১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লবের গুরুত্ব যতই থাক তার পরিধি কিন্তু খুব বিস্তৃত ছিল না। কার্যতঃ উত্তর প্রদেশের ব্যাপক অঞ্চল ও দিল্লির সন্নিহিত কিছু অঞ্চলেই বিপ্লব ছিল সিপাহীদের বিপ্লব। বিহারের জগদীশপুরে এবং অন্য কোনও কোনও অঞ্চলে যা ঘটেছিল তাকে গণ-বিপ্লবই বলা যেতে পারে, তার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে লঘু করে দেখারও কোনও কারণ নেই। কিন্তু সেখানে সিপাহিদের ভূমিকা মুখ্য ছিল না। সরকারের দিক থেকে সেই বিপ্লব দমনের সমস্যাও তেমন তীব্র ছিল না।
সিপাহি বিপ্লব ব্যর্থ হবার নানা কারণ ছিল। কোনও ঘটনা এভাবে না ঘটে অন্য কীভাবে ঘটলে কী হত সার্ধশতাব্দীর অধিক কালের ব্যবধানে সেই অলস কল্পনারও হয়ত তেমন মূল্য নেই। কিন্তু সিপাহি বিপ্লব ঘটেছিল। সেই বিপ্লবে সাময়িক ভাবে হলেও এমন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল যে ভারত থেকে বিদেশী শাসককে হয়ত চলে যেতে হত। এই সম্ভাবনা সৃষ্টির মূল কারণ ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে ইংরেজের নিজের হাতে গড়া সেনাদলের একাংশের অভ্যুত্থান। সিপাহি বিপ্লব অভ্রান্ত ভাবে এই ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, দেশী সিপাহিদের নিমকের প্রতি আনুগত্য সব সময় দেশপ্রেমের চেয়ে বড় নয়।
এক বছরের সিপাহি বিপ্লব দমন করতে ইংরেজকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপ্লব দমনে বিদেশী সরকার সফল হয়েছিল। বিপ্লব এমন পরিপূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল যে ইংরেজ সরকার ধরেই নিয়েছিল যে, তার পর থেকে ভারত শাসনের ব্যাপারটা তাদের কাছে আর কোনও ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার থাকবে না। বিপ্লবের ব্যর্থতায় হতাশ ভারতীয়রা আর কখনও ইংরেজের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে সাহসী হবে না।
ঘটনা ঘটে যায় কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া থেকে যায়। বড় ঘটনার প্রতিক্রিয়াও বড়ই হয়। সিপাহি বিপ্লব একদল ভারতীয় বিপ্লবীর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়ে গেল যে ইংরেজের নিজের হাতে তৈরি সেনাদলকে আবার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতার যুদ্ধে টেনে নামান সম্ভব এবং সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে পারলে তবেই স্বাধীনতার সংগ্রাম সফল হবে। এই সিদ্ধান্তকে জীবনের মূলমন্ত্র করে যারা ওই পথে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সাধনাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, আদিযুগে তাদের নায়ক মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণ সন্তান বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে। দ্বিতীয় পর্বে যে সব ভারতীয় বিপ্লবী এই ভয়াল পথে পা বাড়িয়েছিলেন তাদের সংখ্যা অগুনতি। পণ্ডিত শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা, মাদাম ভিকাজি কামা, লালা হরদয়াল, বীরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়, নিরঞ্জন পাল, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু প্রভৃতি অনেক বিপ্লবীর নামই এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। এই পর্বের প্রথম ভাগে অর্থাৎ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আন্দামানের জীবন্ত নরক সেলুলার জেলে নির্বাসনে যাবার আগে পর্যন্ত এই প্রচেষ্টার অবিসংবাদী নায়ক বিপ্লবী বীর সাভারকর, আর একজন চিৎপাবন ব্রাহ্মণ। পরবর্তী ভাগে এই প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রথমে বাঘা যতীন এবং তারও পরে বিপ্লবী মহানায়ক রাসবিহারী বসু। শেষ পর্বের নায়ক ছিলেন বাংলা মায়ের দামাল ছেলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং আবার সেই মহানায়ক রাসবিহারী। এখন জানা যাচ্ছে এই পর্বেও প্রেরণার উৎস ছিলেন বীর সাভারকর।
ইংরেজরা ভারতে রাজত্ব করেছে একশ নব্বই বছর। ভারতে এই দীর্ঘকাল তারা ঘাসে মুখ দিয়ে রাজ্য শাসন করেনি। ভারতীয় সেনাদলের ব্যাপারে বিপ্লবীদের এরকমের পরিকল্পনার কথা তাদের অজানা ছিল না। তাই সতর্কতাও ছিল প্রচুর। সেনাদলে ভারতীয়দের প্রবেশের ব্যাপক অধিকার ছিল না। বেছে বেছে কিছু সীমান্তের পাঠান আর অল্পকিছু পাঞ্জাবী শিখ বাদে অন্য ভারতীয়দের সেনাদলে নাম লেখানো রীতিমত কঠিন ব্যাপার ছিল। যারা ঢুকতে পেত তাদের উপরও কড়া নজর রাখার বিধিমতো ব্যবস্থা ছিল।
বিপদে পড়লে সব সতর্কতাই শিথিল করতে হয়। ইংরেজকেও করতে হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজকে বাধ্য হয়ে অধিক সংখ্যায় ভারতীয়দের সেনাদলে নিতে হয়েছিল। কিন্তু সেবারে যুদ্ধক্ষেত্র ছিল প্রধানতঃ ইউরোপে এবং সেই মহাযুদ্ধে ইংরেজের নিজের দেশে নিজের স্বাধীনতা বিপন্ন হবার মতো পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে ওঠেনি। তাই সেবারে কিছু বাছাবাছির সুযোগ ছিল। সেনাদলে অধিক সংখ্যায় ভারতীয় তরুণদের নিতে বাধ্য হলেও ইংরেজেরা নিজেদের পছন্দ ও বিশ্বাসের মানুষদেরই বেশি করে নিয়েছে। সেই পাঠান আর শিখদের অগ্রাধিকার, বাঙালি মারাঠীদের যতটা সম্ভব দূরে রাখা। সাধারণ সৈনিক হিসাবে কিছু বেশি ভারতীয়কে নিতে হলেও অফিসার পদে তখনও সাহেবদেরই একচেটিয়া অধিকার। রাইফেল হাতে শত্রুবাহিনীর মধ্যে যাওয়া, দলে দলে কামানের গোলায় প্রাণ দেওয়া—ভারতীয় সৈনিক অধিকারের সীমা এটুকুই। কী ভাবে বাহিনী চালাতে হয়, সমরবিদ্যার এসব কারিগরি দিকে ভারতীয়দের অধিকার তখনও মেনে নেওয়া হয়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সবচেয়ে দূরদর্শী ও বিজ্ঞ ভারতীয় নেতা বীর সাভারকর ছিলেন আন্দামানে কারা প্রাচীরের অন্তরালে। যুদ্ধে ইংরেজের বিপদকে নিজেদের সুযোগ হিসাবে কাজে লাগানোর কোনও সুবিধা তাঁর ছিল না। তবু গোপন পথে তিনি দেশের নেতাদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন এই সুযোগে দেশপ্রেমিক আদর্শবান তরুণদের যত বেশী সংখ্যায় সম্ভব সেনাদলে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করতে, যেটুকু সুযোগ ইংরেজেরা দিয়েছে তাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে। দুঃখের কথা ভারতে তখন এসব কথা বুঝবার, কাজে লাগাবার মত কোনও নেতা ছিলেন না। যুদ্ধের সুযোগ যেমন অযাচিত ভাবে এসেছিল তেমনই নিঃশব্দে চলে গেল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম। যুদ্ধ আরম্ভের দু’বছর আগে বীর সাভারকর আঠাশ বছরের বন্দি জীবনের অবসানে ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে নূতন শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তখন থেকেই তিনি দুটো কথা খুব জোর দিয়েই বলছিলেন। তাঁর প্রথম কথা ছিল : ইউরোপে মহাযুদ্ধ আসন্ন। সে যুদ্ধ এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়বে। জয় বা পরাজয় উভয় ক্ষেত্রেই ইংরেজের বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যের ভিত ধ্বংস হয়ে যাবে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ইংরেজ যদি যুদ্ধের মধ্যেই ভারতের স্বাধীনতা মেনে নিয়ে সসম্মানে চলে না যায়, যুদ্ধের শেষে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইংরেজের ভারত সাম্রাজ্য রক্ষার শক্তি থাকবে না। ভারতের স্বাধীনতা তাকে মেনে নিতেই হবে। তাঁর দ্বিতীয় বক্তব্য : ভারতের স্বাধীনতাকে ভারতের অধিকাংশ মুসলমান হিন্দুদের স্বাধীনতা মনে করে। তাই স্বাধীনতায় তাদের কোনও আগ্রহ নেই। তাদের প্রথম চেষ্টা হবে ইংরেজ যাতে এদেশে থেকেই চিরকাল মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করে। আর যদি ইংরেজরা এদেশ থেকে চলেই যায় তবে মুসলমানেরা ভারতের মুসলমান-প্রধান অংশগুলিকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গড়তে চাইবে। মুসলমানদের এই প্রচেষ্টায় ইংরেজরা সর্বপ্রকারে তাদের সহায়তা করবে। বীর সাভারকর বললেন, যুদ্ধের প্রয়োজনে এবার ইংরেজকে পছন্দ অপছন্দের বিচার তুলে রেখে ভারতীয়দের সেনাদলে নিতে হবে। প্রতিরক্ষার কোনও ক্ষেত্ৰই আর ভারতবাসীর পক্ষে নিষিদ্ধ করে রাখা সম্ভব হবে না। হিন্দু যুবকদের এই সুযোেগ নিতে হবে। দলে দলে হিন্দুদের সেনাদলে ভর্তি হতে হবে। অফিসার থেকে সিপাহি পর্যন্ত প্রতিক্ষেত্রেই হিন্দুদের সংখ্যা যেন অন্যের চেয়ে অনেক বেশি হয়। যুদ্ধ শেষে ভারতের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এবং বাহিনী-মুক্ত সৈনিকদের গুরুত্ব হবে সবচেয়ে বেশী। সেই সময় যাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে না যায় তার জন্য গোড়া থেকেই হিন্দু তরুণদের সতর্ক থাকতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়া থেকেই বীর সাভারকর সেনাদলে হিন্দু তরুণদের ভর্তি হওয়াকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করতেন। দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তিনি হিন্দুদের কাছে এই এক বাণী প্রচার করেছেন। এটাই ছিল তখন তাঁর জীবনের ব্রত। তিনি বলতেন : সেনাদলে নাম লেখাবার যে সুযোগ এসেছে তা আগে কখনও আসেনি। আসন্ন বিপদ কেটে গেলে ইংরেজ এ সুযোগ পরে আর দেবে না। সুযোেগ বারে বারে আসে না। প্রথমবারের সুযোগ আমরা নিতে পারিনি। এবারের সুযোগ ছাড়া হবে না। তিনি বলতেন, মিলিটারি অ্যাকাউন্টস বিভাগে কেরানির চাকরি নিয়ে কিম্বা বিশ্বযুদ্ধের ঠিকাদারিতে আলাদা টাকা কামাই করে এ সুযোগ নষ্ট করবেন না। সশস্ত্র বাহিনীতে দলে দলে ভর্তি হোন। বীর সাভারকরের এই প্রচারে দেশে যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল আমরা বাংলায় বসে তার কিছু টের পাইনি। কারণ বাঙালিরা বীর সাভারকর যা বলেছিলেন তার ঠিক উল্টোটাই করেছিল। মিলিটারি অ্যাকাউণ্টসের সহজ চাকুরি আর কণ্ট্রাকটর সাবকন্ট্রাকটরের ব্যবসায়ে আলগা পয়সাকেই বাঙালি হিন্দু পরমার্থ মনে করেছিল। বাহিনীতে যোগ দিয়েছে খুব কম বাঙালি তরুণ। কিন্তু ভারতের উত্তর পশ্চিম, মধ্য দক্ষিণ সব অঞ্চলে এত তরুণ বীর সাভারকরের ডাকে সাড়া দিয়েছিল যে, যুদ্ধের আগে সেনাদলে যেখানে হিন্দুর সংখ্যা ছিল সিকিভাগেরও কম, যুদ্ধের পরে সেখানে তারাই ছিল বারো আনা।
বীর সাভারকর হিন্দু তরুণদের সেনাদলে ভর্তি হতে এই যে উৎসাহ দিচ্ছিলেন তার উদ্দেশ্য, এরাই পরবর্তীকালে ইংরেজকে এদেশ থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য করবে। [ সম্পাদকের সংযোজন : ১৯৪০ সালের ২৫ জুন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে ঘোষণা করেন : When due to misguided political whims and lack of vision almost all the leaders of the Congress Party are decrying demost all soldiers of Indian National Army as mercenaries it is heartening to know that Veer Savarkar is fearlessly exhorting the youths of India to enlist in the Armed Forces. The enlisted youths themselves provide us with trained men from which we draw soldiers of our National Army.” ]
গান্ধীজির নেতৃত্বে তখন কংগ্রেস “ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ” নামে এক ছেলেখেলায় মেতে উঠেছে। উদ্দেশ্য, বড়লাটের মন্ত্রণা পরিষদে কংগ্রেসের নেতাদের স্থান লাভ এবং তাদের কিছু বেশি ক্ষমতা লাভ। সমস্ত ব্যাপারটা এতই লজ্জাকর যে, কংগ্রেসের মধ্যেও যাঁদের আত্মমর্যাদা বলে জিনিসটার অস্তিত্ব ছিল, তাঁরা এটাকে হজম করতে পারছিলেন না। এমনি সময় দেশগৌরব সুভাষচন্দ্র বোম্বাই শহরে বীর সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেন। সাভারকর তখন অসুস্থ। তিনি সুভাষচন্দ্রকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বুঝিয়ে বললেন। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের তখন সবচেয়ে বড় কর্মসূচি হল, যে-কোনও প্রকারে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করে দেওয়া। অন্যদিকে সুভাষের কর্মশক্তির বেশির ভাগই খরচ হয়ে যাচ্ছে কংগ্রেসের নেতাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে। কিন্তু এই ঝগড়াঝাঁটি, কলহ বিবাদের প্রকৃত মূল্য কী? বীর সাভারকর সুভাষচন্দ্রকে বললেন, এভাবে নিজের কর্মশক্তিকে নষ্ট করছ কেন? লক্ষ লক্ষ ভারতীয় সৈনিক অক্ষশক্তির হাতে বন্দি হয়েছে। তারা দেশের জন্য কিছু করতে চায়। কিন্তু কী করবে তারা তা জানে না। তুমি যেভাবে পার দেশ ছেড়ে চলে যাও। তাদের নেতৃত্ব দাও। মনে রেখো রীতিমত একটা ফৌজ নিয়ে তুমি ভারতে প্রবেশ করলে সারা দেশে এমন বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠবে যে, ইংরেজ তার সর্বশক্তি দিয়েও সে আগুন নেভাতে পারবে না। দেশ স্বাধীন হবে। আমি বৃদ্ধ অশক্ত, নইলে এ কাজে আমিই ঝাঁপ দিতাম। রাসবিহারী বসু জাপানে আছেন। তাঁর বয়স হয়েছে, তিনিও রুগ্ন। এখন একাজ হাতে নেবার দায়িত্ব তোমার।
বীর সাভারকরের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সাক্ষাৎকারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এই এক সাক্ষাৎকারে সুভাষচন্দ্রের জীবনের ও রাজনীতির কর্মপন্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল। সশস্ত্র সেনাদলের পুরোভাগে সামরিক নেতার ভূমিকায় তিনি দেশের মুক্তি অর্জনের চেষ্টা করবেন, ১৯৪১ সালে বীর সাভারকরের সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বে কথনও তিনি এমন কথা ভাবতেন তা তাঁর লেখায়, বক্তৃতায়, চিঠিতে, কথাবার্তায় কোথাও কোনও ইঙ্গিত নেই।
এই প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে উদঘাটিত সেকালের যুদ্ধনীতির একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। নেতাজি যখন ভারতের পূর্ব সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবল পরাক্রমে কোহিমার দিকে এগিয়ে আসছেন ভারতের ইংরেজ কর্তারা তখন তাকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব মনে করে প্রতিরক্ষা ব্যূহ এলাহাবাদ পর্যন্ত পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু তখনকার মার্কিন বিশেষজ্ঞরা বীর সাভারকরের মতোই বলেছিলেন, ভারতের মানুষ যদি জানতে পারে নেতাজি তার বাহিনী নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন এবং ইংরেজ এলাহাবাদ পর্যন্ত অঞ্চল তাঁর কাছে সঁপে দিতে বাধ্য হয়েছে, তবে সারা ভারতে বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠবে, যে বিপ্লবে ভারতের সেনাদলও সামিল হবে, সমগ্র ভারত মিত্রপক্ষের হাত থেকে চলে যাবে। নেতাজির গতিরোধের দায়িত্ব নিয়েছিল ইংরেজ, মার্কিন আর অস্ট্রেলিয় সৈনিকেরা, তাঁর অগ্রগতির খবর সর্বপ্রযত্নে গোপন রাখা হয়েছিল। এই সময়ে কলকাতার একটি দৈনিকপত্রে একদিন খবর ছাপা হয়েছিল যে, মণিপুর ফ্রন্টে কিছু সৈনিক ধরা পড়েছে যাদের ব্যাজে আই.এন.এ. অক্ষর তিনটি লেখা আছে। পরের দিনই ওই পত্রিকাকে সম্পাদকীয় লিখতে হল : যুদ্ধে জাপানের অবস্থা এমন শোচনীয় হয়েছে যে খোদ ইম্পিরিয়াল নিপ্পন আর্মি অর্থাৎ জাপ সম্রাটের নিজস্ব বাহিনীকেও এতদূরে যুদ্ধ করতে পাঠাতে হয়েছে।
বীর সাভারকরের রাজনীতির ক্ষেত্রে আবির্ভাবের প্রথম দিন থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা সর্বপ্রকারে তাঁর প্রতিকূলতা করে এসেছেন। এই কাজে কুৎসা প্রচারই ছিল তাঁদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। বড় বড় সংবাদপত্র হাতে থাকায় শত্রুপক্ষের চরিত্র হননের বিশেষ সুযোগ তাঁদের ছিল। তিনিও অবশ্য এইসব নেতার মুখোস খুলে দিয়ে তাদের প্রকৃত চেহারা জনসমক্ষে তুলে ধরতে দ্বিধা করতেন না। তবে তাঁর কথা প্রায়ই খবরের কাগজে ছাপা হত না, হলেও বিকৃতভাবে হত। তিনি যখন সেনাদলে হিন্দু তরুণদের দলে দলে যোগ দিতে বলছেন তখন কংগ্রেসের কয়েকজন বিশিষ্ট নেতা বলেন : ত্রিশ বছর জেল খেটে সাভারকরের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে। তিনি ইংরেজের দালালি করছেন। বীর সাভারকর এই প্রসঙ্গে তাঁর অনুগামী ডাঃ এন. বি. খারেকে বলেছিলেন : “আমার শত্রুরা কোনওদিন আমাকে চিনতে ভুল করেনি। আমি যখন সরকারকে বলি আমি তরুণদের সেনাদলে ভর্তি হতে উৎসাহ দিতে চাই, আমাকে সুযোগ দিন। তখন বড়লাট আমাকে বলেন, আপনার কথায় যারা বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে তাদের আমরা চাই না। তারা না এলে অন্য লোক আসবে। বাহিনী খালি থাকবে না, আপনার সহায়তা আমরা চাই না। অন্যদিকে আমার দেশের লোক, যারা বেনামীতে মিলিটারিতে মাল সাপ্লাই করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাচ্ছে তারাই আমাকে বলছে ইংরেজের দালাল। ভারতীয় বাহিনীতে হিন্দুর সংখ্যা বেশী হল, না মুসলমানের, তা নিয়ে এদের মাথাব্যথা নেই—আমার আছে এটাই আমার অপরাধ।’ ডাঃ খারের আত্মজীবনীতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে।
ডাঃ খারে একদিন বড়লাট লিনলিথগোকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি তখন লাটের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। বড়লাট তাঁকে খোলাখুলি বলে দিলেন : আপনি যা জানতে চাইছেন তার কিছুই আপনাকে জানানো হবে না। কারণ, আপনি ইংরেজের চিরশত্রু সাভারকরের লোক। সাভারকরের জীবনে ধ্যান-জ্ঞান একটিই, তা হল ইংরেজের শত্রুতা করা। রাজনৈতিক কারণে আমরা আপনাকে শাসন পরিষদে নিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু বেশিদিন থাকতে দেব না। যেখান থেকে সরকারের গুপ্ত খবর জানা যায় সেখানে সাভারকরের লোককে রাখা আমরা নিরাপদ মনে করি না।
ভারতের রাজনীতিতে সত্য ও অহিংসা নিয়ে বড় বড় কথা বলাটা রেওয়াজ। কিন্তু ওই দুটি সদ্গুণের চর্চা দুর্লভ। বীর সাভারকর ছিলেন যেমন সত্যবাদী তেমনই স্পষ্ট বক্তা। তার ফলে সমাজ ও রাজনীতির উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত নেতারা তাঁকে যেমন ভয় করতেন তেমনই তাঁর কণ্ঠরোধে তাঁদের প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না। জ্বলন্ত দেশপ্রেম, দেশের মুক্তি সাধনের জন্য অবিশ্বাস্য কষ্টভোগ, মনীষা, প্রজ্ঞা প্রভৃতির দৌলতে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতিত্বে ছিল যাঁর সহজ অধিকার, স্বাধীনতার প্রথম পদ সঞ্চারে তিনি পেলেন কারাবাস, হলেন এমন এক মামলার আসামী, যার অভিযোগ প্রমাণ হলে তাঁকে ফাঁসি-কাঠে ঝুলতে হত। অথচ মামলার পরিণতিতে দেখা গেল একটা যেমন তেমন চার্জ গঠনের মতো তথ্যও সরকারের হাতে ছিল না। গান্ধী হত্যার মামলায় সরকারের কর্ণধারদের ঈর্ষা ও জিঘাংসা নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক গোড্সে ও আপ্টের উপর প্রতিশোধস্পৃহার যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু বীর সাভারকরের প্রতি আক্রোশ নেহাৎই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রকাশ—যে আমাদের এত জ্বালিয়েছে প্রথম সুযোগেই তাকে ঝুলিয়ে দাও।
১৯৪৭ সালের পনেরই আগষ্ট দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বীর সাভারকর রাজনীতি থেকে বিদায় নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। দেশের পরাধীনতা তাঁকে দেশপ্রেমে পাগল করে দিয়েছিল। তাই তিনি দেশের মুক্তি যজ্ঞে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। কিন্তু মূলতঃ তিনি ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও গবেষক। সমগ্র জীবনকালের এক তৃতীয়াংশ তাঁর কেটেছে কারান্তরালে, তারও অর্ধাংশ আবার আন্দামানের নরকে। সেই তিনিও রচনা করেছেন পাঁচ হাজারের উপর কবিতা, অগণিত সাহিত্য ও গবেষণা নিবন্ধ, কালজয়ী বহু গ্রন্থ। অবশিষ্ট জীবন সাহিত্য রচনাতে ও বিদ্যাচর্চায় কাটিয়ে দেবেন এই ছিল তাঁর সংকল্প। তা যদি তিনি পারতেন তবে দেশ তার কাছে শেষ জীবনে যে সব অমূল্য সম্পদ পেয়েছে তার পরিমাণ আরও বেশি হত। কিন্তু ঘটনাচক্র তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি।
দেশের স্বাধীনতার সৌভাগ্যের সঙ্গে দেশ বিভাগের দুর্ভাগ্যকে জড়িয়ে দেওয়ার মূল ভূমিকা যাঁদের, তাঁরা তাঁদের অদূরদর্শী কাজের অব্যবহিত ফল দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলেন। হত্যা, লুণ্ঠন আর অগ্নিদাহে যখন দেশ জ্বলছে তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে তাঁদের শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে। বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সে বা রাশিয়াতে যা হয়েছে এখানেও তাই হবে—জনতার রুদ্ররোষে তাঁদের সমস্ত অপকর্মের ঋণ রক্তমূল্যে শোধ করতে হবে। তখন থেকে তাঁরা এক মারাত্মক খেলায় মাতেন। সে খেলা ইতিহাসকে বিকৃত করার খেলা। দেশ বিভাগের যাঁরা প্রধান নায়ক তাঁদেরই ইতিহাসকে বিকৃত করে প্রমাণ করতে চাইলেন যে, এ ঘটনায় তাঁদের কোনও ভূমিকা ছিল না। দেশবাসীকে বোঝাবার চেষ্টা হল যে, নেহরু, প্যাটেল দেশ বিভাগ প্রতিরোধের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন এবং শেষে বেদনার্ত চিত্তে যা অনিবার্য তাকে মেনে নিতে বাধ্য হন। দেশবাসীকে বোঝাবার চেষ্টা হয় যে, গান্ধীজি কোন মতেই দেশবিভাগকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। তাই অন্যেরা গান্ধীজির সাময়িক অনুপস্থিতিতে এই বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। দেশবাসীকে এর সঙ্গে সঙ্গে বোঝাবার চেষ্টা চলতে থাকে যে, দেশের স্বাধীনতার জন্য যা কিছু চেষ্টা হয়েছে গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেসই তা করেছে এবং অন্যেরা এখানে ওখানে দু-চারটে বোমা মেরে পিস্তল চালিয়ে যা কিছু করেছে তা বিপ্লবের নামে নেহাৎই ছেলে খেলা। দেশ স্বাধীন হয়েছে গান্ধীজির আধ্যাত্মিক প্রভাবে। তার আত্মিক বলের কাছে অত বড় পরাক্রান্ত ইংরেজদেরও পিছু হটে ভারতের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে হয়েছে। দেশের প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকেরা কেউ কেউ এই সব শেখানো বুলি বলতে লিখতে রাজি হয়েছেন। অনেকেই ইতিহাসের নামে এই মিথ্যাচারকে মেনে নিয়ে মতলববাজদের খুশি করেছেন। রাজশক্তির পুরস্কার ও তিরস্কারের শক্তি কোথাও কাজ করেছে, কোথাও করেনি। শেষপর্যন্ত বিদেশী ভাড়াটিয়া রোমাঞ্চ কাহিনির লেখকদের দিয়েও এই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে।
বীর সাভারকর এসব মিথ্যাকে মেনে নেবার পাত্র ছিলেন না। মূলতঃ ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি কয়েকটি কঠোর প্রশ্ন রাখলেন। প্রথম প্রশ্ন গান্ধীজির আত্মিক শক্তি যদি এতই প্রবল যে কয়েক হাজার মাইল দূরের সাতকোটি মানুষ তার দ্বারা অভিভূত হয়ে ভারতের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে বাধ্য হল, তবে সেই শক্তি ঘরের কাছের একটি মানুষ মিঃ জিন্না, যাঁর কাছে গান্ধীজি কারণে-অকারণে ছুটে ছুটে গেছেন, তাঁর হৃদয়ে দেশপ্রেমের আলো জ্বেলে তাঁকে দিয়ে অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করাতে পারল না কেন?
গান্ধীজি কি প্রকৃতই দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন ? ১৯৪৩ সালে তাঁর অতি আপনজন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি বলেছিলেন, গান্ধিজি জেল থেকে বলে পাঠিয়েছেন যে পাকিস্তানের দাবি মেনে নিয়ে মিঃ জিন্নার সঙ্গে আপস করে নেওয়াই ভাল। এই উক্তির ফলে রাজাজি সমগ্র দেশে ধিক্কৃত হন, ভারতের প্রথম ধাপের নেতৃত্ব থেকে বিচ্যুত হন তিনি। রাজাজির পরিণতি দেখে সতর্ক হয়ে যান বুদ্ধিমান নেতারা, এমনকি গান্ধীজিও দেশ বিভাগের বিরুদ্ধেই কথা বলতে থাকেন। কিন্তু গান্ধীজি তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কোথাও কখনও বলেননি যে, রাজাজি মিছে কথা বলেছিলেন। কার্যত রাজাজিকে বলির পাঁঠা করে গান্ধীজি দেশ বিভাগের কথা বলবার আগে আরও কিছু সময় নিতে চেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গ টেনে সাভারকর আরও প্রশ্ন তুললেন : জেল থেকে ছাড়া পেয়েই গান্ধীজি যখন মিঃ জিন্নার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তখন যে সব তরুণ তাঁর আশ্রমের বহিঃপথে সত্যাগ্রহ করে তাঁর কাছে কথা চেয়েছিল যে, তিনি বলুন, তিনি দেশবিভাগ মেনে নিতে মিঃ জিন্নার কাছে যাচ্ছেন না, গান্ধীজি তাদের সে প্রতিশ্রুতি দেননি। তাদের জেলে পাঠিয়ে তিনি মিঃ জিন্নার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। কেন? সেবারে জিন্না-গান্ধী বৈঠক সফল হয়নি। কারণ মিঃ জিন্না তখন পাকিস্তানের থেকেও বেশি করে চাইছিলেন নিজের অপপ্রভাবের শক্তি জাহির করতে।
১৯৪৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে বীর সাভারকর দেশের সর্বত্র ঘুরে একটি কথাই বলতে চেয়েছিলেন, কংগ্রেসকে ভোট দিও না। কংগ্রেস নীতিগতভাবে দেশ বিভাগ মেনে নিয়েছে। দেশের লোক সেদিন বীর সাভারকরের কথায় আস্থা রাখেনি। কিন্তু দেশব্যাপী সেই প্রচারের পরও কি একথা বলা চলে যে কংগ্রেস বা গান্ধীজি দেশ ভাগ করতে চাননি, অসহায়ভাবে শুধু অনিবার্য যা তাই মেনে নিয়েছেন?
আর হিংসা অহিংসার প্রসঙ্গ? ১৯৪৫ সালের নৌবিদ্রোহের পটভূমিতে ইংল্যান্ডে সরকারের কাছে পাঠানো ভারতের প্রধান সেনাপতি জেনারেল অচিনলেকের সেই বিখ্যাত গোপন রিপোর্টটি পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়। সেই রিপোর্টে অচিনলেক বলেছিলেন : সেনাবাহিনীতে শিক্ষিত হিন্দুরা দলে দলে ঢুকে পড়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে, যে-বাহিনীর আনুগত্য ছিল ভারতে বৃটিশ শাসনের মূল ভিত্তি, সেই বাহিনীই আর বিদেশী প্রভুর অনুগত নয়। এখন যদি ইংরেজকে ভারতে রাজত্ব করতে হয় তবে স্থল-নৌ-বিমান সমস্ত বাহিনীর প্রতিটি ভারতীয় সৈনিককে সরাসরি বরখাস্ত করে খোদ ইংল্যান্ড থেকে লক্ষ লক্ষ সুদক্ষ সৈনিককে পাঠাতে হবে সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য। যুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডের সে-শক্তি আর নেই। তাই শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথে মানে মানে সরে পড়তে পারলে অন্ততঃ ভারতে ইংরেজের বাণিজ্যিক স্বার্থ যাদের হাতে নিরাপদ থাকবে তাদের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে যাওয়া যাবে।
অচিনলেকের এই রিপোর্টের ফল হয় সুদূরপ্রসারী। যাঁরা এতদিন পর্যন্ত ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধী ছিলেন তাঁরাও মত পরিবর্তন করেন। তবে তাঁরা সবাই চেয়েছিলেন ইংরেজের জায়গায় যেন তাদেরই ক্ষমতায় বসানো হয় যাঁরা কার্যতঃ ইংরেজের নিজের লোক। ইংরেজের চিরশত্রু বিপ্লববাদীরা যেন কোনও মতেই ক্ষমতায় আসতে না পারে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের আগেকার এই সব ঘটনায় মধ্যে গান্ধীজির আধ্যাত্মিক প্রভাব, আত্মিক শক্তি এসবের স্থান কোথায়?
বীর সাভারকরের শততম জন্মজয়ন্তীতে অনেকেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। আজ তাঁরাও তাঁর গুণগান করছেন। তা করুন। কিন্তু এই গুণগানের ভিড়ে একথা যেন হারিয়ে না যায় যে ভারতের স্বাধীনতার উষালগ্নে যাঁরা বুঝেছিলেন যে, ভারত বিভাগের মধ্যে লুকিয়ে আছে আগামী দিনের ভারতে বহু দুর্দৈবের বীজ ; যাঁরা বলেছিলেন, যারা ভারত ভাগ করছে তারা ভারতের ভবিষ্যৎ সর্বনাশের বীজ বপন করছে—সেই ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের পুরোভাগে ছিলেন বীর সাভারকর। সেদিনের মহাপাপের নায়কেরা, যারা জীবিতকালে তাঁর নামে কোনও কুৎসা প্রচারে কুণ্ঠা বোধ করেননি, আজ তাঁর পবিত্র স্মৃতির আবরণে নিজেদের পাপ লুকোবার চেষ্টা করছে। আমরা যেন তাদের এই প্রচেষ্টায় বিভ্রান্ত না হই।
(২৮মে স্বাতন্ত্র্যবীর বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত। সাভারকর জন্মশতাব্দীতে বড়বাজার কুমারসভা পুস্তকালয় প্রকাশিত স্মরণিকা থেকে লেখাটি সংগৃহীত। ছদ্মনামের আড়ালে লেখক ভৈরব ভট্টাচার্য ছিলেন সাপ্তাহিক ‘স্বস্তিকা’ পত্রিকার প্রথমদিকের সম্পাদক এবং ক্ষুরধার লেখনীর অধিকারী।)
কূটমল ভট্ট (সৌজন্যে : নবোত্থান)