১৬/০৮/১৯৪৬
প্রথম ছুরিকাঘাত করা হয় ভোর ৪.৩০ মিনিটে, ভোরের হাওয়া খেতে বের হওয়া এক হিন্দুকে। এরপর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে বিপুল সংখ্যক মুসলমান আক্রমন করে মানিকতলা বাজার, ভাংচুর ও লুঠ করতে থাকে হিন্দুদের দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসময় দুজন হিন্দু মহিলা মুসলমানদের হাতে আক্রান্ত হয়, একজন হিন্দু পুরুষ ছুরিকাঘাতে নিহত হয়।
এরপর থেকে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে লালবাজার পুলিশ হেড কোয়াটার্স এ যে খুন-জখম লুঠপাট ও অগ্নি সংযোগের খবর আসতে থাকে সেগুলো হলো-
সকাল ৭ টা: মানিকতলায় মুস লমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ৭.৩০ : লালবাজার টেলিফোন অফিসের কর্মকর্তা, সার্জেন্ট ই উইয়লিয়াম, থানায় রিপোর্ট করে যে, সে যখন তার মহিলা সহকর্মীকে প্রহরা দিয়ে একটি পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে যাচ্ছিলো, সেই সময় সেই গাড়িতেই মুস লমানরা হামলা করে এবং তাদেরকে আহত করে।
সকাল ৭.৩৫ : বউবাজার ও লোয়ার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থল শিয়ালদহে বিরাট সংখ্যক মুস লমান, লাঠি, লোহার রড সহ বিভিন্ন অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে জমায়েত হয়েছে।
সকাল ৮.২৫ : টেরিটি বাজার মুস লমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ৮.৩০ : লোয়ার চিৎপুরে সিটি সিনেমা হল এলাকায় মুস লমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ৯টা : শিয়ালদহ এলাকার অবস্থা ভয়াবহ।
সকাল ৯.৫ : ওয়ার্ডস ইনস্টিউশন স্ট্রীটে মুস লমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ৯.১২ : রিপন স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিট ও মল্লিকবাজার এলাকায় মুস লমানরা যাকে পাচ্ছে, তাকেই ছুরিকাঘাত করে হ ত্যা করছে।
সকাল ৯.৩০ : বড়তলা থানার পুলিশেরাই মুস লমানদের দ্বারা আক্রান্ত। থানা থেকেই সশস্ত্র পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে লালবাজার পুলিশ হেডকোয়াটার্সে।
সকাল ৯.৫৫ : বড় তলা থানা থেকে আবারও সাহায্যের অনুরোধ।
সকাল ১০.১০ : দমদম রোডে কয়েকহাজার মুস লমান আক্রমন করেছে। হিন্দুরা বাধা দেবার চেষ্টা করলে, মুস লমানরা গুলি বর্ষণ করেছে।
সকাল ১০.১২ : গড়পার, যোগীপাড়া লেন অর্থাৎ ক্যানাল অঞ্চলে মুস লমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ১০.৩০ : হ্যারিসন রোডে গোলমাল। রিপন কলেজের সামনে দুপক্ষের লড়াই চলছে।
বেলা ১১.০৮ : ২১২, বিবেকানন্দ রোডের কমলা বস্ত্রালয়ে আগুন লাগানো হয়েছে।
বেলা ১১.১৫ : রিপন কলেজের সামনে সাংঘাতিক দাঙ্গা চলছে।
বেলা ১১.৫০ : মুস লমানদের একটি বিরাট দল শিয়ালদহের দিক থেকে দোকান পাট লুঠ করতে করতে বউ বাজারের দিকে আগুয়ান। আর একটি দল হিন্দু বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে এবং দোকান লুঠ করতে করতে আপার সার্কুলার রোড ধরে ময়দানের দিকে এগিয়ে চলেছে। লাঠি ও খোলা তরবারি হাতে মুস লমানদের আর একটি দল শ্যামবাজার থেকে হাতিবাগান পর্যন্ত এগিয়ে আসছে।
দুপুর ১.৩০ : ষষ্ঠীতলায় হিন্দুদের ঘরবাড়িতে অগ্নি সংযোগ। নারকেল ডাঙ্গা মেইনরোডের কাছে পড়ে আছে ৫ টি মৃতদেহ।
বিকেল ৩টা : গড়পার এলাকায় ভয়ানক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। খালের পশ্চিমপাড়ে হিন্দুদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করা হচ্ছে। হিন্দুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই একই সময় ময়দানে মনুমেন্টের নিচে মুস লমানদের সমাবেশ চলছিলো। সেখান থেকে হিন্দু বিরোধী বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছিলো, সমাবেশ শেষ হতে না হতেই মুস লমানরা হিন্দুদের দোকানে ভাঙচুর ও লুঠপাট করতে শুরু করে।
বিকেল ৪.৫ : লাইট হাউস সিনেমার পাশের সমস্ত হিন্দু মালিকানাধীন দোকান ভাঙা ও লুঠপাট চলছে।
বিকেল ৪.২০ : মুস লমানরা বেঙ্গল ক্লাব আক্রমণ করেছে।
বিকেল ৪.৩০ : মেট্রো সিনেমার পাশের কে.সি বিশ্বাসে বন্দুকের দোকান ভেঙ্গে সমস্ত অস্ত্র লুঠ করে নিয়ে গেছে মুস লমানরা। ঐ অঞ্চলে আরো লুঠপাট চলছে।
বিকেল ৪.৪২ : ধর্মতলা রোডের বিখ্যাত কমলালয় স্টোর্স সম্পূর্ণ লুঠ হয়ে গেছে।
বিকেল ৫.১০ : কলকাতার সব বড় বড় রাস্তায় নৃশংস হত্যা ও লুণ্ঠন চলছে। ধর্মতলা স্ট্রিটে চাঁদনি চক বাজার মুস লমানদের দ্বারা লুণ্ঠিত। ইন্দ্র রায় রোডে সশস্ত্র মুস লমানরা বেরিয়ে আসছে।
মির্জাপুর স্ট্রীট ও আপার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থল সশস্ত্র ও উত্তেজিত মুস লমানদের দ্বারা পরিপূর্ণ।
ওয়েলেসলি স্ট্রিটে বাটা সু কোম্পানি ও সেন এন্ড ল’র দোকান লুঠ করা হয়েছে।
৮ নং তারা চাঁদ দত্ত স্ট্রীটে গমের কলের হিন্দুদের খুন করা হয়েছে।
১৫২ নং লোয়ার সার্কুলার রোডে লক্ষীকান্ত দাসের সাইকেল দোকান লুঠ করা হয়েছে এবং তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটের প্রায় সমস্ত হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও ৫৫ ক্যানিং স্ট্রিটের এ্যালুমিনিয়ামের একটি দোকান লুঠ করা হয়। কয়েক শত মুস লমান ঐ দোকান লুঠ করে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যায় এবং যাওয়ার সময় ৬ জন নিহত এবং ৭ জন আহত হিন্দুকে তারা উঠিয়ে নিয়ে যায়।
মারকুইস স্ট্রিট, এলিয়ট রোড, কর্পোরেশন স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিটে হিন্দুদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর লুঠ করা হয়েছে।
ডি.সি নর্থ, খান সাহেব খলিলুর রহমান, তার এক রিপোর্টে ১৬ আগস্ট সম্পর্কে লিখে, “বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা চলেছে ধর্মতলা স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিট, মার্কেট স্ট্রিট, কর্পোরেশন স্ট্রিট, এবং ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। দোকান লুঠ হয়েছে, খুন হয়েছে এবং হামলা এখনও চলছে। মিলিটারী মোতায়েন করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করা খুবই কঠিন।”
উপরের এই বর্ণনা শুধু মাত্র ১৬ আগস্টের। এরপর ১৭ তারিখ পুরো দিন এবং ১৮ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত মুস লমানরা একইভাবে হিন্দুদের হত্যা, মেয়েদের ধ র্ষণ, প্রাণের ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরের চেষ্টা, বাড়ি-ঘরে অগ্নি সংযোগ এবং লুঠপাট করতে থাকে।