কুয়াশা কেটে সকালে সূর্য উঠতেই চেঁচিয়ে উঠলেন বিশ্বম্ভর শূর, “ভুল হুয়া।” ভুল হয়েছে। এই “ভুল হুয়া” থেকেই জায়গার নাম হয়ে গেল “ভুলুয়া।”
কিন্তু কি সেই ভুল ?
রাজা আদিশূরের বংশধর মিথিলার বিশ্বম্ভর শূর সপরিবারে মেঘনা নদীতে নৌকো চড়ে যাচ্ছিলেন চন্দ্রনাথ তীর্থে। কিন্তু রাতের বেলায় নৌকোর মাঝিরা কূল হারিয়ে ফেললে। এদিকে কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন বিশ্বম্ভর। এমন অবস্থায় তিনি স্বপ্ন দেখলেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। ভোর হলে এখানেই তুমি কূল খুঁজে পাবে। তীরে উঠে মাটি খুঁড়ে পাবে আমার পাথরের মূর্তি। প্রতিষ্ঠা করবে। আর তুমিই হবে এই এলাকার রাজা।
সত্যিই সকালে উঠে পেলেন বারাহী দেবীর পাথরের মূর্তি। দেবীর তিনটে মুখ, চারটে হাত। এদিকে সারাদিন ধরে কুয়াশা। চারপাশের কোনো কিছুই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। সেই আধো-অন্ধকারের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা করা হলো দেবী বারাহীর। কুয়াশা কিন্তু কাটলো না। অগত্যা সেইরাতে নদীর চড়েই কাটাতে হলো। কুয়াশার অন্ধকারে নৌকো ছাড়তে পারা গেল না ।

পরের দিন সকালে সূর্য উঠতেই দেখা গেল বিরাট ভুল হয়ে গেছে। সাধারণত দক্ষিণ বা পশ্চিমমুখে দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠার রীতি। কিন্তু কুয়াশার অন্ধকারে ঠিকমতো দিক বুঝতে না পেরে পূর্ব মুখেই দেবীকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
তা দেখেই বিশ্বম্ভর শূর চেঁচিয়ে উঠলেন, “ভুল হুয়া !” তা থেকে এলাকার নাম হয়ে গেল “ভুলুয়া।”
এই বিশ্বম্ভর শূরের অধ:স্তন চতুর্থ পুরুষ বীর ভুইঁয়া বর্তমান বাংলাদেশের ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণমাণিক‍্য।
ক্ষত্রিয় বংশ। সেকালে ক্ষত্রিয়ের কাজ করতেন কায়স্থরা। তাই কায়স্থ পরিবারেই মেয়ের বিয়ে দিলেন লক্ষ্মণমাণিক‍্য। গাভার বিখ্যাত ঘোষ বংশের ছেলে পরমানন্দ ঘোষের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলেন। এই ঘটনায় চন্দ্রদ্বীপের কায়স্থ সমাজ একঘরে করলে পরমানন্দকে। বিষয়টি শ্বশুরমশাইকে জানান। শুনে লক্ষ্মণমাণিক‍্য চন্দ্রদ্বীপ সমাজের অধিপতি রাজা কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্র রায়, বিক্রমপুরের রাজা কেদার রায়, ভূষণার রাজা মুকুন্দরাম রায় এবং যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে বিষয়টি জানালেন। তাঁরা সবাই লক্ষ্মণমাণিক‍্যকে সমর্থন করলেন। এরপর মগ দস্যুরা লক্ষ্মণমাণিক‍্যের রাজ‍্যে লুটপাট শুরু করে। লক্ষ্মণমাণিক‍্য তাদের তিনবার তাড়ালেন। এছাড়াও ঘোষণা করলেন, এলাকার কারো বাড়ির ওপর দিয়ে কোনো মগ অক্ষত দেহে পেরিয়ে গেলে তাকে সমাজচ্যুত করা হবে। রাজা লক্ষ্মণমাণিক‍্যের ভাই রাজা হবার লোভে আরাকানের মগ রাজার সঙ্গে যড়যন্ত্র করলো। তারপর নিজেও কিছু সৈন‍্যসামন্ত জুটিয়ে আক্রমণ করে বসলো দাদার রাজ‍্য ভুলুয়া। ষড়যন্ত্রে সাময়িকভাবে পরাস্ত হয়ে লক্ষ্মণমাণিক‍্য চলে গেলেন খিজিরপুরের আরেক বীর ভু়ঁইয়া ঈশা খাঁর কাছে। ঈশা খাঁর সঙ্গে মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের হৃদ‍্যতা ছিল। সেই সূত্রে মানসিংহ আকবরের কাছে চিঠি লিখে বাংলার সেনাপতিদের নিয়ে বারো ভুঁইয়াদের সাহায্যে আরাকান মগদের বিরুদ্ধে মোগলদের লড়াই লাগিয়ে দিলেন। বারো ভু়ঁইয়া ও মোগলের সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে আরাকানের মগবাহিনীর তুমুল লড়াই হলো।শহর কসবায়। এই ভীষণ যুদ্ধে মগের দল শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ভুলুয়া ছেড়ে পালালো। পরবর্তীকালে এই কসবায় মাটি খুঁড়ে সেই যুদ্ধের কামান-বন্দুক-তীরের টুকরো পাওয়া যায়। লক্ষ্মণমাণিক‍্য ফের ভুলুয়ার রাজা হলেন। নিজের ভুল বুঝে লোভী ভাইটাও দাদার কাছে ফিরে এলো। রাজা লক্ষ্মণমাণিক‍্য এবার ধুমধামের সঙ্গে দেবী বারাহীর পুজো করলেন। বহু ভূসম্পত্তি তিনি দেবোত্তর করে দিলেন। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ‍্যদের এনে তাঁর রাজ‍্যে বসালেন ।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.