♣ হাজারা
আফগানিস্তানের বুকে একমাত্র নির্ভেজাল মঙ্গোল জাতি হল হাজারা উপজাতি। এদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে, যার সাথে মঙ্গোলিয়ার কিছু আদি বাসিন্দাদের অদ্ভুত মিল আছে, সাথে ইসলাম মিশ্রণের ফলে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। আফগানিস্তানে এদের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের আশপাশে, অর্থাৎ ২০ শতাংশের মতন।
হাজারা শব্দটা ফার্সি ‘হাজার’ থেকে এসেছে, যার অর্থ সহস্র। সম্ভবত তৈমুর লঙ সেনাবাহিনীর যে সহস্রাধিক সদস্য আফগানিস্তান থেকে আর স্বদেশে ফিরে যায় নি, তারাই আজ হাজারা নামে পরিচিত। আরেক জনশ্রুতি অনুসারে মধ্য আফগানিস্তানের হাজারাজাত জেলার আদি বাসিন্দা বলেই নাকি এহেন নামকরণ। এখানে বলে রাখা ভাল, আফগানিস্তানের ৮০% হাজারা মধ্য আফগানিস্তানের বাসিন্দা। হাজারারা মুখ্যত শিয়া মতাবলম্বী, এবং এদের মাতৃভাষা বিশুদ্ধ ফার্সি। আফগানদের মধ্যে একমাত্র এরাই বিশুদ্ধ ফার্সিতে কথা বলে। বাকি আফগানদের মতই এরাও লেখাপড়ায় নাস্তালিক হরফ ব্যবহার করে।
জনশ্রুতি আছে উজ়বেক বংশোদ্ভূত বাবর নাকি আদতে হাজারা উপজাতির লোক ছিলেন, বিশুদ্ধ উজ়বেক নন। হাজারারা দাবি করে যে, তারা নাকি আদতে মঙ্গোল বীর তৈমুর লঙের বংশধর। ১২৯০ দশকে তৈমুর লঙ কয়েক হাজার সেনা নিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ করেন। যুগপৎ চেঙ্গিজ খান ও তৈমুর লঙের বংশধর হিসাবে পরিচিত বাবর উজ়বেকিস্তানে জন্মালেও আফগানিস্তান থেকেই রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৮৯০ দশক থেকে হাজারারা আফগান সংখ্যাগুরু পাস্তুনদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছে সরকারের মদতে। যা তালিবানদের আমলে (১৯৯৬-২০০১) আরও বেড়ে যায়।
হাজারা উপজাতির একটা বড় অংশ মধ্য আফগানিস্তানের হাজারাজাত অঞ্চলে বসবাস করে। প্রায় ১৫% হাজারা উত্তরপশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনওয়া প্রদেশের হাজারা জেলায় থাকে। ১৯৯০ দশকে আফগান গৃহযুদ্ধের সময়ে পাস্তুনদের হাতে নির্যাতিত হবার জন্য অনেক হাজারা আফগানিস্তান ছেড়ে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশে এসে বসবাস করতে থাকে।
জাতিগত ও ধর্মীয় — উভয় ভাবেই হাজারারা সংখ্যালঘু হবার কারণে যুগপৎ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ভয়ঙ্কর বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে উনবিংশ শতক থেকে। পাকিস্তানের কোয়েট্টা শহরে ২০১১ সালে জুলাই থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারা পরিবার পাস্তুনদের হাতে নিহত হয়। হাজারারা যেহেতু নিজেদের মঙ্গোল হিসাবে পরিচয় দিতে ভালবাসে, ও গর্ববোধ করে; তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল পাস্তুনরা এদের ঘৃণা করবে তাতে আশ্চর্যের কি আছে? পাস্তুনদের কাছে এরা বিদেশী ছাড়া আর কিছুই নয়।
মধ্য আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক বামিয়ান প্রদেশেও এদের অস্তিত্ব আছে। ২০০১ সালের পর থেকে আমেরিকা ও ন্যাটো বামিয়ান প্রদেশে যেসব শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে; তাতে প্রায় ৭৫% হাজারা চাকরি পেয়েছিল। এরা খুবই শান্ত ও নিরীহ প্রকৃতির বলে বারবার আক্রমণের শিকার হয়ে আসছে; কিন্তু নিজেদের চরিত্র বদলায় নি।
হাজারারা মোটামুটি চার গোত্রে বিভক্ত — বেসুদ, ইয়েক আউলাং, তিমুরি, দাই জাঙ্গি, দাই কুন্দি ইত্যাদি। মধ্য আফগানিস্তানের দায়কুন্দি জেলায় এরাই সংখ্যাগুরু। অধিকাংশ হাজারা কৃষিজীবী ও পশুপালক, তবে কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আছে। এরা এক একটি ২০-৩০ পরিবারের গ্রামে (পাঞ্জাও) বসবাস করে, যা দুর্গের ন্যায় ২০ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা থাকে। আফগানদের মধ্যে এদেরই শিক্ষার হার সর্বাধিক, প্রায় ৬০ শতাংশ, আফগানদের মধ্যে নারীশিক্ষার প্রচলন একমাত্র এদের মধ্যেই দেখা যায়।
§ তথ্যসূচি
Monsutti, Alessandro. War and Migration: Social Networks and
Economic Strategies of the Hazaras of Afghanistan. New York:
Routledge, 2005.
Mousavi, Sayed Askar. The Hazaras of Afghanistan: An Historical,
Cultural and Political Study. New York: St. Martin’s, 1997.
জীবাণু দা