কুলীনগ্রামী, খণ্ডবাসী মিলিয়া আসিয়া।
শিবানন্দ সেন চলিলা সভাবে লইয়া।।
রাঘব পন্ডিত চলিলা ঝালি সাজাইয়া।
দময়ন্তী যত দ্রব্য দিয়াছে করিয়া।।
– চৈতন্যচরিতামৃত , অন্ত্য ১০/১২-১৩
নদের নিমাইয়ের ভোজন অভ্যাস নিয়ে কথা বলছি আর শ্রী রাঘব পন্ডিতের ঝালির কথা না বললে এ ভোজ যে অসমাপ্ত থেকে যায়। শ্রী চৈতন্যদেব তাঁর নিত্য অবস্থান সম্পর্কে অঙ্গীকার করে বলেছিলেন –
শচীর মন্দিরে আর নিত্যানন্দের নর্ত্তনে
শ্রীবাস কীর্ত্তনে আর রাঘব ভবনে। ।
রাঘব পন্ডিত চলে ঝালি সাজাইয়া
তিন বোঝারি ঝালি বহে ক্রম করিয়া।।
রাঘব এবং তাঁর ভগিনী দময়ন্তী। চৈতন্যজীবনী গ্রন্থের অপরিহার্য কুশীলব। ইতিহাসে অমর হয়ে আছে #রাঘবের_ঝালি নামে। রথযাত্রার পূর্বে বঙ্গ হতে বহু ভক্ত পুরী যেতেন। শ্রী গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস পূর্বকালে ভোজন রসিক ছিলেন। যেখানেই গৌরাঙ্গের ভোগ হয় সেখানেই তাঁর প্রিয় থোড়, মোচার ঘণ্ট, কাঁচ কলার ব্যঞ্জন প্রদানের প্রথা চিরন্তন হয়ে গেছে। আবার নিমপাতা, বেগুনভাজা মহাপ্রভুর বড় প্রিয় হলেও শ্রী জগন্নাথদেবের ভোগের প্রভাবে কোনো মন্দিরে তিক্ত ব্যঞ্জন ভোগ প্রদান করা হয় না। তবে যুগের প্রভাবে অনেক মন্দির ক্রমে ক্রমে ভোগের সরলীকরণ করেছে। আবার গৃহস্থ ঘরে শ্ৰীরাধমাধব এবং গৌরাঙ্গাদি সেবা হয় সেখানে সন্ন্যাস আশ্রমের থেকে পৃথক ভোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যেমন – বর্ধমানের কাটোয়ার একটি ভ্রাম্যমাণ বিগ্রহ শ্রীরাধামাধব যশোরের মহারাজ প্রতাপাদিত্য প্রতিষ্ঠিত। বিগ্রহের মধ্যে আছেন , মাধব ও জগন্নাথের নাতিদীর্ঘ নয়নাভিরাম দারুমূর্তি। তাঁদের ভোগ দিতে হয় পুষ্পান্ন , অন্ন ,ডাল, পরমান্ন, ফলপাকুড়, নৈবেদ্য, মণ্ডা , মিঠাই এবং সঙ্গে বাহান্ন রকম ব্যঞ্জন। কিন্তু যিনি এত কিছু দিতে পারেন না? তাতে কি? মনের ভক্তি এবং হৃদয়, বিবেকের পরিছন্নতায় আপনি যদি নকুলদানা, চিনি কিংবা জল, বাতাসা দেন ,তাই তিনি মহানন্দে গ্রহণ করেন।
যা হোক , শ্রীচৈতন্যেদেবের নীলাচল অবস্থানকালে প্রতিবছর রথযাত্রার বেশ কিছুদিন আগে গৌড়ীয় চৈতন্যভক্তের দল প্রস্তুত হতো নীলাচল যাত্রার জন্য । তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বেশ কয়েক মাস জুড়ে নিরন্তর শ্রীচৈতন্যেদেবের সঙ্গলাভ এবং রথে জগন্নাথদেবকে দর্শন। চারমাস ধরে তারা জগন্নাথ ভূমে বাস করে চতুর্মাস্যা ব্রত উদযাপন করতেন। ওই সময় রাঘবের ভগিনী দময়ন্তী পাঠাতেন নানারকম মুখরোচক অম্লনাশক খাদ্যসামগ্রী । এমন করে প্রস্তুত হতো সেসব , যাতে মহাপ্রভু এক বছর ধরে উপভোগ করতে পারেন। ভক্তগণ শ্রী চৈতন্যদেবের প্রিয় খাবার নিয়ে এসে শ্রী চৈতন্যদেবের কৃচ্ছসাধন ভাঙতেন। ভক্ত বৎসল শ্রীচৈতন্যদেবের না বলার উপায় ছিল না। পানিহাটির রাঘব পন্ডিত মহাপ্রভুর প্রিয় খাবার রাঘব পন্ডিতের ভোগিনী দময়ন্তী দেবী নিজে পরম যত্নে তৈরী করে পেটিকাতে ভরে প্রতিবৎসর পাঠাতেন।
কি কি থাকত রাঘবের ঝালিতে?
থাকত, আম কাসুন্দি, আদার কাসুন্দি, ঝালকাকাসুন্দি, নেবু আদা, আম্রকেলি, আমসি, আম্রখণ্ড, তেল আম, আমতা, পুরানো সুক্তা (পটোল পাতা বা পাট পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে দেওয়া হতো। সুক্তা , কাসুন্দি শ্রীগৌরাঙ্গের ভীষণ প্রিয় ছিল। ) আর থাকত, ধনে – মৌরী চাল গুঁড়া করে চিনির পাকের লাড়ু। পৃথক কাপড়ে শুষ্ক কুল, কুল চূর্ণ, একশ রকম আচার, নারিকেল নাড়ু, অপুষ্ট শালি ধানের আতপ চিঁড়া, ঘি এ ভাজা হুড়ুম চিঁড়া। আরো ছিল, হুড়ম চিঁড়ার ঘি শর্করা, কর্পূর মিশ্রিত নাড়ু, শালি ধানের খই মুড়কি, শালি ধানের চাল গুঁড়া করে তাতে ঘি চিনি কর্পূর লবঙ্গ এলাচ ইত্যাদি মিশিয়ে রসবাস পাপড়ি বা পাঁপড়, পিত্তনাশক যুষ্টিখন্ড, কোলি খণ্ড বা কুল ও চিনি মিশ্রিত খাদ্য, গঙ্গাজল নাড়ু, দীর্ঘদিন স্থায়ী খণ্ড বিকার ও ক্ষীরসার, অমৃত কর্পূর, গঙ্গামাটির তক্তি ইত্যাদি। এই সকল খাদ্য নানা রকম মৃত্তিকা পাত্রে রেখে, তার মুখ বন্ধ করে, গন্ধ দ্রব্য কাপড় দিয়ে বেঁধে গঙ্গামাটি দিয়ে দময়ন্তী দেবী ঘিরে দিতেন। যাতে বঙ্গ হতে নীলাচল যাবার দীর্ঘ পথ সেগুলো ঠিক থাকে।
আরো আছে, পানিহাটির দণ্ডমোহৎসব।
সেইক্ষণে নিজ লোক পাঠাইয়া গ্রামে,
ভক্ষ্য দ্রব্য লোক সব গ্রাম হতে আনে।
চিড়া, দধি, দুগ্ধ, সন্দেশ আর চিনি-কলা,
সব দ্রব্য আনাইয়া চৌদিকে ধরিলা।
..……
এক ঠাঁই তপ্ত দুগ্ধে চিড়া ভিজাইয়া
অর্ধেক ছানল দধি, চিনি-কলা- দিয়া।
( চৈতন্যচরিতামৃত , অন্ত্য – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)
পানিহাটির মূল উৎসব পঞ্চম দোল হলেও ,গত বছর পাঁচশত বৎসর ধরে পাণিহাটির প্রসিদ্ধি বিখ্যাত বৈষ্ণব উৎসব #দণ্ডমহোৎসবের জন্য। সেই প্রদীপ প্রজ্বলনের পূর্বে সলতে পাকাবার কাহিনীটিও আকর্ষণীয়। সেখানে সর্বত্র জুড়ে আছেন ভগবান মদনমোহন আর দুই রাজার রাজা মহারাজা …..শ্রী চৈতন্য দেব এবং নিত্যানন্দ মহাপ্রভু।
কি সেই ঘটনা , যার জন্য বার বার শ্রীরামকৃষ্ণদেবও পাণিহাটিতে ছুটে আসতেন ? রাঘব কে ছিলেন ? সেই বটবৃক্ষ তল আজও অক্ষয় হয়ে আছে কেন ?
চন্দ্রকেতু রাজার পুরোহিতের নাম ছিল গঙ্গাপ্রসাদ চতুর্বেদী। ইনিই দেগঙ্গার চাটুজ্জে পুকুর থেকে স্বপ্নাদেশে মদনমোহন যুগল মূর্তিকে পেয়েছিলেন। বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে নিয়ে এসে যুগলকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর পাণিহাটির গৃহে।
প্রভু বলে রাঘবের আলোয়ে আসিয়া
পাসরিনু সব দুঃখ রাঘব দেখিয়া
গঙ্গায় মজ্জন কৈলে যে সন্তোষ হয়
সেই সুখ পাইলাম রাঘব আলয়।
এই গঙ্গাপ্রসাদ চতুর্বেদীর প্রপৌত্ররূপে, বৈষ্ণব চূড়ামণি শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ, মহাপণ্ডিত রাঘবের জন্ম হলো পাণিহাটির গৃহে। তাঁর নামেই পাণিহাটির রাঘব ভবন। তিনি কেবল শ্রী চৈতন্যলীলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তা নয়, মহাপ্রভুর অন্যতম পার্ষদ শ্রী নিত্যানন্দের এবং চৈতন্য অনুগামীদের সখ্যের অধিকারীও হয়েছিলেন। ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে নীলাচল থেকে গৌড় যাবার পথে শ্রীচৈতন্যদেব রাঘবের পাণিহাটির ভবনটিতে ত্রিরাত্রি বাস করেছিলেন । সেই হতে রাঘব ভবন বৈষ্ণবদের কাছে এক মহা তীর্থস্থান। শ্রীচৈতন্যদেবের আকর্ষণে শত মানুষ তাঁর শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
একদিন রাঘবভবনে সপার্ষদ মহাপ্রভু আসবেন। ঘাটে নৌকা ভেড়াবার পূর্বেই লোকমুখে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল তাঁর আগমনবার্তা ছড়িয়ে পড়ল। অসংখ্য মানুষ সমবেত হলেন প্রভুদর্শনের আশায়। ঘাটে নামলেন মহাপ্রভু। সেদিন পেনেটির ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়েছিল।
রাঘব পন্ডিত আসি প্রভু লঞা গেলা
পথে যাইতে লোক ভীড় কষ্টে সৃষ্টে আইলা।
সংকীর্তনের সুরে আকাশ বাতাস , শঙ্খ , ঘন্টা, হুলুধ্বনিতে মুখরিত হল আকাশ বাতাস। মহাপ্রভু রাঘব ভবনে প্রবেশ করলেন।
দেবতা দ্বারকা নাথ মিলে দ্বিগঙ্গা নগরে
পাণিহাটি গঙ্গাতীরে স্থাপে ভক্তি ভরে।
চৈতন্য আনন্দ পায় দরশিয়া মুরতি
আলিঙ্গিয়া রাঘবেরে জানায় প্রীতি।
আনন্দের মুখরিত হয়ে উঠল চারিদিক। দূরদূরান্ত হতে উচ্চ নীচ , ধনী গরিব, নরনারী সকলে ছুটে এলেন কৃপাপিপাসু হয়ে। পণ্যহট্ট সেদিন কৃষ্ণপ্রেমের, চৈতন্যলীলার হাটবাজারে পরিণত হয়েছিল। সেই পেনেটির ঘাটে ভক্তগণ তাঁদের ভক্তির মাধ্যমে কিনে নিয়েছিলেন প্রেমঘন মূর্তি চলমান জগন্নাথকে। সেই সব ভক্তকুলের মধ্যে ছিলেন এক ডাকসাইটে জমিদার বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী। সেই উত্তরাধিকারীর জন্যই পানিহাটির চিঁড়ার মেলা আজও বিখ্যাত হয়ে আছে।
সপ্তগ্রামের জমিদার মজুমদার পরিবার। তাঁদের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন রঘুনাথ মজুমদার। পিতা গোবর্ধন মজুমদার এবং পিতৃব্য হিরণ্য মজুমদার। বঙ্গে নবাবী আমলে একসময় এঁরা রাজস্ব প্রতিনিধি ছিলেন। রাজস্ব আদায় করে রাজ কোষাগারে জমা দেওয়ার পর উদ্বৃত্ত রূপে তাঁদের হাতে জমা হতে বার্ষিক প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। অথচ তাঁদের দীক্ষাগুরু ছিলেন শ্রী চৈতন্যদেবের দ্বিতীয়া সহধর্মিনী বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর পিতা সনাতন মিশ্র। আবার অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গেও তাঁদের আত্মীয়তা ছিল। সুতরাং , সেখানে সাধারণ মানুষের থেকে শোষিত অর্থের মোহ থেকে উক্ত দুই মজুমদার না বেরিয়ে আসতে পারলেও , কৃষ্ণ কিন্তু তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন। ফলে, একমাত্র উত্তরাধিকারী রঘুনাথ শিশুকাল হতে সংসারের প্রতি , জাগতিক বস্তুর মোহের প্রতি বীতস্পৃহ ছিলেন। শ্রী চৈতন্যদেবের সঙ্গলাভের আশায় উচাটন রঘুনাথ এই মহাযোগকে নষ্ট করতে রাজি হন নি।
সেদিন রাত্রে রঘুনাথ সব ত্যাগ করে পালিয়ে এলেন পেনেটি। কিন্তু সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ রঘুনাথ মজুমদারের আর প্রব্রজ্যা গ্ৰহণ করা হল না। উপনিষদেই আছে বিদ্যা স্বরূপ মায়া এবং অবিদ্যা স্বরূপ মায়া উভয়কেই জানতে হয়, গ্ৰহণ করতে হয়। তবেই একজন মানুষের জীবনে যৌগিক উন্নতি হয়। তাই শ্রী চৈতন্যদেব রঘুনাথ কে গ্ৰহণ করলেন না। তিনি চাইলেন বৈভবশালী জমিদারের উত্তরাধিকারী মায়াবাদের ঐশ্বরিক অর্থ জেনে আসুন। চাইলেন রঘুনাথের আরো ধৈর্য এবং তিতিক্ষার পরীক্ষা।
ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যূতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তম্ অনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।’ (মুঃ উঃ, ২/২/১০)
সেথায় (সমাধির অবস্থায়) সূর্য নেই, চন্দ্র তারকা বা বিদ্যুৎ নেই। অগ্নিও নেই। (আত্মার) সেই জ্যোতিতে সবকিছুই বিভাসিত― জ্যোতিষ্মান। সেই জ্যোতিষ্মানকে জানতে হলে মহামায়ার নানারূপকে , তাঁর এই সুবিশাল মায়ার সংসারকে জানতে হবে তো।
‘আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।
অনন্দেন জাতানি জীবন্তি। আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি।’ (তৈঃ উঃ,৩/৬/১)।
অনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম। সেই আনন্দ থেকেই এই ভূতবর্গ জন্মগ্রহণ করে―আনন্দকে অবলম্বন করে। আনন্দের মধ্যেই তারা অবস্থান করে। পরিশেষে আনন্দেই বিশ্বজগৎ-জীব-মানুষ-দেবতা সবই লয়প্রাপ্ত হয়। এসব তাঁদের অনুভূতি। এখানে কোনো বিধি নেই। আছে কেবল সত্যের অনুভব, সত্যের নিষ্ঠিক বর্ণনা, সত্যের অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠা। সেই ব্রহ্মকে জানতে ব্রহ্মময়ীকে জানা আবশ্যক।
তাই রঘুনাথকে প্রভু বললেন –
স্থির হইয়া ঘরে যাও না হও বাতুল
ক্রমে ক্রমে পায় লোকে ভবসিন্ধু কূল।
মর্কট বৈরাগ্য না কর লোক দেখাইয়া
যথাযোগ্য বিষয় ভুঞ্জ অনাসক্ত হইয়া।।
দারুণ প্রত্যাখ্যাত রঘুনাথ নয়নের জলে ভেসে চলে গেলেন সপ্তগ্রাম। রঘুনাথকে ফিরে পেয়ে মজুমদার জমিদারিতে খুশির বন্যা বয়ে গেল। একমাত্র উত্তরাধিকারী সন্ন্যাস পথ হতে সরে এসেছে সংসার জীবনে, সুবিশাল জমিদারির একমাত্র মালিকানা স্বাভাবিক জীবন ছন্দে ফিরে এসেছে , স্বয়ং মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্ৰহণ হতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সেই আনন্দে জমিদার বাড়ি সারাগ্রামকে মাছ ভাত খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। প্রসঙ্গত , এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে আজও একটি ভক্ষ্য মাছের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর পয়লা মাঘ সপ্তগ্রামের কৃষ্ণপুুুুর গ্রামে রঘুনাথ দাস গোস্বামীর শ্রীপাটে সরস্বতী নদীর তীরে বসে সেই মেলা।
জমিদারের ব্যাটা রঘুনাথ শ্রীচৈতন্যের কথায় ব্যাথা পেলেন বটে কিন্তু ভেঙে পড়লেন না । বিবাহের পরেও সংসারে তাঁর মন বসলো না । তাঁর স্ত্রী অনুভব করলেন রঘুনাথ সংসারে বেশিদিন থাকবেন না। এদিকে ততদিনে নীলাচলে ফিরে গেছেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি নিত্যানন্দকে আদেশ করেছিলেন সংসারীদের মধ্যে থেকে সংসারী হয়ে উচ্চনীচ, জাতি বর্ণ , ধনী দরিদ্র, পন্ডিত মূর্খ নির্বিশেষে হরিনাম বিলিয়ে যেতে। নিত্যানন্দ প্রভুর আদেশ শিরোধার্য করে ফিরে এলেন গৌড়ে। পানিহাটি রাঘব ভবনে হলো তাঁর অভিষেক। সুগন্ধি জল ও নানা উপাচারে সম্পন্ন হল অভিষেক পর্ব।
এরপর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। নিত্যানন্দ আদেশ করলেন তাঁকে কদম ফুলের একটি মালা পরিয়ে দিতে। কিন্তু কদম ফুলের মালা পাবে কোথায় ? তখন যে ভরা জ্যৈষ্ঠ মাস , অসময়! নিত্যানন্দ দেখালেন এক অভূতপূর্ব ঘটনা। জাম্বীরের গাছে ফুটে উঠল রাশি রাশি কদমফুল ।
রাঘব পন্ডিত সহ নিত্যানন্দের দ্বাদশ অন্তরঙ্গ অনুগামী বৈষ্ণব ইতিহাসে #দ্বাদশ_গোপাল নামে পরিচিত। তাঁরা একের পর এক মালাচন্দন দিয়ে বন্দনা করলেন নিত্যানন্দকে। সহসা চতুর্দিকে দমনক পুষ্পের সৌরভে ভরে উঠলো। নিত্যানন্দ জানালেন শ্রীচৈতন্যদেব সূক্ষ্ম দেহে বৃক্ষতলে উপস্থিত হয়েছেন। পানিহাটির যে ঘাটে প্রথম চৈতন্যদেব পা রেখেছিলেন,তা শ্রীচৈতন্য ঘাট নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালের ভূমিকম্পে এই ঘাট ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও বর্তমানে তা সারাই হয়েছে। যে গাছের নিচে চৈতন্যদেব এবং নিত্যানন্দ বসে কৃষ্ণনাম প্রচার করেছিলেন, সেই ‘অক্ষয় বটবৃক্ষ’ এখনও বর্তমান আছে।
সেই অভিষেক সভায় অনেকের সঙ্গে মিশে ছিলেন জমিদার বাড়ির ছেলে রঘুনাথ মজুমদার। দূর থেকে নিত্যানন্দ তাঁকে লক্ষ্য করছিলেন। অবশেষে কাছে ডাকলেন …. #চোরা বলে সম্বোধন করলেন ।
লোকে বলে – নিতাই যারে দেয় সেই পায় গোরা।
রঘুনাথ সেই “গৌর প্রেমের একমাত্র বেপারী ” নিতাইয়ের অলক্ষ্যে গৌর রণে আশ্রয় ভিক্ষা করে চৌর্যকর্মে অভিযুক্ত হলেন । নিত্যানন্দ বললেন , সেই অপরাধের দণ্ড না স্বীকার করলে রঘুনাথের কোনদিনই গৌরাঙ্গ লাভ হবে না। কি হবে সেই দণ্ড ? কে জানে কিবা করতে বলে এই গৃহীসন্ন্যাসী। ভয়ে , দ্বিধায় রঘুনাথ দণ্ডগ্রহণে জন্য জোড় হস্তে , নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিত্যানন্দ রঘুনাথের এমন অবস্থা দেখে স্মিত হেঁসে বললেন –
” আমি তোমায় শাস্তি দিলাম – দধি চিঁড়া ভক্ষণ করাহ মোর গণে। “
অগণিত বৈষ্ণব ভক্তকে সেবা করার এমন অভাবনীয় সুযোগ পেয়ে ধন্য হলেন রঘুনাথ । চিঁড়া, দুধ, দই , সন্দেশ , চিনি, কলা রাশি রাশি এনে জড়ো করা হল রাঘব ভবনের দালানে। ছোট ছোট মাটির কলসী , যাকে লোকে বলে গুড়ের নাগরী , তার গলা কেটে বানানো হল মালসা। মালসা করে নিবেদন করা হল ফলার। রাঘব ভবনে সেই অক্ষয় বটবৃক্ষের নীচে সারি সারি আসন পাতা হল। প্রথমে বসলেন নিত্যানন্দ , তারপর তাঁকে ঘিরে বসলেন দ্বাদশ গোপাল। তাঁদের ঘিরে বসলেন নরনারী, উচ্চনীচ, ধনী গরিব নির্বিশেষে ভক্তকুল।
তীরে স্থান না পাইয়া আর কতজন
জলে নামি দধি চিঁড়া করয়ে ভক্ষণ
কেহ উপরে কেহ লে কেহ গঙ্গাতীরে
বিশজন তিন ঠাঁই পরিবেশন করে।
সমস্ত আহার্য একত্রিত হলে তাঁকে ঘিরে নিত্যানন্দ ধ্যানযোগে আহ্বান করলেন শ্রীচৈতন্যদেবকে। তাঁর অমৃতময় সূক্ষ্ম উপস্থিতি অনুভূত হল প্রতিটি ভক্তপ্রাণে। ধন্য হলেন রঘুনাথ , সার্থক হল তার এতদিনের প্রতীক্ষা, উদ্বেগ। এবার প্রব্রজ্যার শুভ যোগ আগত। এবার কেবলই বিদ্যা স্বরূপ মায়ার আলোকের অমৃতের পথে হেঁটে যাওয়া। গৃহত্যাগী হলেন অগাধ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী , হেঁটে গেলেন নীলাচলের পথে। শ্রীচৈতন্য সেথায় তাঁকে বুকে টেনে নিলেন সাদরে। এদিকে নিত্যানন্দ রঘুনাথকে অভিনব দণ্ড দিয়ে সূচিত করলেন এক মহোৎসবের , #দণ্ডমহোৎসব। এইদিন হতে বৈষ্ণব সমাজের নিকট মালসা ভোগ বড় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ল।
পাণিহাটির গঙ্গারতীরে দন্ডমহোৎসব এক পবিত্র ঐতিহ্য। প্রতিবছর জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে এই উৎসব চিঁড়া উৎসব নামেও খ্যাত হয়েছে। এসময় এক বিরাট চিঁড়ার মেলা বসে পানিহাটির গঙ্গার তীরে। প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলে আসছে সেই উৎসব। শ্রীচৈতন্যদেব চেয়েছিলেন উচ্চ নীচ নির্বিশেষে কৃষ্ণ উপাসনায় সকল মানুষের সমঅধিকার । পন্ডিতেরা যাকে বলে #আধ্যাত্মিক_গণতন্ত্র। নিত্যানন্দের দণ্ডমহোৎসবের পংক্তি ভোজন সেই আধ্যাত্মিক পথকে হোক নতুন করে সনাতন ধর্ম মুক্তির পথ দেখুক বিদেশে গিয়ে মধ্যযুগীয় সনাতন ধর্ম পচা গলা মৃতদেহ থেকে তিনি নির্মাণ করে দিয়ে গিয়েছিলেন এর নাম দিয়েছিলেন আধ্যাত্বিক গণতন্ত্র নিত্যানন্দ করালেন এমন একজন যেখানে নিঃশব্দে চুর চুর হয়ে গিয়েছিল উচ্চ নিচ অভিমান সফল হয়েছিল শ্রীচৈতন্যের ভাগ্ন
আঠারোশোতিরাশি খ্রিস্টাব্দে পাণিহাটি দন্ডমহোৎসবে উপস্থিত হয়েছিলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীমের কথামৃত সে বিষয় বিস্তারিত লিখেছিলেন- পেনেটিতে গাড়ি পৌঁছিবামাত্র দন্ডমহোৎসবের দারুন ব্যাপার স্যাপার দিকে ঠাকুর অবাক হয়ে গিয়েছিলেন । গাড়ির মধ্যে বসেই ঠাকুর বড় আনন্দ করেছিলেন । তারপর একা নেমে তীরের মত ছুটে গিয়েছিলেন মহোৎসবের ক্ষেত্রে। ঠাকুরের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা ঠাকুরকে খুঁজে না পেয়ে চিন্তায় মরি মরি অবস্থা, তারপর খুঁজতে খুঁজতে দেখলেন নবদ্বীপ গোস্বামীর কীর্তন দলের মধ্যে ঠাকুর দুহাত তুলে নৃত্য করছেন , মাঝে মাঝে সমাধিস্থ হয়ে যাচ্ছেন। পাছে ঠাকুর পড়ে যান, তাই শ্রীযুক্ত নবদ্বীপ গোস্বামী সমাধিস্থ ঠাকুরকে অতি যত্নে ধারণ করছেন। চতুর্দিকে ভক্তেরা হরিধ্বনি করে তাঁর চরণে পুষ্প ও বাতাসা প্রদান করছেন। একবার দর্শন করার সহস্র নরনারী ঠেলাঠেলি করছেন।
এ যেন সেই শ্রীচৈতন্যদেবের পুনরাবির্ভাবের ঘটনা। নর-নারী ভেবেছিলেন এই মহাপুরুষের ভিতরে নিশ্চয়ই গৌরাঙ্গের আবির্ভাব হয়েছে। দুজন তো একই রকম। আঠারশোপঁচাশি খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণদেব যখন শেষবার এই উৎসবে যোগদান করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর অন্যতম সঙ্গী নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ঠাকুরের দিব্যলীলা চৈতন্য নিত্যানন্দ উপস্থিতির অনুরণে অনুপ্রাণিত স্বামী বিবেকানন্দ এই অঞ্চলেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মূল কেন্দ্র স্থাপনের কথা চিন্তাও করেছিলেন । যদিও মন্দির সম্পর্কে নয় , তবুও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর বাইরে বেরোনোর প্রথম স্বাদ পেয়েছিলেন পেনেটিতে এসে।
ক্রমশঃ
তথ্যঃ শ্রী শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত
©দুর্গেশনন্দিনী
Excellent???????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????? I enjoy for the arrival.