হিজাব নারীদের মধ্যে দাসত্বের মানসিকতা সৃষ্টি করে – ডাঃ আম্বেদকর

কর্নাটকে সাম্প্রতিক কালে চলে অভাবনীয় এবং সামাজিক ভাবে চিন্তার উদ্রেক করা ‘হিজাব আন্দোলন’ এর বিষয়ে একটি কথা না বলেই নয় –যারা পর্দার আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন তারা সামাজিক প্রগতির অংশীদার হওয়া থেকেই যে কেবলমাত্র বঞ্চিত হন তা নয়, ‘আমি সমাজের চেয়ে আলাদা’, এই বোধের থেকে তারা হিন্মন্যতায় ও ভোগেন, যার ফলে তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি ও সার্বিক বিকাশ ও ঘটেনা | কাজেই তারা সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়েনা এবং গঠনমূলক কার্যকলাপের পরিবর্তে নেতিবাচক কার্যকলাপ করার প্রবণতা তাদের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে | এর ফলে সমাজে তারা ব্রাত্য হয়ে ওঠেন | সার্বজনিক ভাবে সব রকম সামাজিক প্রক্রিয়ায় তারা যুক্ত হতে পারেন না, তাঁদের মতো নন এরম মানুষদের এরা এড়িয়ে চলেন এবং স্বাভাবিক ভাবে উল্টোটা ও হয় | উপরন্তু আপাদমস্তক পর্দায় ঢাকা কাউকে দেখলে পথ চলতি মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয় বিরক্তির |


এ হেনো পরিস্থিতিতে মুষ্টিমেয় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর মুসলিম ছাত্রীগণ, যাদের অধিকাংশর বয়েস এখন ও ১৮ ও পেরোয়নি, তারা আজকের যুগের মেয়ে হয়েও এই মধ্যযুগীয় প্রথা ও পোশাক পরার দাবি জানিয়ে ক্রমাগত ভাবে তাদের কলেজ কতৃপক্ষ ওঁ প্রশাসনের সাথে লড়ে চলেছে | এতে ওদের দুসাহস নয়, বরং ওদের ভীরুতার ই প্রমান পাওয়া যায় – স্ব গোষ্ঠীর গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার সাহস ওদের মধ্যে দেখা গেলো না | ওদের ই এক সহপাঠীর বক্তব্য হলো যে ওই ছাত্রীগণ পুরো একটি বছর হিজাব না পরেই কলেজ আসে | ওই কলেজে ধর্মীয় পোশাকের ওপর নিষেধজ্ঞা আছে | ওদের পুরো একটি বছর তাতে কোনো অসুবিধা হলো না কিন্তু হটাৎ করে গত ডিসেম্বর মাসে ওরা হিজাব পরা শুরু করে এই যুক্তিতে যে ওদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাবের বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট নীতি নেই এবং ওই প্রতিষ্ঠানে যেহেতু পুরুষ শিক্ষকগণ ও আছেন, তাই নিজেদের সুরক্ষার কারণে ওদের হিজাব পরাতা প্রয়োজন | এ হেনো যুক্তি যে শুধু অদ্ভুত তাই নয়, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুরুষ শিক্ষকদের জন্য অপমানজনক ও বটে |বিগত এক বছর যদি ওদের পুরুষ শিক্ষকদের বিষয়ে কোনো রক্ষণশীল মনোভাব না থেকে থাকে, তাহলে হটাৎ করে এই মনোভাব উৎপন্ন হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না | ওদের সহপাঠীর বক্তব্য অনুযায়ী ওদের কলেজে 50-60 টি মুসলিম ছাত্রী রয়েছে, কিন্তু ওই ছয়জন ব্যতিরেকে অন্য কারোই হিজাব না পরা নিয়ে কোনো অসুবিধা নেই | এতে অবশ্যই ওই ছয়জন ছাত্রীর, এই হিজাবের আড়ালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বিশেষত যখন স্পষ্ট হয়ে গেলো যে ওই আন্দোলনের প্রধান মুখ, মুস্কান মেহজাবিনের পিতা PFI এর নেতা, সেই PFI যাকে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে অবিহিত করেন অনেকে, সেই PFI যার সাথে দেশে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের যোগ সাজোশ আছে বলে চাপা গুঞ্জন শোনা যায় |


এই হিজাব বা পর্দার বিষয়ে, ভারতীয় সংবিধানের জনক, ডাঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর তাঁর ১৯৪৫ এ লেখা ‘Pakistan or the Partition of India,’ বইটিতে বিস্তারিত ভাবে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন | তিনি সমগ্র মুসলিম জনসংখ্যা কে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করার পক্ষে সওয়াল করেন | তাঁর মতে হিন্দু – মুসলিম সমস্যার সমাধাণহীন ভারত প্রগতি ওঁ স্থিতিশীলতার পথে হাঁটতে গিয়ে বেশ কিছুটা হোঁচট খেতে হবে |
যদিও ইসলামের সমালোচনা করা সেই সময়ে রাজনৈতিক ভাবে অবাঞ্চিত ছিল, তা সত্বেও এ ভারতের স্বাধীনতার কয়েক দশক পরেও, বাবাসাহেব আম্বেদকর সমালোচনা অব্যাহত রেখেছিলেন।

“হিন্দুধর্ম মানুষকে বিভক্ত করে এবং অপরদিকে ইসলাম মানুষকে একত্রিত করে – এই মন্তব্যটি একটি অর্ধসত্য মাত্র। কারণ ইসলাম যতনা মানুষ কে ঐক্যবদ্ধ করে তার চেয়ে অধিক বিভক্ত করে। ইসলাম এমন একটি ঘনিষ্ঠ, সম মানসিকতার মানুষদের সংস্থা যা মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে যে পার্থক্য করে তা কঠিন বাস্তব, এবং একটি তীব্র দূরত্ব সৃষ্টিকারী পার্থক্য। ইসলামের ভ্রাতৃত্ব মানুষের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব নয়। এটি শুধুমাত্র মুসলমানদের সাথে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব। এই গোষ্ঠী যে ভরাতৃত্বের প্রচার করে তার সুবিধা কেবলমাত্র তাদের গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যারা গোষ্ঠীর বাইরে, তাদের জন্য অবমাননা ও শত্রুতা ছাড়া আর কিছুই নেই” – এটি ডাঃ আম্বেদকর তাঁর উপরোক্ত বইটিতে লেখেন |

অনেকেই বলেন যে ডাঃ আম্বেদকর হিন্দু ধর্মের একজন বড়ো সমালোচক ছিলেন | তৎকালীন সমাজে জাতের ভিত্তিতে ভেদাভেদ এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই সকলের ই অবগত | হিন্দু ধর্ম সেই সময়ের গোঁড়ামি ও জাতি ভেদাভেদকে আজ অনেকাংশেই দূরে সরিয়ে দিয়ে এক সহিষ্ণু, সংবেদনশীল ও প্রগতিশীল ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক যেমনটা আমাদের বেদ ও উপনিষদে উল্লিখিত ছিল | কিন্তু আম্বেদকর সাহেব যে ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামি, ভেদাভেদ ও তাঁদের ধর্মে নারীদের অবস্থানের আরো বড়ো সমালোচক ছিলেন, তা অনেকেরই অবগত নয় কারণ ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁর সম্পূর্ণ মতমত দেশের জনগন কে জানানো হয় নি যাতে হিন্দু ধর্ম কে সহজেই খাটো করা যায় | তিনি বলেছিলেন যে হিন্দুধর্ম যে সামাজিক গোঁড়ামির স্বীকার, ইসলামে ধর্মে সেই গোঁড়ামি আরো বেশি এবং বেশিটির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রূপ হলো মুসলিম নারীদের বাধ্যতামূলক ভাবে পর্দা করতে বলা |

আম্বেদকর সাহেব ছিলেন তাঁর সময়ের প্রথম বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী যিনি ইসলাম ধর্মে বর্ণপ্রথার প্রচলনের বিষয়টি সমাজের সামনে তুলে ধরেন । হিন্দুধর্মে জাতিভেদ প্রথা দীর্ঘকাল ধরে নিন্দিত ছিল, কিন্তু বর্ণপ্রথার যে আধিপত্য এবং অস্পৃশ্যতার প্রচলন ইসলাম ধর্মেও ব্যাপকমাত্রায় প্রস্তুত, তার উল্লেখ একমাত্র আম্বেদকর সাহেব ই করেন ।

“জাতপাতের কথাই ধরা যাক । ইসলাম ভ্রাতৃত্বের কথা বলে। সবাই অনুমান করে যে ইসলাম দাসত্ব ও জাতপাতের ভেদাভেদ থেকে মুক্ত । দাসত্ব সম্পর্কে, কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এটি এখন আইনের দ্বারা বিলুপ্ত হয়েছে। তবে এটি বিদ্যমান থাকাকালীন এর বেশিরভাগ সমর্থন ইসলাম এবং ইসলামী দেশগুলির থেকে প্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও মুসলমানদের মধ্যে জাতের ভিত্তিতে ভেদাভেদ রয়েই গেছে। সন্দেহের অবকাশ নেই যে ভারতের মুসলিম সমাজ হিন্দু সমাজের মতো একই সামাজিক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত। প্রকৃতপক্ষে, মুসলমানদের মধ্যেও হিন্দু সমাজের সমস্ত সামাজিক ত্রুটি বিচ্যুতি তো রয়েইছে এবং আরও বেশি কিছু ও রয়েছে । মুসলিম মহিলাদের জন্য পরদা বাধ্যতামূলক করাতা হলো এই ‘আরও বেশি কিছু’র নিদর্শন ” – এটি আম্বেদকর সাহেবের বক্তব্য |
আম্বেদকর সাহেবের উপরোক্ত লেখাগুলি আজও তেমনি প্রাসঙ্গিক যেমন তা ছিল দেশভাগের সময় আজ থেকে ৭৫ বছর আগে |
বর্তমানে এই হিজাব-সমর্থক আন্দোলন হল এমন একটি আন্দোলন যা হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতের শতাব্দী-প্রাচীন বিভেদকে আর ও বেশি করে উন্মোচিত করছে।
“হিজাব দাসত্বের মানসিকতা ও হীনমন্যতা সৃষ্টি করে, মুসলিম নারীদের তাই হিজাব ও পর্দার থেকে স্বাধীন করতে হবে” – ডাঃ আম্বেদকর
হিজাব আন্দোলনের মতো একটি রক্ষণশীল আন্দোলন নারী এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর কোনো কাজেই লাগবে না । এটি সামাজিক স্থবিরতার একটি উপসর্গ, ঠিক যেমনটি আম্বেদকর সাহেব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
পর্দার আড়ালে নিজেকে আবৃত করার অর্থ হলো নিজেকে সভ্য সমাজের থেকে দূরে রাখা, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড থেকে দূরে রাখা, সমাজ গঠনে নিজের ইতিবাচক স্থান তৈরীর থেকে দূরে থাকা এবং পরিশেষে হীনমন্নতার ও ভীরুতার শিকার হওয়া, যা নারীকে জীবন যুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা অবোলম্বনের অযোগ্য করে তোলে | হিজাব যদি প্রগতির পথে বাধা নাই হতো তাহলে শিক্ষিত, প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা মুসলিম নারীরা হিজাব কে বর্জন করতেন না | সাম্প্রতিক কালে এর জ্বলন্ত উদাহরণ হলো কাশ্মীরের দ্বাদশ শ্রেণীর প্রথম স্থান অধিকারিণী আরুসা পরভেজ, যিনি সামাজিক মাধ্যমে বিদ্রুপ ও ভর্ৎসনার শিকার হয়েও হিজাব পড়তে অস্বীকার করেন কারণ এটা তাঁর প্রগতির পরিপন্থী |


আমাদের দেশের বাম মনোভাবাপন্ন ঐতিহাসিকগণ ঠিক যেমন ভাবে আমাদের দেশের গৌরাবিন্বিত ইতিহাস আমাদের থেকে লুক্কায়িত রেখে সর্বদা আমাদের দেশের আক্রমণকারীদের মহিমান্বিত করে এসেছে, ঠিক তেমন ভাবেই ডাঃ আম্বেদকরের বিচারধারা এবং হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর ধারণার অর্ধসত্যটি ই দেশের মানুষ কে শুনিয়ে এসেছে যাতে দেশের মানুষের এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে ইসলাম ধর্ম হিন্দু ধর্মের চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল, গোঁড়ামিমুক্ত ও মানবিক ঐক্যে বিশ্বাসী – যা আদৌ সত্য নয় | আম্বেদকর সাহেব নিজেই তাঁর লেখনী তে বিস্তারিত ভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন | আজ সময় এসেছে তাঁর প্রকৃত বিচার ধারা জনসমক্ষে এনে, সেই বিচারধারার ভিত্তিতে মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নতির বিষয় ভাবনা চিন্তা করা যাতে হিজাব আন্দোলনের মতো একটি বিধ্বংশী আন্দোলন যা তাঁদের কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেবে, এরম একটি ক্ষতিকর আন্দোলনা কে তারা নিরস্ত করতে সফল হয় |
সব চেয়ে অবাক হবার বিষয় হলো এই যে, যারা আজ এই হিজাব আন্দোলন কে সমর্থন করছে, তারা আবার নিজেদেরকে ডাঃ আম্বেদকরের বিরাট ভক্ত ও বলে থাকে | এর থেকে একটা বিষয় প্রমান হয় যে তারা নয় আম্বেদকর সাহেবের ইসলাম ধর্মের বিষয়ে চিন্তাধারা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় অথবা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে তারা ওই বিষয়টি চেপে যাচ্ছে | কিন্তু এই ব্যাপারে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই যে ভারতীয় সংবিধানের জনক, ডাঃ আম্বেদকর মুসলিম নারীর পর্দা করার প্রবল বিপক্ষে ছিলেন | এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই সমস্ত স্ব ঘোষিত বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিবাদীদের জন্য যারা হিন্দু ধর্মকে অপমান করার জন্য কথায় কথায় আম্বেদকর সাহেবের উল্লেখ করেন এবং আজ তথাকথিত প্রগতিবাদী হওয়া সত্বেও ইসলাম ধর্মের এরকম একটি নারীকে শৃঙ্খলাবধ্য করার মতো একটি মধ্যযুগিও একটি প্রথর সমর্থন করছে শুধু হিন্দু ধর্ম কে অপমান করার উদ্দেশ্যে, বিশেষ করে যখন অধিকাংশ প্রগতিশীল পাশ্চাত্য দেশ এই পর্দা কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং উচ্চ শিক্ষিত সুশীল সমাজে বসবাসকারী মুসলিম নারীগণ এই প্রথা কে বর্জন করেছেন |

  • রণিতা চন্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.