গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ির বড়ো কর্তা হাতের খবরের কাগজটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে তার স্ত্রীকে ডেকে বললেন মেজো বউকে একবার ডেকে দাও তো। একগলা ঘোমটা দিয়ে ভাসুর ঠাকুরের সামনে এসে দাঁড়ালেন কাদম্বিনী। ডেকেছেন দাদা? ভাসুরের কন্ঠে যেন মেঘ ডাকলো। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা বঙ্গবাসী পত্রিকাটি দেখিয়ে বললেন, পড়ে দেখো। তোমার জন্য তোমার স্বামীর, আমাদের পরিবারের সম্মান আজ কোথায় নেমেছে। নিজের জেদটাকেই চিরকাল বড়ো করে দেখলে। আর দ্বারকাও তোমার তালেই তাল দিয়ে গেলো। ছি ছি, খবরের কাগজ দেখে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।
কৌতূহলের সঙ্গে পত্রিকাটি তুলে নিলেন কাদম্বিনী দেবী। প্রথম পাতাতেই চোখ আটকে গেলো। কান মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো রাগে। কী নির্লজ্জ আক্রমন, কী কুৎসিত কার্টুন। দ্বারকানাথ রূপী একটি ভেড়া, তাকে দড়ি বেঁধে ঘোরাচ্ছেন কাদম্বিনী। তার পাশে রসিয়ে রসিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে তার খবর। রাত বিরেতে কলে যাওয়ার জন্য তুলনা করা হয়েছে বারবনীতার সঙ্গে।”ফিজ দিলেই শহরে মিলবে যুবতী ডাক্তারের সেবা।” কি নির্লজ্জ ইঙ্গিত।
রাগে অভিমানে চোখে জল এলো তার। একটা মেয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচবে, ঘর সংসার সামলে পড়াশোনা করবে, তাতে সমাজের এতো জ্বালা কিসের? তার স্বামী এতে সমর্থন দিয়েছে বলে এতো কুরুচিকর আক্রমন!! আর বাইরে কাকে বলবেন? তার ভাসুর, তার শ্বশুরবাড়ির সকলেই তো অমনটাই ভাবেন। তবে স্বামী পেয়েছেন ভাগ্য করে। নারী উন্নতির ফাঁকা বুলি না, মন থেকে বিশ্বাস করেন নারীদের শিক্ষা,নারীদের সাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা। নিজের স্ত্রীর পাশে সর্বান্তকরণে দাঁড়িয়েছেন সবসময়।
দোষ কী কাদম্বিনীর? ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম মহিলা স্নাতকের ডিগ্রী লাভ করার পর তিনি চেয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। বাধা এসেছিল পদে পদে। প্রথমে সমাজ, প্রতিবেশী, আত্মীয় সকলে চমকে উঠেছিল। সে কি! মেয়ে পড়বে ডাক্তারি! সব ছেলেদের মাঝে একা! শরীর নিয়ে শিক্ষা। ইজ্জত থাকবে সেখানে? সমাজ কী বলবে? চারদিকে নেতিবাচক কথার মাঝে সায় দিলেন বাবা। তুই ডাক্তারী পড়। সমাজের ফালতু কথায় কান দিসনা। মহিলা ডাক্তার খুব দরকার এই পোড়া দেশের। এরা ধর্ম ধরে বসে থেকে বাড়ির মেয়েদের পুরুষ ডাক্তার দেখাবে না, আবার মেয়েদের ডাক্তারও হতে দেবে না। মাঝখান থেকে মরবে ঘরের মেয়েগুলো।
ডাক্তারি পড়ার সময়ও নানা অসুবিধা। ছাত্রদের থেকে তার প্রতি আগ্রহ যেমন ছিলো, টিপ্পুনি ও ভেসে আসতো সময় সময়। সে যেন অন্য গ্রহের জীব।সে প্র্যাকটিকাল ক্লাস কী ভাবে করবে?স্টুডেন্টরা পরস্পরের শরীর চেক আপ করে। কাদম্বিনীর ক্ষেত্রে কী হবে? সেই সময় এগিয়ে এলেন এক শিক্ষক। দাড়ি গোঁফ ওয়ালা ঋষিতুল্য চেহারা। তিনি বললেন এইসব নিয়ে ভেবোনা। আমি ব্যবস্থা করে দেবো। যে কোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসতেন তিনি। উৎসাহ দিতেন। কখন যেন কাদম্বিনীর লড়াইয়ের শরিক হয়ে গেলেন সেই শিক্ষক। ভরসা পরিনত হলো প্রণয়ে। সেই থেকে লড়াইয়ের সঙ্গীকে জীবনের সঙ্গী করে নিলেন কাদম্বিনী। বয়সে ১৮ বছরের তফাৎ,বিপত্নীক কিছুই বাধা হলো না। ব্রাহ্ম সমাজের নেতা, সমাজ সংস্কারক এই লোকটির মধ্যে কাদম্বিনী খুঁজে পেলেন এক প্রকৃত মানুষকে। তাঁর উৎসাহ ও চেষ্টাতেই কাদম্বিনী পেলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে ইওরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিগ্রি।
সেই উদার মানবতাবাদী সমাজসংস্কারক মানুষটির নামে এমন কুৎসা! শিক্ষা দিতে হবে বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশ পালকে। আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। দ্বারকানাথ বললেন, ছেড়ে দাও, কী দরকার এইসবে? কিন্তু কর্তব্যে অটল কাদম্বিনী। বললেন, না। এই লড়াই আমার নিজের জন্য নয়, বাংলার ঘরে ঘরে যেসব মেয়েরা শিক্ষার জন্য গুমরে মরছে, সমাজের ভয়ে এগোতে পারছে না। এ লড়াই তাদের জন্য। যাতে শিক্ষার জন্য এগিয়ে আসা নারীদের কেউ কলঙ্ক লাগাতে না পারে, এ লড়াই তার জন্য লড়াই। লড়লেন তিনি। মহেশ পালকে ১০০ টাকা জরিমানা আর ৬ মাসের কারাবাসের ব্যবস্থা করে তবে থামলেন।
আইনের লড়াইতে জিতলেও,সমাজের লড়াইতে জয়ী হওয়া অতো সহজ ছিলনা। রক্ষণশীল সমাজ রীতিমতো ঘৃনার চোখে দেখতো তাকে। এমনই এক পরিবার ছিল কলকাতার রায়চৌধুরী পরিবার। গৃহকর্তা মনে করতেন মেয়েদের স্থান অন্দরমহলে। আধুনিক শিক্ষা বিগড়ে দেয় মেয়েদের। সেই পরিবারের আদরের কন্যা সন্তানসম্ভবা। মেয়েকে নিজের কাছে আনিয়ে রাখলেন। একদিন রাত্রে প্রসব বেদনা উঠলো। ধাই মা বলা ছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলো। মেয়ে তখন যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। পরিবারের চিকিৎসকের ডাক পড়লো।তিনি পর্দার বাইরে বসে শুনে শুনে নিদান দিতে শুরু করলেন। ধাই সুবিধা করতে পারলেন না। আসতে আসতে এলিয়ে পড়তে লাগলেন সুলতা। ডাক্তার সেন কর্তাকে ডেকে বললেন, এইভাবে চিকিৎসা সম্ভব না। যদি পুরুষ ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা না করান, কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে কল দিন। সম্প্রতি লন্ডন থেকে বিরাট ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন। একটু ইতস্তত করে কর্তা বললেন, এই রাত্রে তিনি আসবেন? সমাজ কী বলবে তাকে? ঝংকার দিয়ে উঠলেন ডাক্তার সেন। সমাজ বলতে তো আপনাদের মতো গোঁড়া লোকেরা। আধুনিক পৃথিবীতে তাদের মতামতের কোনো দাম নেই শিক্ষিতদের কাছে। আপনারা এবার মুখ বন্ধ রাখুন। মেয়েটাকে বাঁচান আগে।
লজ্জা, সংস্কার, ঐতিহ্যের অহংকার চেপে রেখে রায়চৌধুরী বাড়ির গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো কাদম্বিনীর দ্বারে।কাদম্বিনী জানতেন এই রক্ষণশীল পরিবারটিকে। গাঙ্গুলিদের সমাজচ্যুত করার জন্য তারা খু্বই সচেষ্ট ছিলেন।সেই পরিবার আজ তার শরণাগত। মুহূর্তে তৈরি হলেন তিনি। গাড়িতেই শুনে নিলেন কেস হিস্ট্রি। তৈরি হলেন মনে মনে, আজ তার আসল পরীক্ষা। রায়চৌধুরী বাড়িতে সেদিন যমে মানুষে টানাটানি। খুব ক্রিটিকাল কন্ডিশন। পেশেন্ট খুব খারাপ অবস্থায়। তিনি বললেন আপনাদের গাফিলতিতে আজ এই পরিস্থিতি। পেশেন্টকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু বেবির কোনো গ্যারান্টি নেই। অবশেষে বেরিয়ে এলেন ক্লান্ত কাদম্বিনী দেবী। ঘরের ভেতরে কান্নার আওয়াজ। না সে আওয়াজ দুঃখের নয়, কচি গলার কান্না, স্বস্তির কান্না। রায়চৌধুরী বাবু এগিয়ে এলেন। কাদম্বিনী গম্ভীর মুখে বললেন আপনার মেয়ে সুস্থ আছে। বেবিও পুরো ফিট। নাতনি হয়েছে আপনার। প্রৌঢ়ের চোখে চকচক করে উঠলো জল। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাই? আশীর্বাদ করুন এই মেয়ে যেন আপনার মতোই ডাক্তার হয়। আপনার ফিজ কতো দেবো মা? হঠাৎ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেলো কাদম্বিনীর গলা। ফিজ দিতে হবে না। যেটা বললেন সেটাই করুন। মেয়েটাকে শিক্ষা দিন। বিকশিত হতে দিন কুঁড়ি গুলিকে।হুস করে বেরিয়ে গেলো কাদম্বিনীর গাড়ি।
এই হলেন কাদম্বিনী। সমাজের কলঙ্ক গায়ে মেখেও সংকল্পে ছিলেন অটুট। রক্ষণশীল পরিবারের মহিলাদের অসুস্থতায় ডাক পেলেই যেতেন রাতবিরেতে। চিকিৎসার বিনিময়ে সংকল্প করিয়ে নিতেন মেয়েদের শিক্ষা দেবার। তাঁর থেকে সাহস পেয়ে, তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু নারী এগিয়ে এসেছেন নিষেধের বাধা ঠেলে। এগিয়েছে সমাজ, এগিয়েছে দেশ।আজ ভারতের যত মহিলা চিকিৎসক, সবার কাছে তিনি ভগীরথ, পথপ্রদর্শক।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, শুধু চিকিৎসক নন, এক লড়াই, এক সংস্কারক, এক প্রেরণা।কিন্তু তিনি আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে। তাঁর নামে হয়নি মেডিকেল কলেজ,রাস্তা,মূর্তি কোনো কিছুই। তিনি তা চান ও নি।যা চেয়েছেন তা হয়েছে,হাজারে হাজারে মেয়ে নিচ্ছে চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ।স্বপ্ন দেখছে চিকিৎসক হবার। সেই স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন তিনি |
প্রয়াণ দিবসে প্রণাম জানাই তাঁকে।