পোশাকের উদ্দেশ্য শুধু লজ্জা নিবারণ নয়। এটি একটি জাতি হিসাবে, একটি জাতিগত গোষ্ঠী হিসাবে, একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে যে কোনো মানুষের অনন্য পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। যদিও প্রতিটি মানুষের আলাদা জাতীয়, জাতিগত এবং ধর্মীয় পরিচয় আছে, তারা যখন একটি সংগঠনে এক ছাদের নীচে একত্রিত হয়, একটি অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে বা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একসাথে পড়াশোনা করে, তখন তাদের পৃথক জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয়কে দূরে সরিয়ে রাখা আশু প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় কারণ এ ক্ষেত্রে তাদের একমাত্র পরিচয় হল তারা যে সংস্থার জন্য কাজ করে বা যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা পড়াশোনা করে তখন তারা কেবলমাত্র সেই সংস্থা বা সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বা ছাত্র/ছাত্রী |
ঠিক এই কারণেই বিদ্যালয়ে uniform পরা বাধ্যতামূলক – uniform, যা একজনকে শুধুমাত্র সেই বিদ্যালয়ের বিদ্যার্থী হিসেবে চিহ্নিত করে। বিদ্যালয়ে শিক্ষারত অবস্থায় বিদ্যার্থীর অন্য কোনও পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয় বা সেই পরিচয়টিকে ব্যক্ত করার প্রয়োজনও নেই – জাতি, ধর্ম, প্রাদেশিক পরিচয় বা তার ধর্ম নির্বিশেষে, বিদ্যালয়ে তার একমাত্র পরিচয় হল যে সে বিদ্যার্থী |
Uniform শব্দটির অর্থ হলো সমতা| এটি অর্থনৈতিক, বর্ণ, ধর্ম এবং আঞ্চলিক সমস্ত বিভাজন মুছে দিয়ে সকল শিক্ষার্থী কে এটি অনুভব করতে সাহায্য করে যে তারা তাদের শিক্ষকদের কাছে সমান এবং অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা বা নিকৃষ্ট। এটি শিক্ষা প্রদানকে সহজতর করে কারণ সমস্ত শিক্ষার্থী তাদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থানের জন্য কোনোরকম অস্বস্তির শিকার না হয়ে শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে| তাদের সমস্ত অর্থ -সামাজিক বিভেদ একটি uniform পরিধানের মুছে গেছে কারণ এই uniform টি সবার জন্যই এক | ঠিক এই এক ই কারণে কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা তাদের কর্মচারীদের জন্য uniform পরিধান করা বাধ্যতামূলক করেছে এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট ও সবচেয়ে বিখ্যাত হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (RSS) খাকি প্যান্ট ও সাদা শার্ট|
আমাদের দেশের শিক্ষারতীরা সর্বদা গর্বের সাথে, কোন প্রকার সংকোচ বা বিরক্তি ছাড়াই ইউনিফর্ম পরিধান করে এসেছে | তাই কর্ণাটকের সাম্প্রতিক ঘটনা, মুসলিম সম্প্রদায়ের ছাত্রীদের হিজাব পরে বিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য জোর দেওয়ার বিষয়টি দেশের বেশিরভাগ মানুষকেই হতবাক করেছে | তাদের দাবি হলো যে তাদের ধর্মচারণ করতে গেলে হিজাব পরাটা জরুরী এবং সেই কারণে এটি পরিধান করে তাদের বিদ্যালয়ে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হোক | এর ছাড়াও তারা বলে যে গণতান্ত্রিক দেশে তাদের স্বেচ্ছায় নিজেদের পোশাক বেছে নেবার অধিকার আছে | তাই হিজাব পরাটা নাকি তাদের অধিকার |
কর্নাটকে এই সমস্যার সূত্রপাত ঘটে বিগত মাসে যখন উডুপির একটি সরকারি কলেজের ৬ জন ছাত্রী হিজাব পরে কলেজে যাওয়া শুরু করে কিন্তু কলেজ কতৃপক্ষ যখন তাদের বারণ করে তারা প্রতিবাদ শুরু করে | কর্ণাটক সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমস্ত শিক্ষার্থী কেই সরকারি দ্বারা ধার্য পোশাক পরেই যেতে হবে | কিন্তু সেই ছাত্রীরা নিজেদের ইচ্ছামতো পোশাক পরিধান করার অধিকারের কথা বলে প্রতিবাদ করা অব্যহত রাখে | এর পরে কর্নাটকের চিগমাগ্লুরেও একটি কলেজে ছাত্রীরা hijab পরে যাওয়া শুরু করে | সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এর হেনো অনমনীয় মনোভাবে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ কিছু হিন্দু শিক্ষার্থী এদের এই মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেরুয়া উত্তরীয় পরে কলেজে প্রবেশ করে | এ ধরণের অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধে এমন অভিনব প্রতিবাদের মুখে পড়তে হবে তা হয়তো ওই সংখ্যালঘু ছাত্রীগণ আশা করেনি কারণ এর যাবৎ তারা বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে বিভিন্ন সুবিধা দাবি করে প্রতিবাদ হয়েছে যেমন CAA আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যা বিধ্বংশী আকার ধারণ করে | কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটলো যার কারণ হতে পারে যে সে রাজ্যের হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘুদের এ হেনো আচরণের ফলে একটি বিষয় পরিষ্কার ভাবে মরমে পোষিয়ে নিয়েছে যে এমন আবদার দেখেও চুপ করে থাকলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে | প্রতিবাদ ও পাল্টা প্রতিবাদে ঘটনাটি সারা দেশে সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমের নজর কাড়লো এবং শুরু হলো একটি দেশ ব্যাপী তর্ক – শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের এর ধরণের স্বেচ্ছাচারিতা কি গ্রহণযোগ্য?
উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে এটা যেনে নেওয়া জরুরী যে হিজাব আসলে কি – হিজাব হল একটি পর্দা যা মস্তক ও বক্ষ কে আবৃত করে |
মুসলিম মহিলারা তাদের পরিবারের বাইরের কোনো পুরুষের উপস্থিতিতে এটি পরিধান করে থাকেন | কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলিম পুরুষরাও এটি পরিধান করে থাকে | অপরিচিত ও অনাত্মীয় পুরুষদের সম্মুখে শালীনতা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য মুসলিম মহিলারা হিজাব পরিধান করে। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম অ্যান্ড মুসলিম ওয়ার্ল্ড অনুসারে, পুরুষ এবং মহিলাদের উভয়েরই “দৃষ্টি, চালচলন, পোশাক এবং যৌনাঙ্গ কে আবৃত করার বিষয়ে শালীনতা প্রদর্শন অতিশয় আবশ্যক। কোরান মুসলিম নারী ও পুরুষ উভয়কেই শালীন পোশাক পরার নির্দেশ দেয়।
কোরানের ৬০০০ টি আয়াতের মধ্যে অন্তত ৬ বার পোশাক পরিধানের বিষয়ে শালীনতা বজায় রাখার বিষয়টি উল্লিখিত আছে, যদিও এর ক্ষেত্রে খিমার শব্দটি কে ব্যবহার হয়েছে এবং হিজাব শব্দটি ব্যবহার হয়েছে একটি বিভাজন সৃষ্টিকারী বস্তু যা মানুষকে পরম ঈশ্বরের থেকে আলাদা করে বা শুধুমাত্র একটি পর্দা হিসেবে | এই পোশাক সংক্রান্ত বিষয়টির সব চেয়ে পরিষ্কার উল্লেখ দৃষ্ট হয় সুরা ২৪: ৩১ এ|
“ মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের গোপনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য ও অলংকার প্রদর্শন না করে, যা (সাধারণভাবে)প্রদর্শনীয় নয় ; তারা যেন তাদের স্তনের উপর তাদের খিমার টানে এবং তাদের স্বামী, তাদের পিতা, তাদের স্বামীর পিতা, তাদের পুত্র, তাদের স্বামীর পুত্র, তাদের ভাই বা তাদের ভাইয়ের পুত্র , বা তাদের বোনের পুত্র বা কোনো নারী, বা তাদের বিশ্বস্ত ক্রীতদাস, বা শারীরিক চাহিদা মুক্ত পুরুষ দাস, বা ছোট শিশু যাদের যৌনতার বোধ নেই – এদেরকে ব্যতিরেকে অন্য কোনো পুরুষের সম্মুখে তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তাদের লুকানো অলঙ্কারগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাদের পায়ে আঘাত যেন না করে | ”
কোরান – ২৪: ৩১
অন্যদিকে এটাও আমাদের জানা দরকার যে বোরখাটি কি | বোরখা হলো মুসলিম মহিলাদের একটি পরিধান যা তাদের পা থেকে মাথা অব্দি সমস্ত শরীর ঢেকে রাখে| শুধু চোখ দুটো খোলা থাকে | আরব দেশগুলিতে এর নাম বশীয়া |এর থেকে একটি ব্যাপার পরিষ্কার যে বোরখা ও হিজাব দুটো এক নয় – হিজাবের কাজ হলো শুধু মাথা ও বক্ষ ঢেকে রাখা, বোরখা ঢাকে পুরো শরীর |
এই দুই ধরণের বস্ত্রের মধ্যে তফাৎটা হয়তো অনেকের ই অজানা – তাই অনেকেই হয়তো এটা খেয়াল করেনি যে প্রতিবাদরত ছাত্রীগণ কিন্তু বোরখা পরে রয়েছে, হিজাব নয় | এর ফলে ওরা হিজাব পরার জন্য আন্দোলন করছে, নাকি বোরখা পরার জন্য, নাকি হিজাবের নাম করে, অতি চালাকির সাথে তারা বোরখা পরার অনুমতিটি ই করিয়ে নিতে চাইছে, সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে | কোরান অনুযায়ী পুরুষ এবং নারী, উভয়ের ক্ষেত্রেই হিজাব পরার বিধান আছে, তাহলে কেবলমাত্র নারীদের হিজাব পরার অধিকার নিয়ে এত তোলপাড় কেন হচ্ছে | এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য – সেটা হলো এই যে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্যামেরুন, চাদ, চীন, ডেনমার্ক, গ্যাবন, লক্সেমবর্গ, নেদারল্যান্ডস, রুশ, সেনেগাল, শ্রীলংকা, সুইজারল্যান্ড- এর
মতো দেশগুলিও কিন্তু বোরখা এবং নাকাব (এমন এক |বস্ত্র যা মাথা থেকে মুখ অব্দি ঢেকে রাখে) উভয় কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে | এ নিয়ে এই সমস্ত দেশে কোনোরকম বৃহত্তর আন্দোলন বা প্রতিবাদ হয়েছে বলে শোনা যায় নি |
সব চেয়ে বেশী চমকপ্রদ বিষয় হলো যে আমাদের ই দেশে, কেরল রাজ্যে মুসলিম এডুকেশনাল সোসাইটি, যা একটি কেরল -ভিত্তিক মুসলিম প্রগতিশীল সংগঠন এবং ওই রাজ্যের এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় 150টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, তারা এপ্রিল ২০১৯ এর একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে তাদের সমস্ত প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করে।এর ও এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে, কেরলের মহামান্য উচ্চ আদালত সমস্ত শিক্ষার্থীদের পোশাক পরিধানের বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে, এই নিরিখে রায় দ্যায় | এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পরে হিজাব বা বোরখা পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে | কিন্তু এ বিষয়ে ও পড়শী রাজ্য কেরলে কোনো রকম সাড়া শব্দ শোনা যায় নি| কর্ণাটকের মুসলিম জনসংখ্যা হলো ৭৮.৯৩ লক্ষ যা ওখানকার মোট জনসংখ্যার ১২.৯২% এবং কেরলের মুসলিম জনসংখ্যা হলো ৮৮.৭৩% যা ওই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৬.৫৬%| এই পরিসংখ্যান মনে একটি প্রশ্নের উদ্রেক করে যে কেরলে যেহেতু কর্ণাটকের তুলনায় ওদের জনসংখ্যা অনেকটা বেশী তাই কেরলে ওদের নিরাপত্তাহীনতা বোধ কর্ণাটকের তুলনায় কম এবং সেই কারণেই কি কেরলে ওরা কোনো ধরণের আন্দোলন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না? এটি একটি কারণ হতে পারে বই কি | কিন্তু এই অদ্ভুত আবদার ও আন্দোলনের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে, যা পুরোটাই রাজনৈতিক, এর সাথে ধর্মাচরণের কোনো সম্পর্ক নেই ।
কেন্দ্রে শাসন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের জন্মলগ্ন থেকে অভিন্ন দেওয়ানি নীতির পক্ষে সওয়াল করে এসেছে | বেশ কিছুদিনের ধরেই চাপা গুঞ্জন চলছে যে কেন্দ্র সরকার শীঘ্রই এই নিরিখে একটি আইন প্রণয়ন করতে চলেছে | বলাই বাহুল্য যে বর্তমান কেন্দ্র সরকারি তিন তালাক নামক অত্যন্ত গর্হিত একটি প্রথাকেও আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করেছে | একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, যে খানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে, সেখানে সকল কে এক করতে গেলে, নিজস্ব সম্প্রদায়ের থেকে বেশী জাতীয় স্বার্থ কে অধিকার প্রাধান্য দিতে গেলে এবং এই বৃহৎ দেশের বিশাল জনসংখ্যার উপর সুনিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তাদের আইনি ভাবে এক ছাতার তলায় আনাটা আশু প্রয়োজন এবং এই কারণেই আজ দেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও মৈত্রীর উদ্দেশ্যে অভিন্ন দেওয়ানি নীতি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে |
অভিন্ন দেওয়ানি রীতি চালু হলে দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য বৃদ্ধি পাবে যা দেশের শত্রুদের জন্য একটি বড়ো দুসংবাদ | তাই এভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কে খেপিয়ে তুলে তাদের আন্দোলনের মুখে ঠেলে দিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে দেশের বাইরের এবং ভেতরের শত্রুরা | দু বছর আগে CAA বিরোধী আন্দোলন, যা আরেকটু বৃহৎ আকার ধারণ করেছিল, সেটাও এক ই উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল – দেশে অরাজকতা সৃষ্টি | এর পেছনে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক ডল গুলির প্রচ্ছন্ন উস্কানি আছে বই কি | কংগ্রেসের নেতৃবর্গ এবং ওই দলটির অলিখিত ‘মালিকপক্ষ’, গান্ধী পরিবারের দুই সদস্য – রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা ভাড্রা কে হিজাবের পক্ষে এত আক্রমণাত্মক সওয়াল করতে দেখে এই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় | প্রিয়াঙ্কা ভাড্রা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক বা অন্য কোনো স্থান সকলের নিজের পছন্দ মতো পোশাক পরার অধিকার আছে, তা সেটা হিজাব হোক বা বিকিনি | এ হেনো বিতর্কিত ও বালখিল্য মন্তব্য করে ওই নেত্রী কে বিদ্রুপ ও ভর্ৎসনা উভয়ের ই সম্মুখীন হতে হয় | এ ছাড়াও বিপক্ষের বিভিন্ন নেতৃবর্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার পক্ষে বক্তব্য রাখেন এবং বক্তব্য রাখেন সামাজিক মাধ্যমে যারা মোদী – বিরোধী কন্ঠ হিসেবে পরিচিত মানুষজন যাদের সর্বদাই কেন্দ্র সরকারের সমস্ত নীতির অকপটে বিরোধীতা করতে দেখা যায়| এই আন্দোলন নিয়ে সব চেয়ে সোচ্চার যিনি, সেই নাজমা নাজির JDS এর সদস্য | এর থেকেই স্পষ্ট যে এই হিজাবের সমর্থনে আন্দোলনটি আদপেই কোনো ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় নির্দেশানুশারে পোশাক পরার পক্ষের আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন হলো বিজেপি তথা মোদী বিরোধের একটি রূপ, যার মূল সঞ্চালক শক্তি হলো বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা | তাই বাম শাসিত কেরলে হিজাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে কোনো আন্দোলন হয় না কিন্তু ওই এক ই কারণে বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে আন্দোলন হয় |
এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে tweeter এ লেখেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক তাভলীন সিং, যিনি নিজে বাম মনোভাবাপন্ন এবং মোদী বিরোধী | তিনি লেখেন যে এই আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত হলো Campus Front of India ( CFI) যা হলো PFI এর ছত্র সংগঠন এবং PFI একটি জেহাদি সংগঠন যা পূর্বে কেরলে এক অধ্যাপকের হস্তচ্ছেদ করে | এক ভিন্ন মতোধারার মানুষের এ হেনো মন্তব্য এই আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রকৃতিটি কে আরও উন্মোচন করে দিলো | রাজনীতি ও মোদী বিরোধী আসল উদ্দেশ্য না হলে নিজেদের সর্বদা প্রগতিবাদী বলে নিজের পিঠ নিজে চাপড়ানোর জন্য প্ৰখ্যাত বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ আজ হিজাবের মতো এক পশ্চাদমুখী প্রথার সমর্থন করতেন না, বিশেষত যখন এদের ই কয়েকজন পূর্বে ওই এক ই পোশাকের বিরোধীতা করেন | অথচ এই বুদ্ধিজীবীদের কাছে শাঁখা, পলা, মঙ্গলসূত্র, সিঁদুর ইত্যাদি পরা বা ঘোমটা দেওয়াটা নাকি পিতৃতান্ত্রিক প্রথা যা নারীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে কিন্তু হিজাব এদের কাছে নারী মুক্তি ও প্রগতির প্রতীক – এদের এই নগ্ন দ্বিচারিতাই এই আন্দোলনের আড়ালে অসৎ উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত দ্যায় |
২০২৪ এ লোক সভা নির্বাচনে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার জন্য এর দেশের বিরোধী দলগুলি মরণ কামড় দিতে চাইছে এবং ওদের অস্ত্র হলো দেশের কিছু গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় | গতবছর কৃষক আন্দোলনের নাম করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি কে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করে এই বিরোধীরা, ওই আন্দোলনের সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানিরা যুক্ত আছে এটা জেনেও – আর এর বছর এদের অস্ত্র এই কর্ণাটকের হিজাব আন্দোলন | এদের উদ্দেশ্য হলো দেশে অরাজগতা সৃষ্টি করে কেন্দ্র সরকারি কে বিপাকে ফেলা এবং বাইরের দেশগুলির সামনে ভারতের ভাব মূর্তি নষ্ট করা | এর ফলে বিদেশী বহুজাতিক সংস্থা গুলি ভারতে উপনিবেশ করতে দু বার চিন্তা করবে এবং এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে, দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে যার সরাসরি প্রভাব পরবে সরকারের প্রতিচ্ছবির উপর | অধুনা সরকারি কে দেশের মানুষের সামনে এর ভাবে দুর্বল প্রমাণিত করতে পারলে বিরোধীদের ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন পূরণ হবে কিন্তু তাদের এই উদ্দেশ্য সাফল্য করতে গিয়ে দেশের যে এতদিন বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে তাতে ওঁদের কিছুই যায় আসে না কারণ ওঁদের একটাই লক্ষ, যেন তেনো প্রকারেনো ক্ষমতায় আসা, দেশ ও দশের সার্বিক উন্নয়ন নয় | তাছাড়া বিদেশী শক্তি গুলিও মরিয়া হয়ে উঠেছে মোদী সরকার কে ক্ষমতা চ্যুত করার উদ্দেশ্যে কারণ যতদিন এই সরকার থাকবে ততদিন ভারত কে অর্থনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার স্বপ্নটি তাদের কাছে স্বপ্ন হিসেবেই থেকে যাবে এবং ভারত উন্নতির সোপান বয়ে প্রগতিশীল দেশ গুলির সমকক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে | পাঁচ রাজ্যে, বিশেষত উত্তর প্রদেশে চলতি বিধানসভা নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণ করাটাও এর আন্দোলনের আরেকটি কারণ হিসেবে গণ্য হতে পারে যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট বর্তমান প্রধান বিরোধী দলের পক্ষেই যায় | আগামী বছর কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচন ও এই আন্দোলনের লক্ষ্য হতে পারে |
মহামান্য আদালত হিজাব মামলার রায় দেবেন আগামী সোমবার, অর্থাৎ ১৪ ই ফেব্রুয়ারী, কিন্তু ওঁদের অন্তরবর্তী রায় ছিল অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলার বন্দোবস্ত করতে হবে এবং সর্ব শেষ রায় না বেরোনো অব্দি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো ধর্মীয় চিহ্ন বা আভরণ পরিধান করা যাবে না | কিন্তু ওই প্রতিবাদরত ছাত্রীদের ঔধত্য এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে ওরা আদালতের রায় ও মানতে চাইছে না | পূর্বতন শাসক গোষ্ঠীর বহু বছরের তোষণ নীতি এর জন্য দ্বায়ী |
গণতান্ত্রিক দেশে নিজের পছন্দ মতো পোশাক পরার অধিকারী সকলের আছে কিন্তু এর বেশ কিছু ব্যতিক্রম ও আছে, যেমন বিশেষ কিছু পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ – সেনা বাহিনী, পুলিশ, ডাক্তার, উকিল, দেহ রক্ষী ও গৃহ রক্ষীগণ, কিছু ব্যবসায়ী সংস্থার বিশেষ কিছু কাজে নিযুক্ত কর্মীগণ যেমন বাহনচালক, রক্ষী, মজদুর প্রভৃতি দের জন্য পরিধান রীতি – নীতির প্রচলন আছে যা তাদের কর্মের জন্য নিতান্ত জরুরী | এর ব্যতিক্রম হলে তাদের কর্ম ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে | এ ছাড়াও কিছু সামাজিক অনুষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের ক্লাব গুলিতেও এর ধরণের পরিধান রীতি – নীতির প্রচলন আছে | কাজেই কেউ সব জায়গায় চাইলেও নিজের পছন্দ মতো পোশাক পরতে পারে না | আমাদের দেশে বহুদিন ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্মীয় পরিধানের উপর নিষেধজ্ঞা জারি আছে | এতদিন এ নিয়ে কাউকে কোনো উচ্চ বাচ্চো করতে দেখা যায় নি, তাহলে হটাৎ এখন কেন ? এর উত্তর একটাই – রাজনীতি এবং এই রাজনীতির পাশার গুটি হলো ওই ছাত্রীরা, যাদের কে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে | তাদের উদ্দেশ্য সাফল্য হোক বা নাহোক, কাজ ফুরিয়ে গেলে ওই ছাত্রীদের কথা আর কেউ মনে রাখবে না, তাতে ওঁদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেলেও না | দুঃখের বিষয় হলো এই যে এই কথা তা কেউ বুঝতে পারছে না – না ওই ছাত্রীগণ না তাদের অভিভাবকগণ | যেখানে মধ্য প্রচায়ের কট্টর ইসলামিক দেশ গুলিতে এবং তালিবান শাসিত আফগানিস্তানেও মহিলারা বাধ্যতামূলক ভাবে হিজাব / বোরখার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেখানে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলারা সাবলীল ভাবে হিজাব পরার পক্ষে আন্দোলন করছে – এই বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবা মূর্খামি | কাজেই এই হিজাব আন্দোলনের আড়ালে লুক্কায়িত দেশ বিরোধী চক্রান্ত কে নিরস্ত করা এখন সব চেয়ে জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে | এর জন্য শুধু সরকারি তৎপরতার প্রয়োজন আছে তা নয়, দেশের মানুষকেও এক হয়ে এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়তে হবে |
@ রণিতা চন্দ