মিরটেসী (Myrtaceae) পরিবারের একটি ফল পেয়ারা, উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম Psidium guajava, এই পরিবারের অন্য ফলগুলির নাম জাম, গোলাপজাম, জামরুল। পেয়ারার ফলটি একধরনের বেরি (Berry)। ভারতের প্রায় সব প্রদেশেই পেয়ারা জন্মায় এবং অর্থকরী চাষ হতে দেখা যায়। কারণ এর ফলনক্ষমতা অত্যধিক, গাছ যথেষ্ট সহিষ্ণু, নানান প্রাকৃতিক পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারে, সবচেয়ে বড় বিষয় এই ফলে ভিটামিন – সি অধিক মাত্রায় রয়েছে। ফলের পুষ্টিমূল্য যেমন অধিক, প্রতি বছর ফলনও হয় যথেষ্ট, বেশি কৃষি উপকরণ ব্যতিরেকেই অধিক আয় করা সম্ভব। আর এ কারণেই পেয়ারা চাষ অর্থকরী পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রায় কোনো সমস্যা যেমন অধিক তাপমাত্রা, গরম লু বাতাস, বৃষ্টিপাত, মাটির লবণাক্ততা, অভাবী মৃত্তিকা, জল জমার প্রবণতাযুক্ত অঞ্চল, সর্বোপরি সেচের জলের অভাব, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের অভাব এই ফসল চাষে তেমন বাধা হয়ে ওঠেনি।
সারা ভারত বর্তমানে পেয়ারা চাষ হলেও, এটি কিন্তু ভারতের আদি ফসল নয়। সম্ভবত ক্রান্তীয় মেক্সিকো থেকে পেরু হয়ে পর্তুগীজদের দ্বারা ভারতে আসে এই ফল, তাও সপ্তদশ শতকে। তারপর এই ফলটি এ দেশের জলহাওয়ায় মানিয়ে নিয়েছে এবং এতটাই যে আজ কে বলবেন যে গাঙ্গেয় পলিঘটিত মৃত্তিকার দেশীয় ফল নয় পেয়ারা! গাঙ্গেয় উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম প্রধান ফল হচ্ছে পেয়ারা।
পেয়ারা ভিটামিন-সির এক অপূর্ব আধার। লেবুর তুলনায় দুই থেকে পাঁচগুণ এবং টমেটোর চাইতে কোনোক্ষেত্রে প্রায় দশগুণ অধিক ভিটামিন-সি থাকে পেয়ারায়। অপরাপর ফলের চাইতে পেয়ারায় মাঝারি ভালো মাত্রায় ক্যালসিয়াম, বেশ খানিকটা ফসফরাস এবং লোহার ভালো মাত্রার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পেয়ারা দিয়ে তৈরি হয় নানান প্রক্রিয়াকৃত খাদ্য যেমন জেলি, জ্যাম, চীজ, পুরি, জুস, পাউডার ও নেক্টার।
জলবায়ুঃ পেয়ারা বিবিধ জলবায়ুগত পরিবেশে জন্মাতে দেখা যায়। অতি উচ্চ তাপমাত্রা সইতে পারলেও, ক্রান্তীয় জলবায়ুর তুলনায় পেয়ারায় পর্যাপ্ত ফলন দেখা যায় বরং সেই অঞ্চলে যেখানে শীতকালটা বেশ সুনির্দিষ্ট। তবে এটা ঠিক অন্য ফসলের চাইতে পেয়ারার খরা সইবার ক্ষমতা অনেক বেশি। ১৫-৪৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পেয়ারা জন্মাতে কোনো অসুবিধে নেই। নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় পর্যাপ্ত তাপমাত্রা ব্যতিরেকে অনেক সময় অর্থকরী পেয়ারা চাষে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এবং ফুল ফোটা থেকে ফল চয়নে সময় লেগে যায় প্রায় ২০০ দিন।
সমুদ্র-সমতল থেকে ১৫০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত পেয়ারা সহজেই জন্মায়। ৬৫০ মিটার উচ্চতার মধ্যে পেয়ারা গাছ বেশ তাগড়াই ও বড়সড় হয়ে জন্মায়, ফল ধরেও ভালো। কিন্তু তার চাইতে বেশি উচ্চতা হয়ে গেলে ফলন ধীরে ধীরে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং তা প্রভাবিত হয় তাপমাত্রার ফারাক ও মেঘের উপস্থিতির উপর। উচ্চ এলাকায়, মেঘ ও কুয়াশার আবরণে গাছের পাতা হয় ছোটো, শীতের সময় পাতার অ-শির এলাকার কোষকলায় লাল বা বেগুনি আভা ফুটে ওঠে।
পেয়ারা ভারী হাওয়া সইতে পারে। এর শেকড়তন্ত্র সূক্ষ্ম মাদুরের ন্যায় মাটির উপরের স্তরে বেছানো থাকে। তাই মাটির গভীরতা ঠিক থাকলে প্রচণ্ড আনুভূমিক বাতাসের বেগ ছাড়া গাছ উল্টানো সহজ কথা নয়। পেয়ারার কাষ্ঠল অংশটিও শক্তপোক্ত,কমনীয়, এবং প্রবল হাওয়ার তোড়ে গাছ ও শাখাপ্রশাখা বেঁকে যেতে সক্ষম, ফলে গাছ উপড়ানোর ঘটনা সহজে ঘটে না। তবে প্রবল হাওয়ায় গাছের বৃদ্ধি ও ফলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এটা তখনই প্রবল আকার ধারণ করে যখন হাওয়ার বেগ ঘন্টায় ১০ থেকে ১৫ মাইল হয়। পেয়ারা চাষের জন্য বছরে ৫০০-১০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত প্রয়োজনীয়। বৃষ্টিপাত হতে হবে সুষম, ক্রমান্বয়ে খরা ও ভেজা অবস্থা পেয়ারায় ফলন বাড়ায়। ফলের গুটির সংখ্যা কমে যায় যদি ফুল আসার সময় খরা ও জলের ঘাটতি দেখা দেয়। তবে ফল যদি অতি আর্দ্র পরিবেশে পাকে, তার উৎকর্ষতা কমিয়ে দেয়।
মাটিঃ ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ ফলের মধ্যে পেয়ারাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফসল যা মাটির নোনাভাব সইতে পারে। প্রান্তীয় অভাবী মাটিতে প্রায় বিনা যত্নেই পেয়ারা জন্মায়। নানান মাটিতে পেয়ারা ফললেও (ক্ষারাম্ল মান ৪.৫ থেকে ৯.৫) ভালো মানের পেয়ারা পেতে মাটিতে ক্ষারাম্ল মান থাকতে হবে ৫ থেকে ৭ এর মধ্যে।
পেয়ারার জাতঃ ভারতীয় ফল বাগিচার জন্য এলাহাবাদ সফেদা ও সরদার (এল -৪৯) দুটি জাত। তবে ইদানীং উদ্ভাবিত কয়েকটি সংকর জাতের পেয়ারা যেমন ললিত, পন্থ প্রভাত, ধারীদার আর্কা মৃদুলা, আর্কা অমূল্য, সফেদ জাম, কোহির সফেদা প্রভৃতির ফলন ভালো, উৎকর্ষতা চমৎকার এবং বাগানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
এলাহাবাদ সফেদা জাতের পেয়ারার গাছ বড়সড়, মাঝারি উচ্চ, সোজা তার বৃদ্ধি, ফলন উচ্চ, পাতাগুলো ঘন, বিটপের দৈর্ঘ্য বেশি। গাছের চূড়া চওড়া, ঘন, গম্বুজাকৃতি। ফল মাঝারি, গোল, খোসা মোলায়েম, শাঁস সাদা তাতে খুব কম সংখ্যক বীজ রয়েছে। ফল সংরক্ষণ করা যায় অনেকদিন।
সরদার (এল-৪৯) জাতের পেয়ারা গাছ মাঝারি খর্ব, ছড়ানো, ডালপালা অধিক, চূড়াটা সমতল। অতিশয় ফলনদায়ী, ফল বড়, গোলাকার থেকে ডিম্বাকৃতি, খোসার রঙ প্রিমরোজ-হলুদ, শাঁস সাদা রঙের, বীজ নরম এবং প্রচুর সংখ্যায় থাকে।
নির্দিষ্ট এলাকার পেয়ারার কয়েকটি জাত হলঃ চিত্তিদার, রেড ফ্লেশড্, পিয়ার সেপেড, অ্যাপেল কালার, আনাকাপালি, বেনারসী, সুর্খা, হাবসী, সঙ্গম, সিডলেস, ঢোলকা, সিন্ধ, কেরালা, মীর্জাপুরী, সিডলিং, নাসিক, সুপিরিয়র, পর্তুগাল, সুপার অ্যাসিড, স্মুথ গ্রীন, সুপিরিয়র সাওয়ার লুসিডিয়াম, হোয়াইট ফ্লেসেড্, বেহাত কোকোনাট, স্মুথ হোয়াইট, আমসাফ্রি, মধুরিয়াম, বারিয়ামপুর, হরিঝা, ধারওয়ার, সাফ্রি, সুপ্রিম, হোয়াইট সুপ্রিম, সাহারাণপুর সিডলেস, ব্যাঙ্গালোর, ভাবনগর, গোয়ালিয়র -২৭, কাফ্রি (ন্যাসপাতি আকার), কাফ্রি (গোলাকার), রেওয়া-৭২, হাজি সাহেব, গিনি, অ্যাসর্টেড বেঙ্গল, নাগপুর সিডলেস, হিসার সফেদা, হিসার সুরখা, কোহির, থাইল্যান্ড গোয়াভা, ফিলিপিন গোয়াভা, ফ্যান রিলিফ, রিভারসাইড, স্টোন অ্যাসিড, ফ্লোরিডা সিডলিং ইত্যাদি।
সম্প্রতি উদ্ভাবিত পেয়ারার জাতের মধ্যে ললিত জাতটি নির্বাচিত করা হয়েছে এলাহাবাদ জাতটি থেকে, লক্ষ্মৌর সিআইএসএইচ থেকে তা অর্থকরী চাষের জন্য মুক্ত করা হয়েছে। এর ফলের আকার মাঝারি, ওজন ১৮৫ গ্রাম, খোসার রঙ গেরুয়া-হলুদ, তাতে লালের আভা। শাঁসের গ্রোথন মজবুত, রঙ গোলাপী, শাঁসে অম্ল-মধুরতার মেলবন্ধন বেশ সুন্দর। জনপ্রিয় জাত এলাহাবাদ সফেদার চাইতে এর ফলন ২৪ শতাংশ বেশি। এই জাতটি রেকাবিতে পরিবেশন এবং প্রক্রিয়াকরণ উভয় ভাবেই ব্যবহার করা যায়। এর শাঁস থেকে তৈরি পানীয়ে গোলাপি রঙ টিকে থাকে এক বছরেরও কিছু বেশি সময়। এ জাতটি থেকে প্রস্তুত জেলির গন্ধ এবং উপস্থাপনা অতি মনোরম।
পন্থ প্রভাত জাতটি নির্বাচন করেছে উত্তরাঞ্চলের পন্থনগরস্থ গোবিন্দ বল্লভ পন্থ ইউনিভারসিটি অফ এগ্রিকালচার এণ্ড টেকনোলজির হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট। এই জাতটি খাঁড়া বাড়ে, পাতাগুলি বড় আকারের, ফলন উচ্চ (প্রতিটি গাছে ১০০-১২৫টি), ফল গোলাকার, মাঝারি আকারের (১৫০-১৭২ গ্রাম), খোসা মসৃণ এবং হালকা হলুদ রঙের, ফলের শাঁস সাদা, বীজগুলি ক্ষুদ্রাকার এবং নরম এবং তা সরদারের মতই। ফল মিষ্টস্বাদের, তার আকর্ষণীয় গন্ধ। এই জাতে অ্যাসকরবিক অ্যাসিডের পরিমাণ ১২৫ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম (প্রতি ১০০ গ্রাম ফলের মধ্যে)। মোট দ্রবণীয় কঠিনের মাত্রা ১০.৫ থেকে ১৩.৫ ডিগ্রি ব্রিকস।
ধারীদার জাতটি নির্বাচিত হয়েছে রেওয়ার কুথুলিয়া ফল গবেষণা কেন্দ্রে রক্ষিত বীজের তৈরি পুরনো পেয়ারা বাগান থেকে। এই জাতটি খুব বড়সড়, মাঝারি উঁচু (৪.৫ থেকে ৫.৫ মিটার) যাতে সোজা ও খাড়া শাখাপ্রশাখা রয়েছে এবং মাথাটি সমতল। পাতাগুলি মাঝারি আকারের (১০.২ X ৪.৭ সেমি), পাতার আকার ইলেপটিক ওভেট থেকে অবলঙ। ফল মাঝারি থেকে বড় আকারের (৭.৭৮X৮.২৩),ফলের গড় ওজন প্রায় ২০০ গ্রাম, ফল ডিম্বাকৃতি, তাতে ৫-৭ টি লাইন যেন পরিপক্ব ফলে ফুটে উঠতে দেখা যায়, খোসা সবুজাভ হলুদ, শাঁস নরম এবং মিষ্টি (মোট দ্রবণীয় কঠিন ১১.৭ ডিগ্রি ব্রিক্স), বিজারিত শর্করার মাত্রা ৪.৩১%, অবিজারিত শর্করা ৫.৪২%, অম্লত্ব ০.৩২%, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড ২০০ মিলিগ্রাম /১০০ গ্রাম ফলের মধ্যে।
আর্কা মৃদুলা জাতটি এলাহাবাদ সফেদার বীজ থেকে তৈরি গাছ নির্বাচন করে উদ্ভাবিত। উদ্ভাবক বেঙ্গালুরুর ভারতীয় ফল গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IIHR)। এর ফল মসৃণ, মাঝারি আকার (১৮০-২০০ গ্রাম), বীজ নরম (১০০টি বীজের ওজন ১.৬০ গ্রাম), শাঁস সাদা, মিষ্টি (মোট দ্রবণীয় কঠিন ১২.৫ ডিগ্রি ব্রিক্স), পেকটিনের পরিমাণ ভালো (১%), সংরক্ষণ কালও উত্তম।
আর্কা অমূল্য জাতটি সিডলেস ও এলাহাবাদ সফেদা জাতের সঙ্কর। জাতটি উদ্ভাবিত হয়েছে বেঙ্গালুরুর ভারতীয় উদ্যানপালন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে। গাছ মাঝারি বলিষ্ঠ এবং প্রচুর ফলদায়ী। ফলের আকার মাঝারি (১৮০-২০০ গ্রাম), সাদা ও মিষ্টি স্বাদ (মোট দ্রবণীয় কঠিন ১২.৫ ডিগ্রি ব্রিক্স), খুব ছোটো মাপের নরম বীজ (১০০ টি বীজের ওজন ১.৮ গ্রাম)। ফলের সংরক্ষণ কাল ভালো।
সফেদ জাম জাতটি এলাহাবাদ সফেদা ও কোহির জাতের সঙ্কর, সাঙ্গারেড্ডির ফল গবেষণা কেন্দ্র থেকে জাতটি উদ্ভাবিত হয়েছে। গাছ মাঝারি উচ্চতার, ফলন বেশি, ফলের আকার গোল, খোসা পাতলা, স্বাদু শাঁস, বীজ নরম।
কোহির সফেদ জাতটি কোহির ও এলাহাবাদ সফেদা জাতের একটি সঙ্কর। গাছের আকার বৃহৎ এবং গম্বুজাকৃতি, ফল স্বাদে অম্ল, আকারও বড়সড়।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
তথ্যসূত্রঃ কেন্দ্রীয় নাতিশীতোষ্ণ বাগানী প্রতিষ্ঠান, লক্ষ্মৌ।