভাবে পেয়েছি আমরা। বাঙালী বিজ্ঞানীদের মধ্যেও অনেকেই নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রেখে গেছেন। ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকারের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স, জগদীশচন্দ্র বসুর বসু বিজ্ঞান মন্দির, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। প্রত্যেক বছর প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে এই সব প্রতিষ্ঠানে কিছু না কিছু অনুষ্ঠান হয়, বিভিন্ন সময় নানা প্রকাশনা তুলে ধরে প্রতিষ্ঠাতার আদর্শ। প্রফুল্লচন্দ্র এক্ষেত্রে বড় অসহায়। সাধারণভাবে দেখতে গেলে তাঁর স্মৃতির সঙ্গে জড়িত কত প্রতিষ্ঠান— বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে কেমিক্যাল সোসাইটি, বিজ্ঞান কলেজ থেকে অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানকেই তিনি একান্ত নিজের বলে আঁকড়ে থাকেননি। তাই প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানই তাঁর হয়েও যেন তাঁর নয়। ফলে সেভাবে তাঁর কথা কেহ তো বলে না! ট্র্যাজেডি এখানেই।
অন্যভাবেও দেখা চলে এই ট্র্যাজেডিকে। অনন্য ইতিহাসকার প্রফুল্লচন্দ্র। ফরাসী রসায়নবিদ বার্থেলোর অনুরোধে হাত দিয়েছিলেন ভারতীয় সমাজে রসায়ন চর্চার ইতিহাস লিখতে। নিজের কৃশ শরীরকে আরও কৃশ করে তিনি উপহার দিয়েছিলেন দুটো অমূল্য রত্ন— দুখণ্ডে ‘দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’। বিশ্বের ইতিহাস চর্চার ভাণ্ডারে এর তুলনা মেলা ভার। এখানেই শেষ নয়। অজস্র উদাহরণ রয়েছে সেখানে নিজের অনুসন্ধানের পাশাপাশি তিনি অন্যকে উৎসাহিত করেছেন বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায়। তাঁরই উৎসাহে অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন— ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’। আবার প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যোগেশ চন্দ্র বাগল তাঁর ‘মুক্তির সন্ধানে ভারত’ গ্রন্থের ভূমিকা লেখার জন্য অনুরোধ জানান প্রফুল্লচন্দ্রকেই। রচনার কথা যদি ছেড়েও দিই, ইতিহাস সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা কে অস্বীকার করবে! ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে জনসমক্ষে নিয়ে এসেছিলেন কে? আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রই। গান্ধীজীর প্রথম বক্তৃতা কলকাতার টাউন হলে, ১৯০২সালে, তাঁরই উদ্যোগে। এত সব সত্ত্বেও বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস চর্চায় তিনি চূড়ান্ত অবহেলিত। এমন ইতিহাস স্রষ্টাকে বিস্মৃত হওয়া একে কোন পর্যায়ের ট্র্যাজেডি বলব?
ফলিত রসায়ণ — প্রেসিডেন্সি কলেজে নতুন গবেষণাগার তৈরির পর থেকে আচার্য যেখানে নানা ধরণের গবেষণা শুরু করেন। জানলে অবাক হতে হয় তা সবগুলো সাধারণ মানুষের একান্ত প্রয়োজনীয়। প্রথমে তিনি ঘি আর সর্ষের তেলের ভেজাল নির্ণয়ে সচেষ্ট হন। সে সময়ে বাজারে প্রায়শই ভেজাল ঘি আর সর্ষের তেল বিক্রি করা হতো। ভেজাল খাবার তাঁকে বরাবরই খুব পীড়া দিতো। তিন বছর ধরে গবেষণার পর প্রফুল্লচন্দ্র খোঁজ দিলেন ঘি’তে সাধারণত বনস্পতি অথবা আলুসিদ্ধ ভেজাল হিসাবে মেশানো হয়ে থাকে। সর্ষের তেলের মূলত শেয়াল কাঁটার বিচির তেল (যা আরিজিমোন তেল নামে পরিচিত) মেশানো হয়। তিনি পরীক্ষা চালিয়ে দেখিয়েছেন কলকাতায় কী কী অপদ্রব্য মেশানো হয়ে থাকে। এছাড়া তুলোর বিচির তেল, নানারকম খনিজ তেলেও মেশানো হয়ে থাকে। রকমারী ভেজাল নিয়ে আচার্যের শ্রমসাধ্য গবেষণাটি ১৮৯৪সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে খাদ্যে ভেজাল নিয়ে সচেতনা তৈরি হয়।