গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আচার্যদেবের প্রথম পরিচয় সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের লেখা বই এর মাধ্যমে। সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে নিয়ে যান মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করার জন্য কিন্তু প্রথাগত পড়াশোনা রবীন্দ্রনাথের ধাতে নেই, তাই বছর দেড়েক বাদে দেশে ফিরে এসে লিখলেন য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ (প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর ১৮৮১)। আর ১৮৮২ সনে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র গিলক্রাইষ্ট স্কলারশিপ পেয়ে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পড়াশোনা করতে। এখানে বলে রাখা ভালো, আচার্যের আগে আরও দুজন বাঙালি ছেলে ‘গিলক্রাইষ্ট স্কলারশিপ নিয়ে বিলেতে পড়তে যান। তারা হলেন সরোজিনী নাইডুর পিতা বিখ্যাত রাসায়নিক অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় আর প্রাতঃস্মরণীয় ভূতত্ববিদ জামসেদপুর টাটানগর ইস্পাত কারখানার পরামর্শদাতা প্রথম নাথ বসু। তখনকার দিনে, আজকের মতো উড়োজাহাজে কয়েকঘণ্টার মধ্যে বিলেত যাওয়া যেত না, জাহাজে বিলেত যেতে হত মুম্বাই শহর থেকে, প্রায় একমাসের পথ, সুয়েজ খাল হয়ে শুধু জাহাজের ডেকে বসে জল দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আচার্যদেব ঠিক করলেন, এই সময়টা বই পড়ার উপযুক্ত সময়। স্পেনসারের লেখা সমাজতত্বের একটি বই, কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘প্রভাতচিন্তা’ আর ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র। প্রফুল্লচন্দ্র ‘আত্মচরিত গ্রন্থে ভ্রান্তিবশত লিখেছেন য়ুরোপ যাত্রীর ডাইরি। আসলে ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডাইরি’ প্রকাশ হয় ১৮৯১ সালে। তাই বইটির প্রকৃত নাম হবে য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র।
আচার্যদেব তাঁর আত্মচরিত’ গ্রন্থে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্য জগতে পরিচিত হন নাই। আমার দুই বৎসর পূর্বে তিনি বিলাত গিয়াছিলেন এবং যুরোপ যাত্রীর ডাইরি নামক তাহার একখানি প্রকাশিত বই সঙ্গে ছিল।
এরপর ইংরাজী ১৯২৫, বাংলা ১৩৩২ সালে আচার্যদেবের প্রিয়ছাত্র রাসায়নিক রাজশেখর বসু বা ছদ্মনামে পরশুরামকে নিয়ে দুজনের মধ্যে যে মান, অভিমান, চিঠির আদানপ্রদান হয়েছিল সে প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করব।
প্রফুল্লচন্দ্রের প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজশেখর বসু। ১৮৯৯ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেন। তখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস.সি কোর্স চালু না হওয়ায় রসায়নে এম.এ পাশ করেন (১৯০০ সালে) এবং পরীক্ষায় প্রথম হন। ১৯০৩ সালের বেঙ্গল কেমিক্যালে সামান্য কেমিস্টের পদে যোগ দিয়ে ১৯০৬ সালে ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজারের পদে প্রমোশন পান। ১৯০১ সালে কোম্পানীর বিক্রি ছিল ২৫ হাজার টাকা, ১৯১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন লক্ষ টাকা আর ১৯১৫ সালে পাঁচ লক্ষ টাকা। এহেন রাজশেখর বসু ১৯২৫ সালে ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে ‘গড্ডলিকা’ নামে একটি হাসির গল্পের সংকলন বই লেখেন। ১৩৩২ সালের প্রবাসীর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ তার একটি সপ্রশংস সমালোচনা লিখলেন। এই সমালোচনা প্রফুল্লচন্দ্রের চোখ এড়াল না। প্রফুল্লচন্দ্রের ভয় হোল পরশুরাম যদি এরপর বেঙ্গল কেমিক্যালের কাজে মন কম দিয়ে সাহিত্য সেবায় বেশি মন দেন তবে তো প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হবে।
রবীন্দ্রনাথ সমালোচনায় লিখলেন লেখার দিক থেকে বইখানি আমার কাছে। বিস্ময়কর। ইহাতে আরও বিস্ময়ের বিষয় আছে, সে যতীন্দ্রনাথ সেনের ছবি। লেখনীর সঙ্গে তুলিকার কী চমৎকার জোড় মিলিয়াছে। লেখার ধারা ও রেখার ধারে সমান তালে চলে, কেহ কাহারও চেয়ে খাটো নহে। তাই চরিত্রগুলো ভাষায় ও চেহারায়, ভাবে ও ভঙ্গিতে ডাহিনে বামে এমন করিয়া ধরা পড়িয়াছে যে তাহদের আর পলাইবার ফাঁক নেই (প্রবাসী অগ্রহায়ণ ১৩৩২)।
এরপর আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রফুল্লচন্দ্রের চিঠি আর প্রফুল্লচন্দ্রের কাছে। রবীন্দ্রনাথের চিঠি নিয়ে কিছু অংশ পড়ব। প্রফুল্লচন্দ্রের চিঠি রবীন্দ্রনাথকে, শ্রদ্ধাস্পদেষ্ণু, * শেষ বয়সে আপনাকে লইয়া বড় মুস্কিলে পড়িলাম। সেদিন আপনার সামনে হিসাব করিয়া দেখিলাম, আপনি আমার অপেক্ষা তিন মাসের বয়োজ্যেষ্ঠ। সম্প্রতি দেখিতেছি, আপনি সত্যসত্যই আমার ক্ষতি করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। গড্ডালিকা প্রথম সংস্করণ বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। কিন্তু যখন দেখি সাহিত্য সম্রাট স্বয়ং তাহার সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তখন অচিরেই পরপর বারো হাজার কপি বিক্রয় হইবে সন্দেহ নাই। সেদিন গ্রন্থকার ‘পরশুরাম’-কে আমি বলিলাম যে এ প্রকার সৌভাগ্য কদাচিৎ কোনো লেখকের ঘটিয়া থাকে। এখন তাহার মাথা না বিগড়াইয়া যায়। তিনি আমারই হাতে তৈয়ারি একজন রাসায়নিক এবং তিনি আমার নির্দিষ্ট কোনো কাজে অনেকদিন যাবত ব্যাপৃত। কিন্তু এখন তিনি বুঝিলেন যে তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রেও একজন কেষ্টবিষ্টু’, সুতরাং আমাকে অসহায় রাখিয়া ত্যাগ করিতে ইচ্ছুক হইতে পারেন…..
ভবদীয়
শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র রায়
রবীন্দ্রনাথের উত্তর
শান্তিনিকেতন
সুহৃদয়,
বনে বসে Scientific American পড়ছিলুম। এমন সময় চিঠির খামের কোণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান সরস্বতীর পদাঙ্ক দেখতে পেয়ে আনন্দই হোল। আমার হৃৎপদ্ম থেকে কাব্য সরস্বতীকে বিদায় করে তিনি স্বয়ং আসন নেবেন এমন একটা চক্রান্ত চলছে। খুলে দেখি, যাকে বলে ইংরাজিতে টেবিল ফেরানো। আমারই পরে অভিযোগ যে আমি রসায়নের কোটা থেকে ভুলিয়ে ভদ্রসন্তানকে রসের রাস্তায় দাঁড় করাবার দুষ্কর্মে নিযুক্ত। কিন্তু আমার এই অজ্ঞানকৃত পাপের বিরুদ্ধে নালিশ আপনার মুখে শোভা পায় না। একদিন চিত্রগুপ্তের দরবারে তার বিচার হবে।
সাহিত্যের তরফ থেকে আমি যদি তার, প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে থাকি, কতটুকুই বা কৃতকার্য হয়েছি। যাই হোক আসি রস-যাচাইয়ের নিকষে আঁচড দিয়ে দেখলেম, আপনার বেঙ্গল কেমিক্যালের এই মানুষটি একেবারেই কেমিক্যাল গোল্ড নন, ইনি খাঁটি খনিজ সোনা।
আপনার শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এরকম হাস্য পরিহাস দুজনের মধ্যে মাঝে মাঝেই হত। এখন একটু প্রফুল্লচন্দ্রের সাহিত্য প্রীতির কথা বলি, ১৯২৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর দুপুর দুটোয় কবি নজরুল ইসলামকে কলকাতা আলবার্ট হলে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিন প্রফুল্লচন্দ্র বক্তৃতায় বললেন।
“আজ বাংলার কবিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করবার জন্য আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। রবীন্দ্রনাথের জাদুকরি প্রতিভায় বাংলাদেশ সম্মোহিত হয়ে আছে। তাই অন্যের প্রতিভা লোকচক্ষে তেমন করে ধরা পড়ছে না। আধুনিক সাহিত্যে মাত্র দুজন কবির মধ্যে আমরা সত্যিকারের মৌলিকতার সন্ধান পেয়েছি। তারা সত্যেন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কবি বলে স্বীকার করেছেন।”
আচার্যদেব বৈজ্ঞানিক হয়েও সাহিত্য সম্বন্ধে কত অনুরাগী ও সমঝদার ছিলেন উপরের উক্তিটি তার প্রমাণ। আর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আমরা বাঙালী’ কবিতায় প্রফুল্লচন্দ্র সম্বন্ধে লিখলেন,
“বি-সমধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালী দিয়েছে বিয়া।
মোদের নব্য রসায়ণ শুধু গরমিলে মিলাইয়া।”
আচার্যদেবের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মারকিউরাস নাইট্রাইট, এর আগে পৃথিবীর অন্য কোনো বৈজ্ঞানিক লেবরটরীতে স্থায়ীরূপে তৈরি করতে পারেননি। এজন্যই সত্যেন্দ্রনাথ ‘গরমিলে মিলাইয়া’ কথাটি লিখেছেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মেলামেশার আর একটা অঙ্গন হোল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার অর্জনের বছর মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সাহিত্য পরিষদের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি প্রসারের জন্য। তিনি নানা লোকরঞ্জন বক্তৃতার আয়োজন করেন। বক্তাদের তালিকায় ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র বসু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবীনচন্দ্র সেন, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, যদুনাথ সরকার, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ক্ষিতি মোহন সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায় ও প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ বিশিষ্ট জন।
আবার এই সাহিত্য পরিষদে ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের সপ্ততিতম জন্মবর্ষ পালিত হয়। সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, ৯ পৌষ টাউন হলে অনুষ্ঠান হয়। প্রফুল্লচন্দ্র মানপত্র পাঠ করে রবীন্দ্রনাথকে সেটি উপহার দেন। যেহেতু দুজনেরই জন্ম ১৮৬১ সালে সেইজন্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সপ্ততিবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে কলকাতায় টাউন হলে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে ২৫ অগ্রহায়ণ (১২ ডিসেম্বর ১৯৩২) রবিবার বিকাল চারটার সময় বিরাট সভার আয়োজন হয়। আচার্যদেব তখন সাহিত্য পরিষদের সভাপতি। রবীন্দ্রনাথ এই জয়ন্তী সভার সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। স্বাগত ভাষন দেন ডাঃ নীলরতন সরকার (তারও জন্ম ১৮৬১) প্রফুল্লচন্দ্রের সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে এর আগেই শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণ থেকে একটা অভিনন্দন পত্র পাঠিয়েছিলেন, সেটা নিম্নলিখিত রূপছিল।
Uttarayan
Santiniketan, Bengal
আমরা দুজনে সহযাত্রী।
কালের তরীতে আমরা প্রায় এক ঘাটে এসে পৌঁছেছি। কর্মের ব্রতেও বিধাতা আমাদের কিছু মিল ঘটিয়েছেন।
আমি প্রফুল্লচন্দ্রকে তার সেই আসনে অভিবাদন জানাই যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তার ছাত্রের চিত্তকে উদ্বোধিত করেছেন, কেবলমাত্র তাকে জ্ঞান দেননি, নিজেকে দিয়েছেন, সে দানের প্রভাবে সে নিজেকেই পেয়েছে।
বস্তুজগতের প্রচ্ছন্ন শক্তিকে উঘাটিত করেন বৈজ্ঞানিক, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তার চেয়ে গভীরে প্রবেশ করেছেন। কত যুবকের মনোলোকে ব্যক্ত করেছেন তার গুহাহিত অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি, বোধশক্তি। সংসারে জ্ঞান তপস্বী দুর্লভ নয়, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে চরিত্রের ক্রিয়া প্রভাবে তাকে ক্রিয়াবান করতে পারেন এমন মনীষী সংসারে কদাচ দেখতে পাওয়া যায়।
উপনিষদে কথিত আছে, যিনি এক তিনি বললেন, আমি বহু হব। সৃষ্টির মূলে। এই আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সৃষ্টিও সেই ইচ্ছার নিয়মে। তার ছাত্রদের মধ্যে তিনি বহু হয়েছেন, নিজের চিত্তকে সঞ্জীবিত করেছেন বহু চিত্তের মধ্যে। নিজেকে অকৃপণভাবে সম্পূর্ণ দান না করলে এ কখনও সম্ভবপর হত না। এই যে আত্মদানমুলক সৃষ্টিশক্তি এ দৈবীশক্তি। আচার্যের এই শক্তির মহিমা জরাগ্রস্ত হবে না। তরুণের হৃদয়ে হৃদয়ে নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধির মধ্য দিয়ে তা দূরকালে প্রসারিত হবে। দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ে জয় করবে নব নব জ্ঞানের সম্পদ।
আচার্য নিজের জয়কীৰ্ত্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে, পাথর দিয়ে নয়, প্রেম দিয়ে। আমরাও তার জয়ধ্বনি করি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২২ আগস্ট ১৯৩২
রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র ও গান্ধিজি
সাহিত্য যেমন রবীন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লচন্দ্রের মধ্যে একটি সাঁকো তৈরি করেছিল, তেমনি দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল দুজনার মধ্যে আর একটি সেতুবন্ধন। দেশের স্বাধীনতা ও সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লচন্দ্র উভয়ের সঙ্গেই গান্ধিজির আলোচনা ও পত্র বিনিময় হয়েছে। গান্ধিজির ত্যাগের আদর্শ দুজনকেই গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। অন্যান্য অনেক বিষয়ে সহমত পোষণ না করলেও ত্যাগের ব্যাপার প্রফুল্লচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই গান্ধিজিকে অসাধারণ শ্রদ্ধা করতেন। আচার্য রায় সম্বন্ধে গান্ধিজি বলেছেন,
“Acharya Ray, I had the privilage of knowing him for the first time when gokhale was his next door neighbour in 1901 and I was undergoing tntelage under the latter. It was difficult to believe that the man in simple indian dress and wearing simple manners could possibly the great scientist and professor he even then was. And it took my breath away when I heard that out of his prencely salary he kept for himself only a few rupees for himself and the rest he devoted to public was and perticulerly for helping poor students.”
তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে আচার্য রায়ের বেতন ৮০০/৯০০ টাকার মতো ছিল যেটা আজকের মূল্যে মাসে ৮/৯ লক্ষ টাকা হবে সেজন্যই মহাত্মা গান্ধি Princely salary-র কথা বলেছেন।
আচার্য রায় সারাজীবনে তার সঞ্চিত প্রায় দুই লক্ষটাকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে গেছেন। রসায়ন গবেষণায় উন্নতির জন্য। গান্ধিজি যেমন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে গিয়ে বহুবার অতিথ্য গ্রহণ করে শান্তিনিকেতনকে ধন্য করেছেন, তেমনি আবার ৯১ আপার সার্কুলার রোডে প্রফুল্লচন্দ্রের সামান্য ঘরখানিতে এসে প্রফুল্লচন্দ্রকেও ধন্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২ সালে গান্ধিজির অনশনের সময় ইংরাজিতে একটি বই লেখেন “Mahatma and the depressed humanity” তিনি জানতেন যে আচার্যদেব গান্ধিজির বিশেষ ভক্তি, সেইজন্য এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে।
সামাজিক আন্দোলনের নানা ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লচন্দ্র পাশাপাশি থেকেছেন। হিজলী রন্দি শিবিরে যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল ইংরেজ সরকার, তার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ শহীদ মিনারের পাদদেশে প্রতিবাদ সভা করেন। সেই সভায় রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক ভাষণ আমরা কেউ ভুলতে পারি না। বহু মানুষকে যে তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন এমনটা নয়। তবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন, নীলরতন সরকার ছিলেন।
১৯৩৩ সাল। আন্দামানে যারা বন্দি ছিলেন তাদের ফিরিয়ে আনতে কলকাতায় তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। আন্দামানের কারগারে বন্দিরা অনশন শুরু করেন। প্রফুল্লচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অনশন প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানান। সেকথা বন্দিরা মেনে নিয়েছিলেন। তখন গণমাধ্যমে হাজির হলেন প্রফুল্লচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। চার দফা দাবি পেশ করলেন—
(১) অনশনকারী তিনজন বন্দির মৃত্যুর তদন্ত করতে হবে।
(২) আন্দামানের কারাগারে বন্দি সকলের দাবি ও অভাব অভিযোগ মেনে নিতে হবে।
(৩) আন্দামান জেলে নতুন বন্দিপ্রেরণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
(৪) আন্দামানের কারাগারে যে বন্দিরা রয়েছেন, সকলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আন্দোলন ধীরে ধীরে গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। দুই মনীষীই সেখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। জনসাধারণের সহযোগিতা প্রার্থনা করে যে আবেদনপত্র তৈরি হয় তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ প্রফুল্লচন্দ্র ও স্যার আশুতোষ এবার আমরা চলে যাবো ১৯১৩ সালের ঘটনায়। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার ১৭ দিন আগে ২৮ অক্টোবর ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেটি স্যার আশুতোষ রবীন্দ্রনাথকে ডি. লিট ডিগ্রী দেবার প্রস্তাব রাখেন। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলরতন সরকার, অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ এগারোজন সদস্য। সভাপতিত্ব করেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্যার আশুতোষ প্রস্তাব দিলেন,
“Mr Rabindranath Tagore, the celebrated lyric poet, dramatist, and prose writer occupies at the present time a pre-eminent position in Bengal litarature. He has been a prolific writer on a variety of subjects, but only a very small portion of his work is available in English version, the best known is “Gitanjali” which on its first publication produced a profound impression upon men of culture who have no access to the original, indicating that the finest products of his imagination are charecterised by an element of beauty, patriotism and spiritnality, which is of perennial value and is independent of local and racial accidents.”
ইতিমধ্যে ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর কবির নোবেলপ্রাপ্তির খবর ঘোষিত হয়। শান্তিনিকেতনে সে সংবাদ আসে ১৪ নভেম্বর, ১৫ নভেম্বর সিনেটর সভায় নোবেল প্রাপ্তিসংবাদ ঘোষণা হয় আর ২৬ ডিসেম্বর লাভবনে বিশেষ সমাবর্তন করে রবীন্দ্রনাথকে সাম্মানিক ডি. লিট দেওয়া হয়, এই সঙ্গে ফরাসি কবি মিলভা লেভী ও ডক্টর অভ লিটারেচারে ভূষিত হন।
এইখানে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির খবরে কি ধরনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা জানানোর লোভ সংবরন করতে পারচ্ছি না। প্রমথনাথ বিশী লিখছেন—‘নোবেল প্রাইজ লাভের সংবাদ বহন করিয়া বোলপুরে যখন টেলিগ্রাম
আসে তখন রবীন্দ্রনাথ, নেপালবাবু প্রভৃতি আরও দু-একজন অধ্যাপকের সঙ্গে কাছেই কোথাও বেড়াইতে গিয়েছিলেন। সেখানে টেলিগ্রাম খানা পাঠাইয়া দেওয়া হয়। তিনি নীরবে টেলিগ্রামখানা পড়িয়া নেপালবাবুর হাতে দিয়া বলিলেন—“নিন, নেপালবাবু, আপনার ড্রেন তৈরি করবার টাকা।” তখন আশ্রমে টাকার টানাটানি চলছিল, একটা পাকা নর্দমা অধখনিত অবস্থায় পড়িয়াছিল।” রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র ও আশুতোষ আলোচনা প্রসঙ্গে আরও একজনের কথা বলতে হয়, তিনি হলেন ডঃ হেমেন্দ্রনাথ ঘোষ। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খাটেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯১৮ সালে ডাক্তারি পড়া শেষ করেন। ১৯২০ সালে প্যারিসের বিখ্যাত পাস্তুর ইন্সটিটিউটে যান। এই সময় তিনি অর্থ কষ্টে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ, তখন স্যার আশুতোষ মুখ্যেপাধ্যায়কে বলে তার বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। এই হেমেন্দ্রনাথ পরে প্রফুল্লচন্দ্রের তৈরি বেঙ্গল ইমিউনিটি ও বেঙ্গল কেমিক্যালে কিছুদিন কাজ করেন, এদেশে তিনি প্রথম সিরাম ও ভ্যাকসিন তৈরি করেন।
রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র এবং শিক্ষা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকেই জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (NCE) গঠনের পরিকল্পনা চলছিল। রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাপারে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেন, তবে প্রফুল্লচন্দ্রও এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বিশেষ করে NCE (National council of Education) যাতে কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ানো হয় সেই বিষয়ে উপদেশ দেন এবং এখানে থেকে পাশ করা ছাত্ররা যাতে বেঙ্গল কেমিক্যালসে উপযুক্ত চাকরি পায় তার ব্যবস্থা করেন। তাঁর স্মৃতিতে যাদবপুরে কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিল্ডিং ও ল্যাবরেটরীর নাম রাখা হয় পি.সি.রায় বিল্ডিং। রবীন্দ্রনাথ ও আচার্য রায়ের মধ্যে আরও একটি বিশেষ মিল ছিল, দুজনেই ছিলেন শিক্ষাগুরু বা আচার্য। পরাধীন ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দুজনেই ভীষণভাবে চিন্তিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সমস্ত ধনসম্পদ দিয়ে বিশ্বভারতী তৈরি করেছেন এবং তার স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য প্রাণপাত চেষ্টা করেছেন। তেমনি আচার্য রায় প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স কলেজে যে বিপুল বিজ্ঞানী ছাত্রসমাজ তৈরি করেছেন তারাই বহন করছে তার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। আচার্য রায় তাঁর লেখায় বারংবার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সম্পাদিত “তত্ত্ববোধিনী” পড়িয়া আমার প্রাণে জ্ঞানের স্পৃহা জাগিয়া ওঠে।”
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র সাধনা ও সিদ্ধি’ শিরোনামে ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে ১৩২৮ সালে যে বক্তৃতা দেন সেটি ১৩২৯ সালে প্রবাসীতে ‘বৈশাখ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ওই বক্তৃতার এক অংশে তিনি বলেছেন, আমরা অতীতের গর্ব করে থাকি। কিন্তু অতীতের প্রাণের লক্ষণগুলি আপনার জীবনে ফুটিয়ে তুলতে চাই না। অতীতের সিদ্ধির উপর আমাদের লোভটুকু যোলো আনা আছে, কিন্তু তার জীবনব্যাপী কঠোর সাধনার কথা শুনেই আমরা আতঙ্কে মরে যাই। রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভা আজ শতদল পদ্মের মতো বিকশিত হয়েছে। কিন্তু একটির পর একটি করে এই শতদল ফুটছে এর পেছনে আছে কঠোর একনিষ্ঠ সাধনা।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলার যখন সোভিয়েত দেশ আক্রমণ করেছে, পৃথিবীর দেশে দেশে লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানীদের অনেকেই বিশ্বশান্তির স্বপক্ষে লেখনী ধরেছেন। আমাদের পরাধীন, ভারতবর্যও বাদ যায়নি। বিশিষ্ট মনীষীদের বেশ কয়েকজন একটি ইস্তাহার রচনা করে ইউরোপে বিভিন্ন শাস্তি সম্মেলনে পাঠিয়েছিলেন। সেই ইস্তাহারে প্রথম দুটি নামছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, এছাড়াও ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরি, নন্দলাল বসু ও আরও অনেকে। ১৯৩৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসের শাস্তি সম্মেলনে এটি পাঠানো হয়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কবি ও বৈজ্ঞানিক। তাঁর বিশ্বপরিচয় (১৯৩৭) বইটি পড়লেই বোঝা যায় আধুনিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ছাত্রদের কাছে সহজ সরল ভাষায় অথচ বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যকে অবিকৃত রেখে লেখার জন্য, আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি। মেঘনাদ সাহার আয়নন তত্ত্ব (১৯১৫ ও ১৯২৪ সালের আবিষ্কার) প্রভৃতি দুরূহ। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ব্যাখ্যার জন্য তাঁকে কি পরিমাণ পড়াশোনা ও পরিশ্রম করতে হয়েছে তা বইটি না পড়লে বলে বোঝানো যাবে না। আর প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন। কাব্যরসিক ও বিজ্ঞানী। মিলটন, বায়রণ ও সেক্সপীয়ার ছিল তার অতিপ্রিয় বিষয়।
১৯১৯ সালে তার এক প্রিয় ছাত্র জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিতকে জার্মানিতে একটি চিঠিতে লিখছেন—“আমার মনে হয় যদি Calcutta University-তে History of Bengali literature সম্বন্ধে একটি চেয়ার স্থাপিত করিয়া আমাকে আহ্বান করে, 1 think I can do fair justice to it” বাংলা সাহিত্যে কত গভীর অনুরাগ ও নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস থাকলে এমন কথা বলা যায়। অনুমান করলেও শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে যায়।
আমরা জানি জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বে যে সখ্যতায় পরিণতি লাভ করেছিল, আচার্যদেবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সে রকম সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। কারণ রবীন্দ্রনাথ ও জদীশচন্দ্র দুজনেই ছিলেন দার্শনিক, প্রফুল্লচন্দ্র সে অর্থে অনেক বাস্তববাদী, কম ভাবুক, তবুও দুজনেই দুজনকে শ্রদ্ধা করতেন, পরিহাস করতেন, পারস্পরিক চিঠি আদানপ্রদান ছিল, সবার উপরে দুজনেই ছিলেন দেশমাতৃকার জন্য বলি প্রদত্ত, দুজনেই ছিলেন কুসংস্কার মুক্ত ‘হিন্দু ব্রাহ্মসমাজের পৃষ্ঠপোষক, দুজনেই বিশ্বাস করতেন “Hard work co-operative effort and judicious use of scientific technique can alone erradicate hunger in this country.”
ভারতবর্ষের দৈন্য, দুর্দশায় গভীর ব্যথা যথার্থ ভারতীয় শিক্ষার জন্য দুজনেই প্রচুর চিন্তা ও রচনা করে গেছেন, আর দুজনেই সুদীর্ঘ জীবনে দুজনের সান্নিধ্যলাভ ও একে অপরকে বোঝার চেষ্টা ও যথাসাধ্য সাহায্য করার সদিচ্ছা ও চেষ্টা করে গেছেন।
প্রফুল্লচন্দ্র “আত্মচরিত” গ্রন্থটি রচনা করেন জীবনের অপরাহ্ন বেলায় ১৯৩৭ সালে, এই বইতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বারংবার রবীন্দ্রনাথকে উদাহরণ। হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মনুষ্য সমাজে বংশানুক্রমের প্রভাব (আজকালকার জিনতত্ত্ব) সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলছেন, জাতিভেদ-পীড়িত ভারতেও এমন কতকগুলি প্রমাণ পাওয়া যায় যাহাতে মনে হয় কতকগুলি বিশিষ্ট গুণ বংশানুক্রমিক। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্য বহু প্রধান ব্যক্তির অবিভাব এই কথাই প্রমাণ করে।
আবার হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের সমালোচনায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ চিরদিনই “অচলায়তন” হিন্দু সমাজের নানা অর্থহীন প্রথা ও জীর্ণ আচারের নিন্দা করিয়াছেন। মহাত্মা গান্ধির ৬৩ তম জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীর নিকট যে বাণী প্রদান করেন তাহাতে তিনি বলিয়াছেন, “যুক্তিহীন কুসংস্কার জাতিভেদ এবং ধর্মের গোড়ামি এই তিন মহাশই আমাদের সমাজের ওপর এতদিন প্রভুত্ব করিয়া আসিতেছে। সমুদ্র পার হইতে আগত যে-কোনো বিদেশি শত্রুর চেয়ে উহারা ভয়ংকর। এই সব পাপ দূর করিতে না পারিলে, কেবলমাত্র ভোট গণনা করিয়া বা রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করিয়া আমরা স্বাধীনতা লাভ করিতে পারিব না।’
প্রতিভার সঙ্গে বিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষার যে-কোনো সম্পর্ক নেই সে কথা প্রমাণ করার জন্য আচার্যদেব বলছেন, পৃথিবীর মহৎ ও প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের যদি একটা হিসাব আমরা করি তাহা হইলে পাইব যে তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট, এমনকি কোনো বিশেষ শিক্ষাপ্রণালীর নিকট খননী নহেন। সেক্সপীয়ার গ্রিক ও ল্যাটিন অতি সামান্যই জানিতেন, আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ, অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শ্রেষ্ঠ নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার অতিক্রম করেন নাই।
আর এক জায়গায় লিখছেন, “লর্ড বায়রণ ও আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ অংকে অত্যন্ত কাঁচা ছিলেন এবং সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভঁহাদের সাফল্যের পথ রুদ্ধ হইয়াছিল।
রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র ও বিশ্বমানবতা রবীন্দ্রনাথের সমগ্রজীবন পর্থালোচনা করে আমরা দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ প্রথমে বাঙালি তারপর ভারতীয় এবং সবার শেষে বিশ্বমানব। যুগে যুগে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার এই উত্তরণ ঘটেছে। এটাই বাস্তব সত্য। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে কল্পনার সাহায্যে তাঁর প্রকৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। কারণ তার ব্যক্তি মানুষের, মন থেকে পৃথক স্বতন্ত্র অবস্থিতি নেই। তবে তার অর্থ এই নয় যে তিনি মানুষের মনের সৃষ্টি, সত্যি বলতে কি তিনি ব্যক্তিমানব থেকেও বেশি বাস্তব কারণ তার অবস্থিতি আরও ব্যাপক ক্ষেত্রে। ব্যক্তিমানুষের মনকে অতিক্রম করে তা সকল মানুষের মনে পরিব্যাপ্ত। রবীন্দ্রনাথ, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ‘Religion of man’ বইতে বলছেন,“মহামানবের ধারণা আমাদের কল্পনাশক্তির সাহায্যে করে নিতে হয়, তবে তা আমাদের মনের সৃষ্ট পদার্থ নয়। তিনি ব্যক্তিমানব হতে বেশি বাস্তব, তার ব্যাপক ব্যক্তিত্ব ব্যক্তিমনকে অতিক্রম করে আমাদের প্রত্যেককে ছাড়িয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের ধারণায় প্রতি ব্যক্তি মানুষের মধ্যে দুটি পৃথক কিন্তু পরস্পর সংযুক্ত সত্ত্বা, অবস্থান করে। তাদের একটি দৈনন্দিন সাংসারিক জীবন ধারণ নিয়ে ব্যস্ত কাজেই তার দৃষ্টি সংকুচিত। তার অতিরিক্ত তার মধ্যে একটি পৃথক সত্বা আছেন, যিনি ব্যক্তি জীবনের সংকুচিত দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধে উঠে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণ কামনা করেন। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ মহামানব বলেছেন। দুই অর্থে এই সত্ত্বা মহামানব। প্রথমত তিনি সকল ব্যক্তি মানবকে ব্যাপ্তি করে আছেন, দ্বিতীয়ত তিনি ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে উঠে ব্যক্তি মানুষকে সকল মানুষের কল্যাণকর্মে যোগ দিতে আহ্বান জানান, কবি নিজে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি বলছেন যে জ্ঞান প্রেম ও কর্মে মহৎ প্রেরণা হতে অতিরিক্তভাবে এই বিশ্বমানব-মন ব্যক্তি-মানুষকে শিল্প সৃষ্টি ও সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করে। তার ভাষায় ‘বিশ্বমানবকে প্রকাশ করার আকুতি হতেই আমরা শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টি করি।’
এই প্রসঙ্গেই তিনি অনুভব করেছেন মানুষের মধ্যে এমন একটি শক্তি আছে, যার আহ্বানে সকল মহৎ মানুষ ব্যক্তি স্বার্থ অতিক্রম করে মহৎ কর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে আত্মনিয়োগ করে।
“তারই পদে মানী সঁপিয়াছে মান ধনী সঁপিয়াছে ধন, বীর সঁপিয়াছে আত্মপ্রাণ। তাহারি উদ্দেশে কবি বিরচিয়া লক্ষ লক্ষ গান ছড়াইছে দেশে দেশে।” সেই অর্থে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রও বিশ্বমানব, যদিও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র কোথাও এই . বিশ্বমানবতার জয়গান জোর দিয়ে করেননি, যেটা রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে সব জায়গায় করেছেন। তবে রবীন্দ্রনাথের মতোই জোর গলায় আরও একজন বৈজ্ঞানিক বিশ্বমানবতার কথা বলেছেন। তিনি হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। সেজন্যই আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে গিয়ে তিনবার এবং মোট ছ’ বার আলবার্ট আইনস্টাইনের দেখা করেছেন, নানা দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সেজন্যই রবীন্দ্রনাথের সাথে আইনস্টাইনের এত গভীর সখ্যতা ও বন্ধুত্ব, কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
ডঃ নারায়ণ চন্দ্র ভট্টাচার্য
(লেখক ভাবা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী)