‘বারোটায় অফিস আসি দুটোয় টিফিন/ তিনটেয় যদি দেখি সিগন্যাল গ্রীন’- সরকারি কর্মচারীর কর্মসংস্কৃতির এই গান শুনেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বসে বসে বেতন পাওয়া, মজায় জীবন কাটানো মুষ্টিমেয় কিছু লোক। তার উপর উপরি নেওয়ার অভিযোগ তো আছেই। তাই পাড়ার চায়ের আড্ডাতে সহজবধ্য সম্প্রদায় স্কুল মাস্টার আর সরকারী কর্মচারীরা। আজ সেই সরকারী কর্মচারীদেরই ‘দুয়ারে’ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে সরকার। করোনার প্রকোপ কমেনি। তবু এই অতিমারীর সবরকম নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে জায়গায় জায়গায় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের তত্ত্বাবধানে, সরকারি মোচ্ছবের সামিয়ানায়, বলির পাঁঠা হয়ে যাচ্ছেন রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা। এতে তো আমাদের খুশি হওয়ারই কথা। এতো দিনে জব্দ হয়েছে ফাঁকিবাজেরা!
কিন্তু ওই কর্মচারীদের গনশত্রু না ভেবে বাস্তবটা একটু বোঝা আজ ভীষণ প্রয়োজন। কতটা সুখে আছেন এরাজ্যের রাজ্য সরকারী কর্মচারীরা বা স্কুল শিক্ষকরা? ২০১৭ সালে ৩০ অক্টোবরের আদেশনামাতে রাজস্থান সরকার ৭ম বেতন কমিশনের সুপারিশ মত তাদের রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের বেতন দেওয়া শুরু করেছেন। গুজরাতেও রাজ্যসরকারী কর্মচারীদের জন্য ৭ম বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হয়েছে। সেরাজ্যে রাজ্য সরকারী কর্মীরা ৯ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ হারে ডিএ পেতে শুরু করেছেন। একই সঙ্গে মাধ্যমিক স্তরের স্কুল শিক্ষক আর উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষক শিক্ষিকারা নিয়ুক্তির স্তরে বেতনবৃদ্ধি পেয়েছে সেই বছর থেকেই।
এরাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের কাছে ৭ম বেতন কমিশন এখনো দিবাস্বপ্ন। মহার্ঘ্য ভাতার ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের রিভিশন অফ পে এন্ড অ্যালাউন্সের (রোপা) ৫০ শতাংশ এখনো পাননি রাজ্য সরকারী কর্মচারীরা। গত জুলাই মাসে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনাল (এস.এ.টি) সরকারের সব বাহানা খারিজ করে দিয়েছেন। মহামান্য আদালতে এই ৫০ শতাংশ মিটিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের যে ২০১৯ সালের রোপা তার ১৭ শতাংশ এখনো বাকি।২০১৯ সালে কোনরকম মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়া হয়নি। বাড়িভাড়া মানে এইচ.আর.এ. পঞ্চম বেতন কমিশনের ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।রাজ্যের সরকারী কর্মী বা শিক্ষকদের বেতনের ক্ষেত্রে এতটা অনীহা ভারতের কোন রাজ্য সরকার দেখাননি।
আজকের সরকারী কর্মচারীদেরও চাকরী পাওয়ার পেছনে সেই ছেলে মেয়েদের মেধা, অনেক স্বপ্ন আর তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম আছে। চাকরীটা তারা কারো দয়াতে পাননি, যোগ্যতার সঙ্গে অর্জন করেছেন। তাই তাঁরা যখন রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে চাকর বাকরের মতো ব্যবহার পান তখন এতো পড়াশুনা, এত সাধনাকে অপমান করা হয়।
বীরভূম জেলার জেলাশাসক ও অন্যান্য আইএএস, ডাবলুবিসিএসদের ‘গ্রিল’ করার ভিডিওটি সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। খবরের কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সরকার নিশ্চয়ই এই খবর গোপন রাখতে চাননি, ববং আমলাদের অপদস্থ করার ছবিতে যাতে দলীয় কর্মীরা অনুপ্রাণিত হন সেইজন্যই হয়ত জেনেবুঝেই প্রকাশ করা হয়েছে। জাতি শংসাপত্রের ক্ষেত্রে যে নিয়ম পরিবর্তনের উপদেশ দিয়ে একজন সিনিয়র আইএএসকে ধমকানো হল সেটা একটু বোঝা প্রয়োজন। পরিবারের যে কোন একজনের শংসাপত্র থাকলেই চলবে, সেইরকম আইন তো ছিলই। কিন্তু আবেদনকারীকে তো সেই রক্তের সম্পর্ক প্রমান করতে হবে। এই সংরক্ষণ সংক্রান্ত নির্দিষ্ট আইন ও নিয়মাবলী আছে। সেটা পরিবর্তনের জন্য অন্তত বিধানসভায় আইন আনতে হবে। না হলে প্রকৃত পিছিয়ে পড়া শ্রেনীর বদলে সুবিধা পাবে সুযোগসন্ধানীরা। তাতে ভোটে সুবিধা হতে পারে, সামাজিক ন্যায় হবে না।
এইসব ভিডিও দেখে মনে হতেই পারে যে রাজনীতিবিদ আর প্রশাসনের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক! কিন্তু ভারতীয় গনতন্ত্রে আদতে তা বলে না। রাজনৈতিক শক্তি, প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থা গনতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ। তাই রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের স্বেচ্ছাচারের উপরে অঙ্কুশ লাগানোই আই.এ.এস. এর মতো উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মীর কাজ। আজ এই ভয়াবহ করোনা আবহের মধ্যে যে নিষ্ঠুর তামাশা হচ্ছে সেটা তো ২০১১ সালেই শুরু করা উচিৎ ছিল।সেদিন বলা হয়েছিল, যে সব কাজ হয়ে গেছে, এবার শুধু মনিটরিং করতে হবে। রাজনৈতিক তাগিদায় ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে বহুবছরের কোন ব্যবস্থা। মেরুদন্ড সোজা করে না কে না বলতে পারলেন না আধিকারিকরা? এনারাই সমাজের রোল মডেল। এনাদের মতো হতেই তো মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা জীবন রচনা করে।
এইসব কথা বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, সরকারি দপ্তরে গাফিলতি হচ্ছে না। কিংবা সব সরকারি কর্মচারী নিজের কাজ সময় মতো নিষ্ঠার সঙ্গে করছেন। রাজ্যের মানুষের সরকারি দপ্তরগুলিতে প্রতিনিয়ত হেনস্থা সহ্য করতে হয়। তবে তার প্রতিকার এই চটকের মাধ্যমে হবে না। রাজ্যের মানুষ সরকারী দপ্তরের দুর্নীতির কথা জানেন না এমনটা নয়। আর সেইসঙ্গে এটাও জানেন যে বিগত বছরগুলিতে এই দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক যোগ দৃঢ় থেকে কিভাবে দৃঢ়তর হয়েছে। সরকার দুয়ারে গেলেই যে এই চক্র বন্ধ হবে না সেটা রাজ্যের যে কোন ধান্দাহীন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বুঝতে পারেন।
বহুদিন ধরে বহু পদে নিয়োগ হয়নি। পাড়ায় পাড়ায় উৎসবে টাকা গেছে, যে কাজ সরকারের নয় সেই কাজে খয়রাত করা হয়েছে কিন্তু সরকারী দপ্তরগুলিকে সাজানো হয়নি। রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থেই কেবল বিভাগগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে। যখন কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে তখন অবসরপ্রাপ্তদের বিভিন্ন পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ হয়েছে। গত একমাসে সবচেয়ে সহজ শিকার হয়েছেন এমন অস্থায়ী কর্মীরা। কোভিড পরিবেশে হাজার হাজার মানুষের মেলায় সবথেকে বিপজ্জনক জায়গায় তাঁদেরই পাঠানো হয়েছে।
সরকারী কর্মচারীরা তাদের ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের থেকেও একটু সুরক্ষা আশা করেন। এরাজ্যে রাজনৈতিক নেকড়েরা যখন তাদের দাঁতে-নখে ছিঁড়ে খায়, তখন তারা আশা করেন যে তাদের স্যরেরা বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে যখন ব্লক উন্নয়ন অফিসগুলোতে সরকারি কর্মীদের মেরে ধরে দখল করে নেওয়া হচ্ছিল, তখনও তারা চেয়েছিল অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। উত্তর দিনাজপুর জেলার স্কুল শিক্ষক রাজকুমার রায় যেদিন খুন হলেন, যেদিন দুটো ছোট শিশুকে নিয়ে তাঁর অসহায় বিধবা স্ত্রী যখন বিচার চেয়েছিলেন, তখন আশা ছিল বিভাগের থেকে এই অন্যায়ের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাওয়া হবে।আজও কেবলমাত্র ভোটের কথা মাথায় রেখে অতিমারির আইনকানুনপকে তোয়াক্কা না হরে হাজার হাজার সরকারী কর্মচারীকে যে কষ্ট দেওয়া হয়েছে তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
প্রতিটি সরকারি কর্মচারী পশ্চিমবঙ্গের জনগনের সেবার জন্য নিয়োজিত। কোন রাজনৈতিক দলের সেবাদাস নয়। এনারা সমাজের শিক্ষিত বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন মানুষজন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বহুবার সমাজের জাগরণ ঘটিয়েছে এমন মধ্যবিত্তেরা। আজও পৃথিবীর বৃহত্তম গনতন্ত্র হিসাবে ভারতবর্ষের টিকে থাকার সবথেকে বড় কৃতিত্ব এই সরকারি কর্মচারীদের। ২০২০ আমাদের জীবনের কলঙ্কময় বছর হিসাবেই স্মরনে থাকবে। নতুন বছরে রাজ্যবাসীর সার্বিক কল্যানের জন্য মাথা উচু করে, রাজনৈতিক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রুখে দাঁড়াবে প্রশাসন আর সেই সঙ্গে সরকারি কর্মচারিরা। রাজ্যের নয় কোটি মানুষ সেদিকেই তাকিয়ে আছেন।