১৯২১ সালে চন্দননগরে নির্মিত হয়েছিল দুর্গাচরণ রক্ষিত ঘাট। যাঁর নামে এই ঘাটের নামকরণ, তিনি ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে উপেক্ষিতই থেকে গেছেন। বেশিরভাগ বাঙালির একটা ভুল ধারণা আছে যে, ভারতীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম ফরাসি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান লে’জিয়ঁ দ’ন্যর (Chevalier de legion d’Honour) সম্মান লাভ করেছিলেন নাকি সত্যজিৎ রায়। লে’জিয়ঁ দ’ন্যর প্রদানের রেওয়াজ চালু করেছিলেন ফ্রান্সের সম্রাট এবং প্রবাদপ্রতিম বীর যোদ্ধা নেপোনিয়ন বোনাপার্ট। দুর্গাচরণ রক্ষিত ঘাটে এখনও লুকিয়ে নেপোলিয়নের স্মৃতি। ইতিহাস বলে, সত্যজিতের আগে অন্তত তিনজন বাঙালি এই সম্মান লাভ করেছিলেন। আর সবার প্রথম যে ভারতীয় এই সম্মান পেয়েছিলেন, তিনি একজন বাঙালি তো বটেই, সেই সঙ্গে ছিলেন ফরাসি উপনিবেশের প্রজা। চন্দননগরের দুর্গাচরণ রক্ষিত। ১৮৯৬ সালেই লে’জিয়ঁ দ’ন্যর পেয়েছিলেন তিনি।সারা দুনিয়াতে চন্দননগরের খ্যাতির একটা প্রধান কারণ ছিল ফরাসডাঙার তাঁত। দুর্গাচরণ রক্ষিত সেই তাঁতের ব্যবসা করেই হয়ে উঠেছিলেন এক বড়ো মাপের উদ্যোগপতি। কলকাতার এক ফরাসি ব্যবসায়ী ক্যামা সাহেবের অধীনে কাজ করতে করতে তিনি কাপড় আমদানি রপ্তানির কাজে হাত পাকিয়েছিলেন। তারপর চাকরি ছেড়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করলেন। বিদেশ থেকে আমদানি করতেন হোয়াইট লেদ, জিংক হোয়াইট, কুইনাইন, ফরাসি মদ। আর বিদেশে পাঠাতেন চাল, ডাল, চা, তিল সর্ষে, পোস্ত, তিসি, আফিম, তসরের থান ও কাটা কাপড়। সমস্ত ভারত জুড়েই ছিল তাঁর ব্যবসা। তার পাশাপাশি চন্দননগরের আর্থিক, সামাজিক উন্নয়ন এবং আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রেও তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। লে’জিয়ঁ দ’ন্যরের টাকা মানুষের সেবাতেই খরচ করেছিলেন। চন্দননগর স্ট্র্যান্ড রোড-এর ওপর জোড়া ঘাট আর গঙ্গার জেটি বানানো হয়েছিল তাঁরই উদ্যোগে। লেখালেখির জগতেও তাঁর বিচরণ ছিল। দুর্গাচরণ রক্ষিতের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে ফরাসি আমলেই তাঁর নামে গড়ে উঠেছিল একটা স্কুল। যার নাম ‘একল দুর্গা’ হলেও সেটি এখন দুর্গাচরণ রক্ষিত বিদ্যালয় নামেই পরিচিত।
শোনা যায়, উদ্যমী দুর্গাচরণ চাকরি ছেড়ে নানা দিক থেকে প্রায় বাইশশো টাকা যোগাড় করেন এবং এই মূলধন নিয়ে তিনি কলকাতার ৭ নং সোয়ালো লেনে ‘রক্ষিত অ্যান্ড কোং’ নামে একটি পাইকারি দোকান খোলেন। এই দোকানে বিলেত থেকে আনা বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করা হত। এর কিছুকাল পরে রাধাবাজার অঞ্চলে একটি কাটা কাপড়ের দোকান খোলেন। পোশাক তৈরির জন্য বড়ো থান থেকে প্রয়োজন মতো কাপড় কেটে বিক্রি করাকেই কাটা কাপড় বলা হত। এ-ও শোনা যায়, মাত্র এক বছরের মধ্যেই দুর্গাচরণ প্রায় ২২ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়! এই টাকাকে পুঁজি করে ১৮৮০ সালে ১ নং ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিটে ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট সংস্থা ‘Doorga Chorone Roquitte & Co.’ স্থাপন করেন। ১৮৮১ সালের কলকাতা শহরের জেনারেল ডিরেক্টরিতে ‘ওয়াইন ও স্পিরিট মার্চেন্ট’-এর তালিকায় এই সংস্থার নাম দেখা যায়। ব্রিটিশ আমলে একজন ভারতীয় নাগরিক এদেশের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছেন, এরকম উদাহরণ কিন্তু হাতে গোনা।
প্রথম বাঙালি হিসেবে লে’জিয়ঁ দ’ন্যর পেয়েছিলেন দুর্গাচরণ রক্ষিত। ১৯২১ সালে দুর্গাচরণের পুত্র শ্যামাচরণ রক্ষিত তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে চন্দননগরে এই ঘাট নির্মাণ করেন।