ডাক্তারজীর কথা আলাদা। ওনাকে আলাদাই রাখি। কিন্তু বাকি সরসঙ্ঘচালকদের মধ্যে যদি শ্রেষ্ঠ দুজনকে বাছতে হয় তাহলে অবশ্যই সেই দুজন হবে দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গুরুজী গোলওয়ালকার আর বর্তমান সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। একজনের হাত ধরেই সঙ্ঘ বর্তমান রূপরেখা পেয়েছে আরেকজনের হাতে বর্তমানের বিশালত্ব লাভ করেছে। একজন চারাগাছের যত্ন নিয়েছে অন্যজন তাকে মহীরুহের চেহারা দিয়েছেন।
মোহন ভাগবতের ঊত্থানের সময়টা মোটেও সহজ ছিলো না। বলা হয় যে‚ কঠিন কে? উত্তর হল – কঠিন সময়ে কঠিন থাকে যে! গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরে হিন্দুত্বের ইতিহাসে সম্ভবত দ্বিতীয় সবথেকে কঠিন সময় যখন চলছিল তখনই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এই লোকটা। আর তারপরই দেশজুড়ে এসেছে হিন্দুত্বের বন্যা! সারা পৃথিবী তাকিয়ে আছে এখন ভারতের দিকে। গানের ভাষায় বলতে গেলে – আজিকে বিশ্ব অবনত শির / গাহে শুভাশীষ জগজননীর!!
ঠিক কেমন ছিলো মোহন ভাগবতের দায়িত্ব গ্রহনের সময় ভারতের অবস্থা? ২০০৪ এবং ২০০৯। পরপর দুটো নির্বাচনে মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছিল হিন্দুত্ববাদ। মূল কারণ ছিলো হিন্দুত্ববাদ থেকে বিজেপির সরে আসা ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অত্যাধিক মনোযোগ দেওয়া।
অবশ্য ক্ষতি শুরু হয়েছিল তারও অনেক আগে থেকেই। ক্ষমতার লোভে হিন্দুত্ববাদীদের একটা অংশ দিশাহারা হয়ে পড়ল। তৈরী হল একটা নোংরা শব্দ‚ সর্ব-সমাবেশক ।
সেটা কি? না‚ বিজেপি-কে একটি সর্ব-সমাবেশক মঞ্চে পরিবর্তিত করতে হবে, ঠিক কংগ্রেসের (সেই সময়ের) মত। তবে সেখানে কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রটা থাকবে না। অর্থাৎ পরিবারতন্ত্র বাদ দিয়ে বিজেপির কংগ্রেসীকরণ চাই। এটাই নাকি বিজেপি-কে বৃহত্তর হিন্দু সমাজে গ্রহণযােগ্য করে তুলবে, বিজেপির ভােট বাড়বে‚ গদি দীর্ঘদিন টিকে থাকবে। কিছুটা বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা‚ কিছুটা অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও সাফল্য ( সোনালী চতুর্ভুজ, গ্রামীণ সড়ক বিপ্লব, দ্রব্যমূল্য স্থিতি, মােবাইল ফোন বিপ্লব, আন্তর্জাতিক প্রশংসা etc ) আর কিছুটা সৌভাগ্যের ফলে ২০০৪ সাল পর্যন্ত টিকেও গেল সেই সরকার!
কিন্তু ফোঁপড়া করে দিল হিন্দুত্ববাদের গুড়িকে। কট্টর হিন্দুত্ব শব্দটাই যেন তখন হয়ে দাঁড়াল নিষিদ্ধ কিছু। একইসঙ্গে বিজেপির মধ্যেও চলল সঙ্ঘের ডানা ছাটা।
সবমিলিয়ে হিন্দুত্ববাদ জিনিসটাই হয়ে উঠল নিজঘরে পরবাসী বিশেষ!
কিন্তু তা হলে কি হবে? দেশের মানুষ যে চায় অন্যকিছু। বাজপেয়ী সরকারের এই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে পারল না তারা। ২০০৪ সালের নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়ল সর্ব সমাবেশকরা।
কিন্তু তাতেও নেতাদের হুশ ফিরল না। নেতৃত্বের বদল হলো ঠিকই। ক্ষমতা উঠে আসল লালকৃষ্ণ আডবানীর হাতে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত নরম ও নিজস্বতাহীন এই নেতাটি নীতির বদল ঘটাতে পারলেন না কিছুই। তিনি সর্ব-সমাবেশক ও আদর্শত্যাগের ( উদারীকরণ ) থিওরির পালের গােদা বামপন্থী সুধীন্দ্র কুলকার্ণীকে নিয়েই চলতে থাকলেন। পাত্তা দিলেন না RSS এর আপত্তিকেও। একইভাবে দ্বিতীয় কংগ্রেস হয়ে চলতে লাগল বিজেপি। হিন্দুত্ববাদ হয়ে পড়ল রাজনৈতিক শক্তিহীন।
ফলে যা হওয়ার তাই হল। ২০০৯-এর নির্বাচনে স্রেফ মাটিতে মিশে গেল বিজেপি। ২০০৪ এ যাও বা ১৪০ টা আসন পেয়েছিল‚ ২০০৯ এ পেল মাত্র ১১৬ টা। কেউ কেউ সন্দেহ করতে শুরু করল দলটাই না নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবার।
আর কংগ্রেস এর কোয়ালিশন সরকারে ক্রমাগত দাপট বাড়তে থাকল কমিউনিস্ট আর পাক পন্থীদের! ক্ষমতা অস্বাভাবিক বেড়ে উঠল স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিবারতান্ত্রিক শক্তিগুলোরও। সাথে সীমাহীন দূর্নীতি তো আছেই। আর তার সাথে যোগ হল ক্রমাগত বিদেশী আক্রমন। ভারত সেই সময় বিদেশী আক্রমনের যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতেও ভুলে গেছিল। নরেন্দ্র মোদির ভাষায় বলতে গেলে পাকিস্তান আক্রমণ করত আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার কাছে গিয়ে নালিশ করে কান্নাকাটি করত। এক কথায় গোটা দেশটাই চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার যোগার হল।
আর এই অবস্থাতেই হিন্দুত্বকে আডবানীর দুর্বল খপ্পর থেকে বের করে আনলেন একজন। সদ্য সদ্য তখন তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন সঙ্ঘের। ভারত তথা পৃথিবী জোড়া হিন্দুত্ববাদের সেই দুর্দিনে শক্ত হাতে হাল ধরলেন তিনি। প্রথমে আডবানী লবিকে নিরস্ত করলেন। আর তারপর সঙ্ঘের একজন বিশ্বস্ত ও দক্ষ স্বয়ংসেবক নিতীন গড়কড়ীকে বসালেন বিজেপির সভাপতি পদে। দক্ষ নাবিকের মতো এত বছর ধরে হওয়া পার্টির ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করে আবার তাকে সচল করলেন দুজনে।
আর তারপর নব উদ্যমে বলীয়ান হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব তুলে দিলেন আরেক স্বয়ংসেবক তথা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির হাতে। আর তারপরের ইতিহাস তো আপনারা সবাইই জানেনই। সেসব বলাই বাহুল্য।
১০ বছর আগেও যে ভারত দূর্ণীতি – জঙ্গিহানা – বিচ্ছিন্নতাবাদ – প্রাদেশিক শক্তি – বহিরাক্রমন নিয়ে বিধ্বস্ত ছিলো‚ আজ সেই ভারতই বিশ্বগুরু হওয়ার পথে এগোচ্ছে। একজন যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ঠিক কোন ম্যাজিকটাই না দেখাতে পারে!
হ্যাঁ তাই বলে কিছু ভুলত্রুটি কি নেই? অবশ্যই আছে। সব মানুষেরই থাকে। আমার ব্যক্তিগত মত হিসাবে – সব ভারতীয়ই হিন্দু কথাটা বলার আগে হিন্দু শব্দটার বিষয়ে সঙ্ঘের চিরকালীন স্ট্যান্ড ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন ছিলো। অন্য সরসঙ্ঘচালকদের থেকে ওনার পরিস্থিতি আলাদা। অন্যরা বক্তৃতা দিতেন শুধুমাত্র স্বয়ংসেবকদের মধ্যে। কিন্তু বর্তমান সরসঙ্ঘচালকের ভাষন ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে সবার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ফলে যারা সঙ্ঘ শিক্ষায় শিক্ষিত নয়‚ হিন্দু নিয়ে সঙ্ঘের স্ট্যান্ড জানে না‚ রিলিজিয়ন বলে যে কিছু ভারতে ছিলো না সেটা জানে না‚ আগ্রাসী জাতিবাদ বোঝেনা কিন্তু ছোটো থেকে রিলিজিয়নে হিন্দু লিখে এসেছে তারা কনফিউজড হয়ে যায়। স্বাভাবিক এটা। একজন আন্তর্জাতিক স্তরের নেতৃত্বের বোধহয় একটু বেশীই সচেতন থাকা উচিত প্রযুক্তির পরিবর্তন ও প্রযুক্তির সাথে সাথে আচরণের পরিবর্তন নিয়ে।
বা‚ জাতপাত নিয়ে বোধহয় ভদ্রলোকের ডিপ্লোম্যাটিক হওয়া প্রয়োজন ছিলো। কারনও ওই একই‚ যারা তাঁর ভাষন শুনছে তারা সবাই স্বয়ংসেবক না। হিন্দুত্ববাদী মানেই সে স্বয়ংসেবক কিংবা স্বয়ংসেবক মানসিকতার নয়। ফলে স্বয়ংসেবক নয় এমন তথাকথিত উচ্চবর্ণের কিছু কাস্ট প্রাইড যুক্ত মানুষের মনে সঙ্ঘ নিয়ে ক্রোধ জন্মাচ্ছে। আমি এমনও কিছু কাস্টিস্ট লোককে চিনি আগে সঙ্ঘের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো। কিন্তু জাতপাত দূরীকরণ নিয়ে সঙ্ঘের অবস্থান জানার পর থেকে নিজে তো প্রতিদিন সঙ্ঘকে খিস্তি করেই‚ এমনকি অন্যদেরও সঙ্ঘের বিরুদ্ধে ভড়কে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু সে হয়তো হিন্দুত্ববাদী শক্তির কোনো না কোনো পজিটিভ কাজে লাগতে পারত। যেভাবে হয়তো পরম ভক্তও নিয়মিত ঈশ্বরের নাম নেয় না‚ খিস্তি করার জন্য তারা যতবার মোহন ভাগবতের নাম নেয়। জোক্স অ্যাপার্ট! সরি।
কিংবা এই লাস্ট ব্লান্ডারের কথাই যদি ধরি। ব্লান্ডার না‚ একে অন্যায়ই বলা উচিত। সঙ্ঘচেতনার বাইরে থাকা মানুষদের কাছে টেনে নেওয়ার আগ্রহের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলে বসলেন প্রয়োজন হলে গরু খেয়ে প্রজন্ম ধরে নরকে যাও কিন্তু অন্যকে কাছে টানার প্রচেষ্টা বন্ধ কোরো না। আর কংগ্রেসী বা বামপন্থী মিডিয়া তো ওঁত পেতে ছিলোই। ফলাও করে প্রচার হল আরএসএস থেকে গরু খেতে বলেছে। যদিও হিন্দুত্ববাদী শিবিরের কাছে এসব নতুন কিছু না। এর আগেও সেই‚ নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন যে দেশের বাইরে এত কালো টাকা আছে যে যদি সব কালো টাকা ফেরত আনা যায় তাহলে সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ করে ঢুকবে। সেটাই মিডিয়ার কাছে হয়ে গিয়েছিল নরেন্দ্র মোদি সবাইকে ১৫ লাখ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দিলীপ ঘোষ গোয়ালাদের মধ্যে একটা প্রচলিত কথা ব্যবহার করেছিলেন – দেশি গরুর দুধে সোনা আছে। সেটাই মিডিয়ার কথায় হয়ে গিয়েছিল দেশি গরুর দুধে সোনা মেশানো আছে। দুধ দুইলে সোনা বেরোয় ব্লা ব্লা! এছাড়া এর আগে গুরুজী এক বইতে লিখেছিলেন যে দক্ষিন ভারতে ( সম্ভবত কেরলে) জাতপাতের অত্যাচার এত বেশী ছিলো যে নিম্নবর্ণের কোনো হিন্দু বিয়ে করলে তাদের প্রথম সন্তান কোনো উচ্চবর্ণের ঔরসে করতে হত। এক্স্যাক্ট লাইনটা খেয়াল আসছে না‚ এমনই কিছু ছিলো। সেটাকেই আগে পরে ছেটে বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছিল গোলয়ালকার বলেছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রথম সন্তান উচ্চবর্ণের ঔরসে হওয়া উচিত। অনেকেই হয়তো সেই পোস্টটা ফেসবুকে ঘুরতে দেখেছেনও।
আর এবারের টার্গেট সরসঙ্ঘচালক!
যদিও শত্রু আমাদের কথা বিকৃত করেছে বলে কান্নাকাটির অবকাশ নেই। শত্রুর কাজ শত্রু করেছে। ওদের কাজই মানুষকে তোমার বিরুদ্ধে ওসকানো। তুমি ওদের সেই সুযোগ দিয়েছ কেন?
অবশ্য এইসব যদি – কিন্তু – তবে এগুলো বাদ দিয়েও বলা যায় যে মোহন ভাগবতের গরুর মাংসের উদাহরণ দেওয়া ঠিক হয়নি। ওটা অন্যায়। এখনো বহু ধর্মভীরু হিন্দু গোমাংস শুনলে কানে আঙ্গুল দেয়। সেখানে ওইভাবে তুমুল প্রচেষ্টা বোঝাতে গিয়ে গোমাংসের উদাহরণ টানা অন্যায়। অন্যকিছু বলতে পারতেন – যে ওদের মদ খেতে দিয়েছিল‚ নিরামিষ খাওয়া মানুষদের আমিষ দিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু গোমাংস বলা উচিত হয়নি। তবে একইসাথে সেটা গোরু খাওয়ার জাস্টিফিকেশন বা গরু খাওয়ার নির্দেশও ছিলো না – যেভাবে মিডিয়া প্রচার করেছিল। হিন্দুত্ববাদ বিরোধী শক্তির হাতে খুল্লামখুল্লা অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটা।
যাইহোক‚ দোষগুন নিয়েই মানুষ। যেগুলো ভুল বা খামতি বলে মনে হয় সেগুলোর বিরোধিতা অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু একইসাথে যে যা গৌরব পাওয়ার যোগ্য তাকেও তা দেওয়া উচিত। সিজারের যা প্রাপ্য তা সিজারকে দাও আর ঈশ্বরের যা প্রাপ্য তা ঈশ্বরকে। জেরুজালেমের এক বিদ্রোহী যুবক বহু আগে বলে গিয়েছিলেন।
আমার ব্যক্তিগত মত অনুসারে‚ ডাক্তারজী আর গুরুজীর পরে তৃতীয় শ্রেষ্ঠ সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতকে জানাই তাঁর জন্মদিনের সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা!
সৌভিক দত্ত