ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চল থেকেই । 1857 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সিপাহি মঙ্গল পান্ডে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান চেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন গঙ্গার তীরবর্তী ব্যারাকপুরের সেনা ব্যারাক থেকেই। মার্কসবাদী আর কংগ্রেসী ঐতিহাসিক দের কাছে এই বিদ্রোহ সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত হলেও, বিনায়ক দামোদর সাভারকার মঙ্গল পাণ্ডের সূচনা করা বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই হিসাবে দেখলে ভারতের প্রথম মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছিল দক্ষিণ বঙ্গের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলে থেকেই। পরবর্তী কালে ভারত তথা দক্ষিণ বঙ্গের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলে সশস্ত্র ও সহিংস আন্দোলনের জোয়ার নামে। অনেক ঐতিহাসিক আছেন যাঁরা গান্ধীজীর নেতৃত্বে অহিংস আন্দোলনকে ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল ধারা বলে মনে করেন। কিন্তু গান্ধীজী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মপ্রকাশ করার আগেই বাংলা, মহারাষ্ট্র পাঞ্জাব সহ বেশ কিছু রাজ্যে রীতিমতো সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে কাঁপিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই সশস্ত্র সংগ্রামের অনুপ্রেরণা এসেছিল বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্ স্তোত্র (দক্ষিণ বঙ্গের গঙ্গার তীরে বসেই বঙ্কিম এই বিখ্যাত স্তোত্র রচনা করেন যার মধ্যে রয়েছে দেবী দুর্গার স্তব ) , স্বামী বিবেকানন্দের পৃথিবী কাঁপানো শিকাগো
বক্তৃতামালা (যা সমগ্র জগত বাসির কাছে ভারতের সনাতন ধর্ম ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছিল) আর বিপিনচন্দ্র পালের রাজনৈতিক চিন্তা । তাই গান্ধীজীর ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগেই বিশেষত বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলা সশস্ত্র আন্দোলনে সারা ভারতের মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থান করে নেয়। এই সময় বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অগ্নিযুগ নামে পরিচিত।
এই সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল দক্ষিণ বঙ্গের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের বিপ্লবীরা। দক্ষিণ বঙ্গের এই গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলেরই এক অগ্নিশিশু হলেন গোপীনাথ সাহা। তাঁর জন্ম 1905 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে বছরটি ছিল বঙ্গভঙ্গের বছর। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তখন সামিল সমগ্র বাংলা। তাঁর পিতা বিজয় কৃষ্ণের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন গোপীনাথ। পিতা কর্মসূত্রে থাকতেন কলকাতার বরাহনগর এলাকায়। সেখানেই জন্ম হয়
গোপীনাথের। তবে তাঁদের আদি বাড়ি ছিল হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে যে রাস্তার বর্তমান নাম ক্ষেত্রমোহন শা স্ট্রিট। বিজয় কৃষ্ণের অকাল মৃত্যুর পর গোপীনাথের মা তাঁর চার সন্তানকে নিয়ে শ্রীরামপুরে চলে আসেন। অভাব সত্ত্বেও তিনি সযত্নে লেখাপড়া শেখান তাঁর সন্তানদের। গোপীনাথ প্রথমে শ্রীরামপুরের বল্লভপুর এম ই বিদ্যালয়ে এবং পরে ঐতিহ্যবাহী ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন।
বাল্যকাল থেকেই গোপীনাথ ছিলেন ধীর স্থির, আদর্শনিষ্ঠ, দয়ালু, সেবাপরায়ণ ও পরিশ্রমী। তৎকালীন সময়ে বাংলার বিপ্লবীদের দেশমাতার স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ তাঁকেও উদ্দীপিত করেছিল। 1919 খ্রিস্টাব্দের 18 মার্চ ব্রিটিশ সরকার দমনমূলক রাওলাট আইন জারি করেন। ওই বছরেই কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ঘটে। ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্বেষ এই সময় প্রবল হয়ে ওঠে সর্বত্র। 1921 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরের বল্লভপুর ঠাকুর বাড়ি প্রাঙ্গণে একটি সভায় ভারতীয় ছাত্রদের ব্রিটিশ স্কুল কলেজ ছেড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার ডাক দেওয়া হয়। গোপীনাথ ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং ওই ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বিদ্যালয় ও বাড়ি ছাড়েন। এরপর তাঁর আশ্রয়স্থল হয় হুগলি বিদ্যামন্দির, যেটি একই সঙ্গে ছেলেদের আবাসিক বিদ্যালয় এবং হুগলি জেলা কংগ্রেস কার্যালয় ছিল।
হুগলি বিদ্যামন্দিরে থাকার সময় গোপীনাথ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করেন।
এক বৃদ্ধাকে গঙ্গায় ডুবে যাওয়ার হাত থেকে তিনি রক্ষা করেন এবং তাঁকে বিদ্যামন্দিরে এনে সুস্থ করেন। আবার উত্তরবঙ্গে এই সময় চা বাগানের শ্রমিকদের ওপর ইউরোপীয় মালিকদের অত্যাচার চরমে ওঠে। চা শ্রমিকরা উৎপীড়নের ভয়ে আসামের চাঁদপুরের বাগানে আশ্রয় নেন । তখন ইউরোপীয় মালিকদের নির্দেশে গোর্খা রেজিমেন্টের সেনারা বহু শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করেন। গোপীনাথ এইসময় চাঁদপুরে যান এবং ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার তাঁর মনে ব্রিটিশদের প্রতি এক গভীর বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। মোপলা বিদ্রোহে ব্রিটিশদের অত্যাচারও তাঁকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে উৎসাহ যোগায়।
1922 খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরাতে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ব্রিটিশ পুলিশের চৌকি আক্রমণ করেন এবং 22 জন ব্রিটিশ পুলিশ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এই অবস্থায় গান্ধীজী ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দেন। গান্ধীজীর এই খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে বাংলার বিপ্লবী সমাজ অসন্তুষ্ট হয় এবং বিপ্লবীরা সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যেতে মনস্থির করেন। ওই বছরই উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয় সারা বাংলা আর্ত ত্রাণ সমিতি। গোপীনাথ এই ত্রাণকার্যে নিজেকে সঁপে দেন। এই সময় গোপিনাথের বয়স মাত্র 17 বছর।
অর্থাৎ দেখা যায় ছোটবেলা থেকেই গোপীনাথ দেশ সেবার কাজে উদ্বুদ্ধ ছিলেন।
গান্ধীজীর বিরোধিতা করে বাংলার বিপ্লবীরা যখন সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যেতে মনস্থির করলেন, তখন গোপীনাথ এই সশস্ত্র আন্দোলনে দায়িত্বপূর্ণ কোন ভূমিকা পাবার জন্য উদ্যোগী হন। এই সময় তিনি কলকাতার সরস্বতী লাইব্রেরী ও প্রেস, খুলনা জেলার দৌলতপুর সত্যাশ্র়ম, বরিশালের শংকর মঠ, উত্তরপাড়া বিদ্যাপীঠ প্রভৃতি বিপ্লবী সংগঠনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। এই সময় তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষের গ্রেপ্তার গোপীনাথের মনে তীব্র যন্ত্রনার সৃষ্টি করে। এই সময় তিনি কলকাতায় হরিনারায়ন চন্দ্র নামে এক বিপ্লবীর কাছে থাকতে শুরু করেন। এই হরি নারায়ন চন্দ্র গোপীনাথকে দায়িত্ব দেন তৎকালীন দিনের কুখ্যাত ইংরেজ পুলিশ অফিসার চার্লস টেগার্টকে হত্যা করতে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই চার্লস টেগার্ট এর বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বুড়িবালামের তীরে বাঘাযতীন এবং তাঁর সঙ্গীরা বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তরুণ গোপীনাথ এইরকম দায়িত্ব পেয়ে খুশি হলেন।
গোপীনাথ অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে টেগার্ট সাহেব থাকেন 2 নং কিড স্ট্রীটে। সেখানকার পুলিশ পাহারা ছিল দুর্ভেদ্য। তাই তিনি পরিকল্পনা করলেন সকালবেলা ময়দানে যখন টেগার্ট সাহেব প্রাতঃভ্রমণে আসেন, তখন তাঁকে হত্যা করার। কারণ এই সময় তিনি দেহরক্ষীহীন অবস্থায় থাকেন। অবশেষে 1924 খ্রিস্টাব্দের 12 জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে গোপীনাথ বেরোলেন টেগার্টের খোঁজে। আশ্চর্য ঐতিহাসিক সমাপতন। 12 জানুয়ারি ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম অনুপ্রেরণাদানকারী স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। গোপীনাথের পরনে ছিল ধুতি আর খাঁকি জমা, পকেটে গুলি ভরা রিভলবার। তিনি হঠাৎ দেখলেন রাস্তার পশ্চিম দিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক সাহেব। 19 বছরের তরুণ গোপীনাথ তাঁকেই চার্লস টেগার্ট মনে করে চালিয়ে দিলেন গুলি। সাহেব মারা গেলেন কিন্তু গোপীনাথ ধরা পড়ে গেলেন। তবে ধরা পড়লেও লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বুঝে তিনি মনে মনে শান্ত রইলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকীর মত লক্ষ্যভেদে ভুল হয়েছিল তাঁরও। পরে তিনি জানলেন যে তিনি যাঁকে হত্যা করেছেন, তিনি কিলবার্ন কোম্পানির এক কর্মকর্তা। তাঁর নাম আর্নেস্ট ডে। লক্ষ্যভেদ না হওয়ার যন্ত্রনা এবং নিরাপরাধ মানুষ হত্যার মর্মবেদনা জেলে বসে উপলব্ধি করেন গোপীনাথ।
গোপীনাথ সাহার বিচার শুরু হয় 14 জানুয়ারি চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। এই সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকাতে চৌরঙ্গী হত্যাকান্ড শিরোনামে এই মামলার বিবরণ এবং গোপীনাথের নির্ভীক বক্তব্য প্রকাশিত হত। আদালতে দাঁড়িয়ে গোপীনাথ স্বীকার করেন যে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের বিষাক্ত কাঁটা টেগার্ট সাহেবকে তিনি হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দেশ ও জাতির শত্রুকে হত্যা করার পরিবর্তে তাঁর মতো দেখতে এক নির্দোষ সাহেবকে তিনি হত্যা করেছেন। তিনি আদালতে টেগার্টের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হেসে বলেন যে টেগার্ট সাহেব হয়তো ভাবছেন যে তিনি নিরাপদ, কিন্তু তাঁর আরম্ভ করা কাজ পূর্ণ করার জন্য ভারতবর্ষে অসংখ্য তরুণ আছে। এই মামলাতে আরো অনেক বিপ্লবী জড়িয়ে পড়তে পারতেন । কিন্তু সাহসী গোপীনাথ সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং অন্যদের আড়াল করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পরামর্শে বেশ কয়েকজন আইনজীবী গোপীনাথের পক্ষে সওয়াল করেন, কিন্তু গোপীনাথের নির্ভীক এবং সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তির কারণে তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে গোপীনাথের প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়। এই আদেশ গোপীনাথকে দুঃখিত করতে পারেনি; উপরন্তু তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন যে তাঁর প্রত্যেক রক্তবিন্দু যেন ভারতের ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বীজ বপন করে।
অবশেষে 1924 খ্রিস্টাব্দের 1 মার্চ প্রেসিডেন্সি জেলে গোপীনাথের ফাঁসি হয়। সুভাষচন্দ্র বসু পরিকল্পনা করেছিলেন গোপীনাথের দেহ নিয়ে মিছিল করে শ্মশান যাত্রা করার। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার জেলের মধ্যে গোপীনাথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে। তবে গোপীনাথ সাহার আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। কলকাতার হরিশ পার্কে গোপীনাথের শোক সভা আয়োজিত হয়। সুভাষচন্দ্র গোপীনাথের উত্তরীয় মাথায় বেঁধে সেই শোক সভায় আগুনঝরা বক্তৃতা করেন এবং পরদিনই তিনি গ্রেফতার হন।
হুগলির এক অত্যন্ত প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী জনপদ শ্রীরামপুর। বাংলার শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতে এই জনপদের অন্যতম অবদান রয়েছে। সেই শ্রীরামপুরের সন্তান গোপীনাথ সাহার
আত্মবলিদান ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে শ্রীরামপুরের সগৌরব উপস্থিতিকে তুলে ধরে। গোপীনাথের দেশপ্রেম, সেবার মানসিকতা, সাহসিকতা, নির্ভীকতা শুধু শ্রীরামপুর বা দক্ষিণবঙ্গের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চল নয়, সমগ্র দেশের উত্তর প্রজন্মকেই অনুপ্রাণিত করবে। মনে রাখতে হবে ক্ষুদিরাম বসু যদি 18 বছর বয়সে ফাঁসির মঞ্চে বলিদান দিয়ে থাকেন, তাহলে গোপীনাথ সাহা ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছেন মাত্র 19 বছর বয়সে। ক্ষুদিরাম বা গোপীনাথের এত কম বয়সে দেশের জন্য আত্মবলিদান নিঃসন্দেহে অনুসরণীয়।
তথ্যসূত্র : শ্রীরামপুরের গুণীজন – ডঃ প্রীতি মাধব রায়। চৌধুরী পাড়া, চাতরা, শ্রীরামপুর, হুগলি ।
সূর্য শেখর হালদার