শিখদের প্রথম গুরু‚ গুরু নানকের শিক্ষা অনুসরণ কারী গুরু তেগ বাহাদুর ছিলেন শিখদের নবম গুরু। তাঁর রচিত ১১৫ টি কবিতা গুরু গ্রন্থ সাহেবে অন্তর্ভুক্ত আছে।
গুরু তেগ বাহাদুর ছিলেন গুরু হর গোবিন্দর পঞ্চম পুত্র।
গুরু তেগ বাহাদুর আনন্দপুর সাহেব নির্মাণ করে সেখানেই বাস করতেন। শৈশবে তাঁর নাম ছিলো ত্যাগমাল! মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তাঁর বাবার সাথে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার সাহস দেখিয়েছিলেন।
গুরু তেগ বাহাদুরের বাবা তাঁর সাহসিকতা দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর নাম ত্যাগমল পালটে রাখেন তেগ বাহাদুর।
ধৈর্য ও ত্যাগের প্রতিমূর্তি গুরু তেগ বাহাদুর বাবা বাকালা নামে এক জায়গায় ২০ বছর ধরে একাকীত্ব পালন করেছিলেন। অষ্টম গুরু হরকিষেন তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে বাবা বাকলের নাম ঘোষণা করেন ।
অষ্টম গুরু হরকিষেন রায়ের আকশ্মিক মৃত্যুর পরে তাঁকে জনগণের দাবি মেনে নবম গুরুর পদ প্রদান করা হয় ।
ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গুরু তেগ বাহাদুর বহু স্থান ঘুরেছিলেন। তিনি আনন্দপুর সাহেবের থেকে কায়রাতপুর, রোপার, সায়ফাবাদ পরিদর্শন করে খায়লা (খদল) পৌঁছেছিলেন।
গুরু তেগ বাহাদুর দমদমা সাহেবের মাধ্যমে কুরুক্ষেত্রে পৌঁছে সেখানে প্রচার করেন। তিনি আরও এগিয়ে গিয়ে কুরুক্ষেত্র থেকে যমুনা নদীর তীর বরাবর চলে গঙ্গার তীরে কারা-মানকপুরে ভ্রমণ করেন এবং সাধু ভাই মালুক দাসকে মুক্তি দেন।
গুরু তেগ বাহাদুর প্রয়াগ, বেনারস, পাটনা এবং আসামের বহু জায়গা ভ্রমণ করে ‚সেখানে তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করেছিলেন।
তিনি আধ্যাত্মিকতা এবং ধর্মীয়জ্ঞান প্রচার করেছিলেন।
গুরু তেগ বাহাদুর রক্ষণশীলতা, কুসংস্কারের সমালোচনা করে এক নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মানুষের হিতকল্পে তিনি ধর্মশালা তৈরি এবং কূপ খনন করে দেন। তাঁর তীর্থযাত্রা চলাকালীন ১৬৬৬ সালে পাটনায় তাঁর পুত্রের জন্ম হয়েছিল ‚ পরবর্তীতে যিনি দশম শিখ গুরু-গুরু গোবিন্দ সিং নামে পরিচিত হবেন।
গুরু তেগ বাহাদুর হলেন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং জীবনযাত্রার মূর্ত প্রতীক। সত্য ও চিরন্তন মূল্যবোধ রক্ষার জন্য তাঁর আত্মত্যাগ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
গুরু তেগ বাহাদুরের আত্মত্যাগ কেবল তাঁর ধর্মবিশ্বাসকে অনুসরণ করার জন্যই নয়, বরং সকলের মানবিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষার সুনিশ্চিত করার জন্যেও ছিল।
যেখানে গুরুজী শহীদ হয়েছিলেন সেই শিষগঞ্জ এবং রাকবগঞ্জ গুরুদ্বার তাঁরই স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছে। গুরু তেগ বাহাদুর বিশ্ব ইতিহাসের মহান সেইসব ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম যারা বিশ্বাস, মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি আদর্শ রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
চাঁদনী চৌক, দিল্লি, ২৪ নভেম্বর ১৬৭৫। আমাদের প্রিয় গুরু তেগ বাহাদুর প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ!
গুরু তেগ বাহাদুর কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করানোর বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় ১৬৭৫ সালে মুঘল শাসক আওরঙ্গজেব প্রকাশ্যে তাঁর শিরশ্ছেদ করেন।
মৃত্যুর ভয় কেবল আমাদের মনের একটি ধারণা মাত্র । আপনি আমাকে হত্যা করতে পারেন, আপনার উপর আমার ধর্ম চাপিয়ে দিতে পারেন । গুরু তেগ বাহাদুর হেসে আওরঙ্গজেকে বলেছিলেন।
কাশ্মীরি পণ্ডিতরা গুরু তেগ বাহাদুরের কাছে এসে ইসলামে ধর্মান্তরের জন্য তাদের উপর যে অত্যাচার চালানো হয় তা বর্ণনা করে।
গুরু তেগ বাহাদুর যখন উদ্বিগ্ন হয়ে এই সমস্যার সমাধানের জন্য চিন্তা-ভাবনা করছিলেন, তখন তাঁর নয় বছরের ছেলে গোবিন্দ তাকে এই উদ্বেগের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। বাবা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলে বলেছিলেন যে তাদের বাঁচাতে তাকে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হবে।
গুরু তেগ বাহাদুর পণ্ডিতদের বলেছিলেন, “আওরঙ্গজেবকে গিয়ে বলুন যে আমাদের গুরু যদি ইসলাম গ্রহণ করে তবে আমরা তাকে অনুসরণ করব। কিন্তু আপনি যদি তাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে ব্যর্থ হন তবে আমরাও তা করব না।
গুরু তেগ বাহাদুর আওরঙ্গজেবকে জবাব দিয়েছিলেন,”আপনি যদি অন্যকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেন তবে আপনি প্রকৃত মুসলমান নন ” কারণ ইসলাম এই শিক্ষা দেয়না ।
“কহে রে বান খোজন জাহি।
সরব নিবাসী সদা আলেপা তেহি সান সামাই।” কেন আপনি তাকে বনে অনুসন্ধান করছেন? তিনি সর্বদা আপনার সাথেই আছেন, তিনি সর্বব্যাপী।
“জন নানক সব হি মই হি পুরান এক পুরুষ ভগবানো।”
(রাগ বসন্ত হিন্ডোল, মহাল 9 পৃষ্ঠা ১১৮৬)
সকলের মধ্যে একজন ঈশ্বরই বসবাস করেন।
“সাধো গোবিন্দ কে বন্দো গাবাউ।
” মনস জনম অমলাকু পৈইও বির্থা কহি গাভাউ। “
(গৌরী মহল ৯, পৃষ্ঠা ২১৯)
হে মানব , গোবিন্দের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করুন ‚আপনার অমূল্যবান মানব জন্ম পেয়ে তা নষ্ট করবেন না।
” জগ রচনা সব ঝুট হ্যায় জানি লেহু রে মিত।
কহি নানক খিরু না রহে জিউ বালু কি ভীত।
হে মানব , এই পৃথিবী অসত্য, বালি প্রাচীর যেমন দীর্ঘকাল স্থির থাকে না তাই এই পৃথিবীও দীর্ঘকাল স্থির নয়।
” মাগান রাহিয়ো মাইয়া মই নিস দিনি ছুটি নামান কি কাই।
“(টোদি মহলা ৯, পৃষ্ঠা ৭১৮)
একজন মানুষ দিন রাত মায়ার পেছনে ছুটে বেড়ায়‚ তাও সে লোমনের মাৎসর্য থেকে মুক্তি পান না।
” জতন বহুত সুখ কে কীয়ে দুখ কেইও না কোই। কাহু নানক সুনি রে মন হরি ভাভে সো হোই। “একজন মানুষ আনন্দ পেতে গিয়ে তার অন্তহীন আকাঙ্ক্ষার জন্য আরও দুঃখ পায়।
তিনি চাঁদনী চক দিল্লিতে শহীদ হয়েছিলেন।সেখানে তাঁর স্মৃতিতে সীষগঞ্জ গুরুদ্বার নির্মিত হয়েছে।
গুরু গ্রন্থ সাহেবের মহল ৯ এ গুরু তেগ বাহাদুরের অনেক রচনা সংকলিত আছে।
শহীদ গুরু তেগ বাহাদুরের পুত্র গুরু গোবিন্দকে গুরু পদের প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি দশম গুরু হন।
সহনশীলতা, দয়া ও নম্রতার উদাহরণ ভ গুরু তেগ বাহাদুর নিজে ভয় না পেতে এবং অন্যকে ভয় না দেখাতে বলেছিলেন।
গুরুজী অন্যের অধিকার ও বিশ্বাস রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
গুরু তেগ বাহাদুর আমাদের দেখিয়েছিলেন যে নিজের ধর্ম অন্য যে কোনও রিলিজিয়নের চেয়ে বড় । তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন যে ঈশ্বরের সুরক্ষার দরকার নেই, বরং নিপীড়িত মানুষের তার প্রয়োজন আছে এবং মানবতার চেয়ে বড় ধর্ম আর নেই।
ঠিক ৩৪৪ বছর আগে মোগল শাসক আওরঙ্গজেব তার (গুরু তেগ বাহাদুর) মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন কারণ তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করেছিলেন। এই সত্যি ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো কখনোই আমাদের বিদ্যালয় গুলিতে শেখানো হয়না।
(নবম গুরু এবং গুরু গোবিন্দ সিংহের পিতা) গুরু তেগবাহাদুরকে দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয় এবং তাঁর বিশ্বাসকে ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করতে বলা হয়। গুরুজী তা প্রত্যাখ্যান করলে ১৬৭৫ সালে দিল্লির চাঁদনী চকে জনসমক্ষে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের রক্ষাকল্পে গুরু তেগ বাহাদুর মৃত্যুদণ্ডকে আলিঙ্গন করে নেন । আওরঙ্গজেব কর্তৃক এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
গুরুজীর আত্মত্যাগ আমাদের সকলকে জাতি, বর্ণ বা লিঙ্গ নির্বিশেষে মানবতার জন্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও নিঃস্বার্থ সেবায় নিজেকে উত্সর্গ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
গুরু হররায়ের পুত্র গুরু হরিকিষেন ৫ বছর বয়সে ৮ম গুরু হিসাবে দায়িত্ব নেন। এবং ৭ বছর বয়সে আত্মত্যাগ করেন।
ঠিক যেমন তার বাবারও আয়ুর্বেদে জ্ঞান ছিলো ‚ তিনিও দিল্লিতে গুটিবসন্তের মহামারীতে আক্রান্ত ১৬৬৩ জন লোকের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। গুরুদ্বার বাংলাসাহিব ৯ম গুরু তেগ বাহাদুরের নামে পরিচিত।
গুরু তেগ বাহাদুর আমাদের সমস্ত মানবজাতির ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্ব শিখিয়েছিলেন। আমরা শ্রদ্ধা জানাই গুরু তেগ বাহাদুরকে, যিনি কাশ্মিরী পণ্ডিতদের রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন । আর্টিকেল ৩৭০ হলো বর্তমানে আওরঙ্গজেবেরই নতুন প্রতিমূর্তি!
তিনি আমাদের আমাদের নীতিগুলির প্রতি অটল থাকার এবং অন্যের জন্যে আত্মত্যাগ করার গুরুত্ব শিখিয়েছেন ।
ভাই মতি দাস. শিখ ইতিহাসের অন্যতম মহান শহীদ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আদেশে তাঁর ছোট ভাই ভাই সতীদাস ও ভাই দয়ালদাস সহ নবম গুরু গুরু তেগ বাহাদুরের সমস্ত শিষ্যকে গুরুর সাথে দিল্লিতে হত্যা করা হয়েছিল।
ইতিহাস থেকে কখনো বিস্মৃত হবেনা এমন যা কিছু বিষয় আছে তার মধ্যে একটি হ’ল শিখ গুরু এবং তাদের অনুসারীদের বীরত্ব ও সাহসিকতা।
ইসলামকে অস্বীকার করেছিলেন বলে আওরঙ্গজেবের আদেশে ভাই মতি দাসকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত উল্লম্বভাবে চিড়ে দেওয়া হয়।
তাঁর বলিদান দিবসে এটি তার প্রতি একটি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।