প্রভাতে সময় কালে শচীর আঙিনার মাঝে কার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে ।
এক গৌরার নবীন বেশ মোড়াইয়া চাচর কেশ ।
সোনার অঙ্গ ধুলাতে লুটায় রে ।
গৌরার সোনার অঙ্গ ধুলাতে লুটায় রে ।
প্রভাত সময় কালে শচীর আঙিনার মাঝে কার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে ।
শোননি গো শচী মাতা গৌর আইল প্রেম দাতা ।
ঘরে ঘরে হরির নাম বিলায় রে ।
আজ দোলপূর্ণিমা। পলাশ , শিমূল , কৃষ্ণচূড়া, অশোকে রঙ্গীন বসন্তের প্রকৃতি ফাগ রঙ্গে রঙ্গে রঙ্গীন হয়ে উঠেছে। দোলপূর্ণিমার দিন এই বঙ্গ পেয়েছিল এক যুগপুরুষকে। যিনি মধ্যযুগীয় অন্ধকার হতে বঙ্গবাসীকে আলোকের পথ দেখিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানতম বিদ্যাপীঠ নবদ্বীপে উৎকৃষ্ট বৈদিক ব্রাহ্মণ কুলে জন্ম গ্রহণ করলেন বিশ্বম্ভর মিশ্র। পিতার জগন্নাথ মিশ্রের পান্ডিত্যধন অগাধ ছিল বলে নদীয়ায় তিনি সম্মানিত ছিলেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা বিশ্বরূপ তরুণ বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগী হন।
জগন্নাথ মিশ্রের পৈতৃক নিবাস শ্রীহট্ট (সিলেট)। বিদ্যা শিক্ষার জন্য জগন্নাথ মিশ্র শ্রীধাম এসেছিলেন। নীলাম্বর চক্রবর্তীর কণ্যা শচীদেবীকে বিবাহ করে তিনি স্থায়ী ভাবেই শ্রীধাম থেকে যান। লীলাময়ের লীলা বোঝা সম্ভব নয়।
মধ্যযুগের তুর্কি আক্রমণের পর ধর্ম আর বর্ণবাদ অভিশাপ রূপে দেখা দেয় সমাজে। কালের করাল গ্রাস থেকে মহা মুক্তির বাসনায় শ্রী অদ্বৈত প্রভূ প্রার্থনা জানান, শ্রী রাধা গোবিন্দ পদে। সেই শ্রী রাধা গোবিন্দের যুগল মুর্তি শ্রী গৌরাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হন শ্রীধাম।
অনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কৌল ।
সমর্পয়িতুমুন্নতোজ্জ্বলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ম্।।
বখতিয়ার খলজির হাতে গৌড়ের পতনের পাশাপাশি সুফিবাদী ধর্মাচার ধীরে ধীরে গ্রাস করেছিল বঙ্গের মানুষের চিন্তাজগৎ। সময়ের আবর্তে মরু সমাজের বিস্তৃতিতে একদিন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে সনাতনী সমাজ ও ধর্ম। কুল-বংশ-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে আপামর জনতাকে সঙ্গে নিয়ে বৈষ্ণববাদ প্রচার করতে শুরু করেন শ্রীচৈতন্য। দোল সনাতনী ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে বিবেচিত হলেও এখানে আলাদা মর্ম ও মাহাত্ম্য যোগ করেছেন তখনকার চৈতন্য অনুসারীরা। এ উৎসবকে হোলি নামেও অভিহিত করা হয়।
সনাতন ধর্ম মতে, দোল উৎসবের দেবতা হিসেবে সূর্য, বিষ্ণু, মদনমোহন ও শ্রীকৃষ্ণের পরিচয় মেলে। উৎসবের প্রধান অঙ্গ শত্রু নিধনের প্রতীকরূপে দেবতার গায়ে আবির মাখানো হয়। পুরাণে’ বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খচূড় বধের কাহিনী সামনে রেখে বহ্ন্যুৎসব বা চাঁচর উৎসব হয়। শঙ্খচূড় দৈত্যের নানা রূপের একটি হিসেবে দোল উৎসবে ক্ষীর পিটুলি দিয়ে মেষাসুর তৈরি করে তা পোড়ানোর অন্যতম দিক। তবে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বহ্ন্যুৎসবে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ রক্ষায় হোলিকা কুশপুত্তলিকা দাহ করার রীতি প্রচলিত আছে। দোল উৎসব আবার শ্রীকৃষ্ণের পুতনা বধের স্মৃতি জাগিয়ে দেয়। পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে মহারাষ্ট্রের যোদ্ধারা যুদ্ধে নিহত বীরদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য অগ্নিশিখা বেষ্টন করে নাচ-গান করত। তারা বসন্তকালকে যুদ্ধযাত্রার সেরা সময় ভেবে হয়তো প্রথম দিকে এ উৎসবকে আপন করেছিল। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুন মাসে পূর্ণিমার এই দিনে বৃন্দাবনে রাধা এবং অন্যান্যদের সঙ্গে রং-এর খেলায় মেতেছিলেন কৃষ্ণ। আরও বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে এই দিনটিকে ঘিরে। উত্তর ভারতে হোলি উৎসব পালিত হয় ফাল্গুন পূর্ণিমার পরের দিন।
বৈষ্ণব মত প্রচার কার্যে শ্রী চৈতন্য দেব বিভিন্ন গ্রাম থেকে গ্রামে যাত্রা করলেন। মহা পন্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম রামানন্দ রায় সবাই প্রভুর মহা ভাবে ভাবিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ প্রেমে মগ্ন হন। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুদ্ধ কৃষ্ণ প্রেম প্রচার শুরু করেন।
প্রেমহীন সংসারে কৃষ্ণ প্রেমই শান্তি প্রদান করতে পারে। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত গৌর সুন্দর। জাগতিক সংসারের সকল সুখ ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ সুখ অনুভব করেছেন। মধুর বৃন্দাবন দর্শন করে তিনি ভাবাবেশে আপ্লুত হন। মহা ভাবের অবতার হচ্ছে গৌরাঙ্গ অবতার। যার যতটা ভাব সে ততটাই প্রেম লাভের অধিকারী।
“যে জন গৌরাঙ্গ ভজে সে হয় আমার প্রানরে”।
কলিহত জীব কামনা বাসনার বেড়া জালে বন্দী। এ বন্দীদশা থেকে মুক্তির পথ হচ্ছে হরে কৃষ্ণ মহা মন্ত্র। নববিধ ভক্তির মাধ্যমে শ্রবনং কীর্তনং বিষ্ণোংঃ তম উত্তম। কলি যুগে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত রূপ ধারন করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রূপে অবতীর্ন হন। কলি যুগ অত্যন্ত অধঃ পতিত যুগ হলে ও ধন্য কলি বলা হয়েছে। পতিপাবন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রেমের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন।
বঙ্গবাসীর নিকট দোল পূর্ণিমার আলাদা মাহাত্ম্য আছে, কারণ, এই দিনই জন্মগ্রহণ করেছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু। এখন অবশ্য চৈতন্যদেবের ভক্ত এবং অনুগামীরা ছড়িয়ে আছেন সারা পৃথিবীতে। দোল পূর্ণিমাকে তাঁরা গৌর পূর্ণিমা নামেও ডেকে থাকেন। শুধু তাই নয়, চৈতন্যদেবের জন্মকে কেন্দ্রে রেখে প্রচলন করা হয়েছে আলাদা একটি অব্দের – যার নাম গৌরাব্দ।
বঙ্গাব্দ, বিক্রম সংবৎ অথবা শকাব্দের মতো খুব বেশি প্রচার না পেলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতাবলম্বীদের কাছে গৌরাব্দের আলাদা মূল্য রয়েছে। হিন্দু বৈষ্ণব ধারার এক প্রধান শাখা হল গৌড়ীয় বৈষ্ণব মত।
দোল পূর্ণিমা অর্থাৎ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথির ঠিক পরের দিনটি গৌরাব্দের প্রথম দিন। সেদিন থেকে শুরু হয় বিষ্ণু মাস। গৌরাব্দের ১২টি মাসের নাম রাখা হয়েছে নারায়ণের ১২টি নাম অনুসারে। বিষ্ণু মাসের পর আসে মধুসূদন। তারপর যথাক্রমে ত্রিবিক্রম, বামন, শ্রীধর, ঋষিকেশ, পদ্মনাভ, দামোদর, কেশব, নারায়ণ, মাধব এবং গোবিন্দ মাস। আর থাকে পুরুষোত্তম নামের অধিমাস। গৌরাব্দের বৈষ্ণব পঞ্জিকা আসলে চান্দ্র এবং সৌর বর্ষগণনা পদ্ধতির মিশ্রণ। কিন্তু সৌরমাস ও চান্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য এক নয়। সেই হিসেবকে মেলানোর জন্য গৌরাব্দের প্রতি তিন বছরে যোগ করা হয় একটি অতিরিক্ত মাস। সেটিই পুরুষোত্তম মাস।
চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানের পর থেকেই তাঁর ভক্তশিষ্যরা গৌরাব্দের প্রচলন করেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতানুগামীদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ-তিথি গণনা করা হয় গৌরাব্দের বৈষ্ণব পঞ্জিকা মেনেই। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের দোল পূর্ণিমার দিনে চৈতন্যদেবের জন্ম হয়েছিল সেই দিনের হিসাব ধরেই থেকেই গৌরাব্দের গণনা শুরু করা হয়। সেই অনুযায়ী ২০২০-২১ সালে গৌরাব্দ হবে ৫৩৪।
গঙ্গার পশ্চিম তীরে পলি জমে জমে গড়ে উঠেছে এক ভূখন্ড। কাঁটা ঝোঁপে পরিপূর্ণ, নাম তাই কণ্টকদ্বীপ। প্রায় পাঁচশ’ বছর আগের কথা। পবিত্র মকর সংক্রান্তির আগের দিন। সংসার ত্যাগ করে বৃহত্তর মানব সংসারের বিলীন হওয়ার কঠিন প্রতিজ্ঞা করে শেষ রাত্রে এক বস্ত্রে ঘর ছাড়লেন চব্বিশ বছরের সুদর্শন যুবক বিশ্বম্ভর মিশ্র। কনকনে ঠান্ডায় নেমে পড়লেন মা গঙ্গার বুকে। সাঁতরে চলে এলেন কন্টকদ্বীপ। এসে গঙ্গা তীরে মহাত্মা কেশব ভারতীর সকাশে নিবেদন করলেন মনোবাঞ্ছা। অনেক করে নিষেধ করলেন মহাত্মা। কিন্তু যুবক অটল। পাশেই বাড়ি মধু নাপিতের। সেও অনেক করে নিরস্ত করার চেষ্টা করল যুবককে। কিন্তু রসের সন্ধান যিনি পেয়েছেন, তাঁকে কে আটকাতে পারে?
মধু নাপিত মস্তক মুন্ডন করল। দীক্ষান্তে যুবকের নতুন নাম হল – শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যগিরি, ভারত তথা বিশ্বগৌরব শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
অতীতের কণ্টকদ্বীপ লোকমুখে হল কাঁটাদিয়া, আজ যার নাম কাটোয়া।
কাটোয়া স্টেশন থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে কাছারি রোডের থেকে এক গলি পথে গৌরাঙ্গ বাড়ী। এখানেই কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। ফটক পেরিয়ে ঢুকতেই ডান দিকে মধু নাপিতের সমাধি। ডান হাতে মস্তক মুন্ডনের জায়গা, বাঁধানো ও ঘেরা। তার পাশেই সন্ন্যাস গ্রহণের ও নাম প্রকাশের স্থান। তার পিছনে কেশব ভারতীর সমাধি। গৌরাঙ্গ বাড়ীর সেবাইত যদুনন্দন ঠাকুরের বংশধরদের ও দাস গদাধরের সমাধিও রয়েছে পাশে। সেসবকে বাম দিকে রেখে সামনে একটু গেলেই মূল মন্দির। সেখানে গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। মূর্তিটি শ্রীখন্ডের নরহরি সরকারের তৈরী। সুন্দর শান্ত পরিবেশ।
গৌরাঙ্গবাড়ী থেকে মাইল খানেক দূরে মাধাইতলা। জায়গাটি কাটোয়ার এক প্রান্তে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কাটোয়ার পথে এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। মঠ বাড়ীতে ঢুকে একটা প্রাচীন মাধবী গাছ দেখা যায়। এটাই বিশ্রামের স্থান বলে খ্যাত। পাশে জগাই-মাধাই খ্যাত মাধাইএর সমাধি। বিরাট নাট মন্দিরে নিরবিচ্ছিন্ন তারকব্রহ্ম নামকীর্তন চলছে। একশ’ বছরের বেশী সময় ধরে একটানা এই নাম গান হয়ে চলেছে। চারটি দল পালা করে এই কীর্তন করে। মূল মন্দিরে গৌর-নিতাই, রাধাগোবিন্দ ও গোপীনাথের বিগ্রহ।
মাধাইতলা দেখে পূর্ব দিকে একটু যেতেই প্রাচীন এক নদীখাত, কচুরিপানায় ভর্তি। সেখানে জলপিপি সংসার পেতেছে। গঙ্গার সমান্তরাল সেই নদী খাত যে গঙ্গার মজে যাওয়া প্রাচীন প্রবাহ, তা বেশ বোঝা যায়। আরো কিছুটা গিয়ে মা গঙ্গা। পাঁচশ’ বছর আগের সমাজ বিপ্লবী যেন দুই হাত তুলে আজও বলছেন – “ওঠো, জাগো, তোমরা অমৃতের সন্তান। সেই ঘোর মরু আমলে আমি নিজে রাজরোষকে তুচ্ছ করে সিংহের মত নগর পরিক্রমা করেছি। দোর্দন্ড প্রতাপ কাজী আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছে। স্বাধীন ধর্মাচরণ তোমার অধিকার।”
© দুর্গেশনন্দিনী