সবাই কাতর অনুরোধ জানাচ্ছে – এই বছরটি উৎসব করবেন না , শুধু পুজো টুকু করুন । করোনায় শেষ দিনে বেলেঘাটা আইডিতে নাকি ঠিকানা হবে! ডাক্তার পুলিশ সমাজকর্মী হোমড়াচোমরা এই মর্মে চেঁচিয়ে অস্থির , কিন্তু কে কার কথা শোনে!
আসলে দোষ জনগণের না , যারা এই অনুরোধ আবেদন করছেন দোষ তাদেরই ! তারা এমন এক জাতিকে পুজো করতে বলছেন , যে জাতি অন্তত ৫০ বছর আগেই পুজো করতেই ভুলে গেছে ! তারা ফি বৎসর পুজোটুকু বাদ দিয়ে বাকি মোচ্ছব-টা অতি ধুমধাম করে আয়োজন করে !
আসুন বিচার করে দেখি । একটা আম বাঙালী দুর্গা পূজোর দিনে কী করে ?!
বয়েস কম হোলে মোটামুটি সারা রাত night out আড্ডা ।
দুপুরে বিরিয়ানি , সন্ধ্যে বেলা ফিশ ফ্রাই , গাঁজা , বিয়ার কিংবা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে মেশানো হুইস্কি। বন্ধুদের সাথে কারুর বাড়ি বা পাবে মদের পার্টি । গার্লফ্রেন্ডের সাথে ওয়ো রুম বা বন্ধুর খালি ফ্ল্যাট খোঁজা । এই সব গুরুত্বপূর্ণ লীলা সমাধা করে ব্রাহ্ম মুহূর্তে কিংবা ভোরে যখন দেবীর পুজোর শুরু হচ্ছে তখন বাড়ি ফিরে বেলা ১২ টা অবধি ঘুম । আর জামা কাপড় , দশমীতে লাল পাড় , অষ্টমীতে পাঞ্জাবি এসব বাঙালি জন্মসূত্রে পাওয়া আঁতলামি তো আছেই ।
আসুন দেখা যাক যাদের বয়েস আরও কিছু বেশী , সেই সব চাকুরীজীবী বাবা মায়েরা কি করছে ? পুজো উপলক্ষে তেনারা বিদেশে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরেছেন । দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা , নিজের নিজের মা বাবাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে দুপুরের ভোজ । বাড়িতে বন্ধু ও বন্ধুদের মিসেস সহযোগে পার্টি । কোন একদিন একটা সিনেমা , অন্যদিন একটা লং ড্রাইভ , একদিন রাত জেগে ঠাকুর দেখা ।
যারা শহরে থাকে তারা কি করে ? পাঁচ মাস আগে থেকে তাদের পুজোয় ভ্রমন কর্মসূচি ঠিক হয়ে আছে । শিমলা মানালি । পকেটে রেস্ত থাকলে প্যারিস ইউরোপ । নিজের দেশে মা আসছেন বলে বাঙালি আনন্দে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে !
আবার গর্বের সাথে আমরা বলি – ” বুরজোয়া শ্রেণির শাসক গোষ্ঠী নিজেদের বনেদি পুজোয় সাধারণ মানুষ কে ঢুকতে দেয় নি বলে বারইয়ারি আর সার্বজনীন পুজোর উৎপত্তি ! “
কিন্তু বাস্তব চিত্র টা কি ? ২ লাখ টাকার পুজো বাজেটের থেকে এক লাখ যাবে পকেটে আর বোতলে ! ভটচাজ মশাই জিগ্যেস করে করে ক্লান্ত – “ বাবা , ফুলের প্যাকেটে দুব্বা নেইকো । দুব্বা ছাড়া মার পুজো অচল । “ ক্লাব কর্তার জবাব – “ বড্ড ডিস্টার্ব করেন আপনি জেঠু , আগের জন এরকম ছিলেন না ! দুব্বা ছাড়া একটু চালিয়ে নিতে পারেন না ? দেখছেন মিস অমুক আসছেন অনুষ্ঠান করতে। আমার কত্ত কাজ ! “
দুশো বছর আগে প্রথম বারইয়ারি পুজোর বিরুদ্ধাচারন করেছিলেন সমাজের হোমরাচোমরা রা। বলেছিলেন – ” কি ! ভিক্ষা করে মায়ের পুজো হবে ? এত বড় অনাসৃষ্টি !? “
সেদিনের সেইসব গোঁড়া বামুনের কথা হাস্যকর শোনালেও , বারইয়ারি পুজোর নামে কি যে এক ভয়ঙ্কর frankenstien আমরা তৈরি করেছি সেটা বাঙালি টের পাচ্ছে এই একবিংশ শতকে এসে ! মাইকের আওাজে কান ঝালাপালা ! মাতালদের উৎপাত , চাঁদার হুমকি , পার্টির চোখ রাঙ্গানো , বিসর্জনে ডি জে …… আর নবতম সংযোজন , জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বারইয়ারি ! আসছে বছর আবার হবে! পিছনে লাথি মেরে বিসর্জন! ধন্য বাঙালি !
আর ধন্য সেই সব প্রাচীনদের যারা বলেছিলেন – ” অনাসৃষ্টি হবে” !!!
এবার আসুন দেখি প্রতিমা শিল্প কি জানান দিচ্ছে । থিমের পুজোর প্রতিমার মাথা বড় , দেহ ছোট । ত্রিনয়ন কপাল ছাড়িয়ে মাথার ব্রহ্মরন্ধ্রে গিয়ে ঠেকেছে ! গনেশ পুলিশ! কার্তিক ঝাড়ুদার! সরস্বতী জিনস-টপ পড়া লক্ষ্মীর হাতে ন্যাপকিন- স্যানিটাইজার কখনও অসুর ( অর্থাৎ অশুভ ) ওপরে আর দেবী ( শুভ ) নিচে ! প্রতিমা এখন abstract art ও আধুনিক শিল্প কলার মাধ্যম ! কোনও এক যুগে প্রতিমা ছিল ইশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম । এর সাথে জড়িয়ে থাকে স্বাস্থ্য – সামাজিকতা – পরিবেশ – আর্থিক – ও আধ্যাত্মিকতা। এখন প্রতিমা একটা আর্ট মিডিয়াম ( মিউজিয়াম ) মাত্র ! একটা commodity । দর্শক consumer !
শাস্ত্র বলছে যে প্রতিমা সর্বাঙ্গসুন্দর ও নিখুঁত না হলে তাতে দেবতা অধিষ্ঠান করেন না ! এটা সত্য মানলে কলকাতা শহর থেকে দেবী দুর্গা অনেকদিন আগেই পালিয়েছেন ! নিখুঁত তো দূর অস্ত , প্রতিমা ইচ্ছাকৃত করে বিকৃত করাই আজকাল “আর্ট” !!
এই তো গেল আম বাঙ্গালীর পুজো কালচার । এবার আমাকে বোঝান , যে এর মধ্যে “পুজো” টা কোথায় পেলেন আপনি ?!
কে পুজো করে ?!
এমনকি পুজোর পাঁচ দিনের মধ্যে একটু আধটু ধম্ম কম্মের দিন বলে খ্যাত যেটি , সেই অষ্টমীর অঞ্জলিও মেয়েদের ঝারি মারার কারনে প্রসিদ্ধ ! বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে সিনেমায় সিরিয়ালে আমরা অঞ্জলি দিতে দিতে ঝারি মারা দেখে আনন্দ বিগলিত হয়ে বাঙালি হিসেবে গর্ব বোধ করি ! এই আমাদের দুর্গা পুজো । এমন উৎসব পৃথিবীর কোত্থাও নেই !! কিন্তু একবারও ভেবে দেখি না যে মায়ের আরাধনা করতে এসে এ কি আচরণ !
আরে ভাই , সুড়সুড়ি দেওয়ার কি ওইটাই টাইম পেলি ?!
তাহলে আমার বক্তব্যটা ঠিক কি ? আমি কি চাইছি যে সবাই আনন্দ ভুলে, পুজো আচ্চা নিয়েই থাকবে ? একদমই না ! অবশ্যই আনন্দ থাকবে। তবে তার সাথে পূজার অর্থ ও তার বিজ্ঞান থাকবে। পুজোর মূল সুত্রটুকু যেন আমরা না ভুলি । যেখানে বিজ্ঞান নেই সেখানে উৎসব – মোচ্ছব, বেলেল্লাপনা, বিশৃঙ্খলতার জন্ম দেয়।আমাদের সামঞ্জস্য রক্ষা করার কৌশল জানতে হবে। এই সামঞ্জস্য রক্ষাটাই প্রয়োজন । মায়ের আগমনের কারনে আনন্দ এই বোধ টা যেন না হারায় । আনন্দ করার জন্য মা কে টেনে আনা যেন না হয়ে দাঁড়ায় ! শিকড় যেন বিস্মৃত না হই !
আসল কথা হল , বাঙ্গালীর পুজো বহু দশক হল লুপ্ত । ফি। বছর ধুমধাম করে যেটা হয় , সেটা কার্নিভাল ! মেলা! মোচ্ছোব! মনের রঞ্জন! অতি যোগ্য নামকরণ ! তাই যারা উৎসব করবেন না পুজো করুন বলে গলা ফাটাচ্ছেন তারা একপ্রকার মূর্খ ! আজকের বাংরেজি বাঙ্গালীর জীবনে কোনও পুজো নেই , সংস্কার নেই, সবটাই কার্নিভাল !
(সংগৃহীত)