‘জল’– জ-তে জীবন, ল-তে লয়; জল জীবনের ধারক, আবার জল মৃত্যুর কারক। ভগবান তিনটি অবতার জুড়ে জলের মায়া কাটাতে পারেননি — মীন অবতারে, কূর্ম অবতারে সরাসরি জলে, আর বরাহ অবতারে জল-ডাঙ্গার কাদামাটিতে গড়াগড়ি দিয়েছেন। মহাপ্রলয়ের কথা যেমন পুরাণে আছে, আছে বিজ্ঞানের বই-এ। জল সংকট এবং জল দূষণ আজকের দিনে প্রবল সমস্যা।
জল তো অনেক, পানীয় জল কই?
ইংরেজ কবি Samuel Taylor Coleridge ১৭৯৭-৯৮-এ ‘The Rime of the Ancient Mariner’ কাব্যে লিখছেন, “Water, water, everywhere /Nor any drop to drink” ঠিক ১০০ বছর বাদে ২৯ আগস্ট, ১৮৯৭ সালে ওড়িশার আলভা খালে বজরায় বসে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাখানি, “জল শুধু জল/দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।” লিখছেন, “মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর, /লোলুপ লোলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রুর।” প্রায় আরও একশ বছর বাদে ১৯৮০ সালে ইউনাইটেড নেশনস বিশ্বকে উদ্বুদ্ধ করল, ‘International Drinking Supply and Sanitation Decade” পালনের জন্য। সেই দশক পালনের পরিসমাপ্তিতে ভারতীয় ডাকবিভাগ ১৯৯০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তা স্মরণীয় করে রাখতে প্রকাশ করল ডাকটিকিট : স্বচ্ছ জল Safe Water শিরোনামে; নিরাপদ, জীবাণুমুক্ত পানীয় জল গ্রহণের বার্তা দিয়ে।
জল সংক্রান্ত ভারতীয় ডাকটিকিট:
১৯৯০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ‘ভারতীয় পোস্ট’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘স্বচ্ছ জল’ (Safe Water) বিষয়ক ডাকটিকিটটির মূল্য ছিল ৪ টাকা। ১৯৯৯ সালের ২৩ নভেম্বর ৩ টাকা মূল্যের একটি ডাকটিকিট ছাপা হয়। সেটা হল অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলার শ্রী সত্য সাই জল সরবরাহ প্রকল্পের ছবি। পানীয়জলের এই প্রকল্প ছিল রুখাশুখা এলাকার এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ২০০৩ সালের ৩ অক্টোবর চারটি ডাকটিকিটে জলপ্রপাতের ছবি আছে — ৫ টাকা দামের আথিরাপল্লী (কেরালা), ১৫ টাকা দামের যোগ (কর্ণাটক), ৫ টাকা দামের কেমটি (উত্তরাখণ্ড) এবং ৫ টাকা দামের কাকোলাট (বিহার)। ২০০৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর জলবর্ষ পালন উপলক্ষে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়, দাম ৫ টাকা। ২০১৩ সালে ৫ টাকা মূল্যের টিকিটে ভাকড়া বাঁধের ছবি। এটি ভাকড়া বাঁধের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত ডাকটিকিট। এছাড়াও ভাকড়া বাঁধ নির্মাণের চার বছর পরে আলাদাভাবে দুটি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। এতগুলো ডাকটিকিট প্রমাণ করে ভাকড়া বাঁধ ভারতের কাছে কত মূল্যবান।
ভাকড়া ছাড়াও ১ আনা দামের দামোদর ভ্যালি (তিলাইয়া) এবং ৩০ পয়সা দামের হিরাকুঁদ বাঁধের ছবি দিয়ে (২৩ অক্টোবর, ১৯৭৯) ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছিল (যথাক্রমে ১৯৫৫ এবং ১৯৭৯ সালে)। ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর ৫ টাকা মূল্যের একটি টিকিটে পুণেতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় জল ও শক্তি গবেষণা কেন্দ্র (Central Water and Power Research Station, CWPRS)-র ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
সনাতনী সংস্কৃতিতে জল:
অষ্টাদশ বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী, তন্ত্র ও মন্ত্রে কীর্তিত, নৃত্যগীত ইত্যাদি কলাবিদ্যার দেবীরূপে চিহ্নিত হলেও আদিতে সরস্বতী ছিলেন জলের দেবী, নদীরূপে পূজিত। “অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।” ‘সরস’ শব্দের অর্থ জল, শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর প্রধান ভূমিকা ছিল। উর্বর নদী তীরে আর্য-ঋষিরা রূপদান করেছিলেন বৈদিক সংস্কৃতির। সেই সূত্রে জলের প্রত্যক্ষ দেবী কৃষি ও উর্বরতাকে ছাপিয়ে হয়ে গেলেন জ্ঞান ও বিদ্যার পরোক্ষ দেবী।
ভারতীয় পূজন পদ্ধতিতে জলশুদ্ধির কথা আছে, পুরোহিত দর্পণ খুললেই পাওয়া যায় অঙ্কুশ মুদ্রায় কোশার জলে তীর্থ আবাহনের মন্ত্র — “ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী / নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্মিন্ সন্নিধিং কুরু।” মহাসপ্তমী তিথিতে দেবী দুর্গাকে ভৃঙ্গারে করে মহাস্নান করানো হয়, তাতে থাকে নানান জল-সম্ভার; নদীজল, শঙ্খজল, উষ্ণজল, গোময়, দধি, দুগ্ধ, স্বর্ণোদক, রজতোদক, পুষ্পোদক, ইক্ষু রস, তিল তৈল, পঞ্চকষায়োদক, নির্ঝরোদক, নারিকেলোদক, সর্বৌষধি জল, সহস্রধারা জল। নদীজলে স্নানের মন্ত্র এমনতর — “ওঁ আত্রেয়ী ভারতী গঙ্গা যমুনা চ সরস্বতী /সরযূর্গণ্ডকী পুণ্যা শ্বেতগঙ্গা চ কৌশিকী।।/ ভোগবতী চ পাতালে স্বর্গে মন্দাকিনী তথা।/সর্বাঃ সুমনসো ভূত্বা ভৃঙ্গায়ৈ স্নাপয়ন্তু তাঃ।” ভারতবর্ষ যখন জলের সদ্ব্যবহারের জন্য ‘নদী সংযুক্তি’-র চিন্তাভাবনা করে, তখন তার পশ্চাতে এই নদী-বোধ, নদী আবাহনের অধ্যাত্ম-দর্শন কাজ করে।
কোথায় কত জল?
বিশ্বের যে এত জল ভাণ্ডার, তার সিংহভাগই কিন্তু পানের অযোগ্য, কৃষি কাজের অযোগ্য, শিল্পে ব্যবহার হলে কলকব্জা নষ্ট হয়ে যায়, কারণ সে জল নোনা। এই গ্রহের তিন ভাগ জল, একভাগ স্থল হলেও, পার্থিব জলের প্রায় সাতানব্বই শতাংশ নোনা, তা খাঁড়ি, সাগর, মহাসাগরেরই শুধু আছে তা নয়, আছে মাটির তলার জলের খানিক অংশ জুড়ে, আছে নোনাজলের হ্রদেও। পৃথিবীর এক শতাংশের কিছু কম জল স্বাদু বা মিষ্টি, পান ও মানুষের কাজের উপযুক্ত। আর দুই শতাংশ জল জমা হয়ে আছে মেরুপ্রদেশে, গ্রিনল্যান্ড, পর্বতশিখরে।
পৃথিবীর মোট জলের পরিমাণ প্রায় ১৩৯ কোটি ঘন কিলোমিটার। সমুদ্রের নোনা জল ছাড়াও ১৩ লক্ষ ঘন কিলোমিটার নোনাজল মাটির তলায় আর নোনা হ্রদে আছে। আর মিষ্টি জলের মাত্র ০.৩% অর্থাৎ ১ লক্ষ ঘন কিলোমিটার জল আছে জলাভূমি, পুকুর, খাল, বিল, হ্রদ, নদী-নালায়। ১৩ হাজার ঘন কিলোমিটার আকাশে, জলীয় বাষ্প আর মেঘ হয়ে; এক হাজার ঘন কিলোমিটার জল আছে জীবদেহের কোষে-কোষে, জীবনের পরতে পরতে।
ওগো মেঘ/ তুমি উড়ে যাও/ কোন ঠিকানায়:
মেঘ মানেই কী বৃষ্টি? কবি লিখছেন, “আসে বৃষ্টির সুবাস/বাতাস বেয়ে”। তার মানে মেঘ হল একটা আশা, মেষ-বর্ষী জলের আশা। অনেক মেঘ উড়েই যায়, ভেসেই চলে, জল দেয় না, তৃষ্ণা মেটে না। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ” পুঞ্জে পুঞ্জে দূর সুদূরের পানে/দলে দলে চলে,/ কেন চলে নাহি জানে।”
কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে দেখা যায় বাঙ্গলায় মেঘ চারপ্রকার – আবর্ত, দ্রোণ, পুষ্কর, সংবর্ত। আবর্ত হল ঘূর্ণায়মান মেঘ/প্রত্যাবর্তনকারী বা পরিভ্রমণকারী মেঘ যা নির্জল, বৃষ্টি হয় না; “আবর্ত জলদ রাজ/ সাধহ চণ্ডীর কাজ।” ‘দ্রোণ’ শস্যের পরিমাপক, এই মেঘের বৃষ্টি ফসলের পরিপূরক; “পান লব মেঘ দ্রোণ/সাধিবে আমার লোণ/শীঘ্র চল চণ্ডীকার সঙ্গে।” ‘পুষ্কর’ রাজস্থানের এক হ্রদ, সেখানে জল পাওয়া খুব দুষ্কর, এই মেঘেও বৃষ্টির সম্ভাবনা বিরল; “চলরে পুষ্কর মেঘ,/ দুষ্কর তোমার বেগ।” ‘সংবর্ত’ হল মহাপ্রলয়ের মেঘ; “সংবর্ত করহ হিত/তুমি প্রলয়ের মিত।” কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে, “চারি মেঘে জল দেয় অষ্ট গজরাজ”।
এছাড়া অলক মেঘ, ঊর্ণা মেঘ, কুন্তল মেঘ নামে যে মেঘগুলি বাঙ্গলায় পরিচিত তা সকলই তন্তুময় মেঘ বা Cirrus. অলোক মেঘ হল পেঁজা তুলোর মত, কেশগুচ্ছের মতো; উর্ণা মেঘ ভেড়ার লোমের মতো বা পশমের মতো; কুন্তল মেঘ চুলের মতো।
রয়েছে কোদালে বা কুড়ুলে মেঘ, জমি কোপানোর মতো মেঘের দশা, পেঁজা তুলোর মতো খণ্ড খণ্ড করে কোপানো, চিত্র-বিচিত্রিত মেঘ। তখন আকাশকে বলা হয় Mackerel Sky. মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হতে পারে। খনার বচনে আছে, ” কোদালে কুড়ুলে মেঘের গা/মধ্যে মধ্যে দিচ্ছে বা।” নজরুল লিখছেন, “কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে, আকাশে নীল গাঙে।”
জলুয়া মেঘ বা জলো মেঘ — অবশ্যই বৃষ্টি হবে, এটি Nimbus Cloud.
সিঁদূরে মেঘ, হিঙ্গুলিয়া মেঘ, হিঙলে মেঘ, রাঙা মেঘ — আগুনের আভার মতো লাল, পারদ-গন্ধক মিশ্রিত ঘোর রক্তবর্ণ মেঘ, সন্ধ্যারাগযুক্ত মেঘ।
ঈশানী মেঘ — “ঈশান কোণেতে ওই যে ঝড়ের বাণী/গুরু গুরু রবে কী করিছে কানাকানি।” (গীতাঞ্জলি) মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখছেন, “ঈশানে উড়িল মেঘ সঘনে চিকুর/উত্তর পবনে মেঘ ডাকে দুর দুর।”
হাঁড়িয়া মেঘ হল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ; কৃত্তিবাসী রামায়ণে পাই, “হাঁড়িয়া মেঘ যেন কাল কুম্ভকর্ণ”। কজ্জল মেঘের কথাও পাওয়া যায়, সেটিও ঘনকৃষ্ণ এবং সজল; রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ” সিগ্ধ সজল মেঘ কজ্জল দিবসে।”
মেঘ সম্পর্কিত লোকাচার:
বাঙ্গলায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, “আশায় মরে চাষা।” পূর্ববঙ্গের একটি লোকাচার “মেঘ্যারাণীর কুলো নামানো”; এটি নমঃশূদ্র কৃষক মেয়েদের একটি ব্রত; একটি জাদু-প্রক্রিয়া — Imitative Magic, নকল বৃষ্টির আয়োজনে বাস্তবে বৃষ্টি নামবে, এই লোকবিশ্বাস। কোচবিহার, জলপাইগুড়িতে রাজবংশী মেয়েরা কৃষিক্ষেত্রে বর্ষণদেবতা হুদুমদেও-র কাছে নগ্ন নৃত্য পরিবেশন করে। মুসলমানদের আর্জি “আল্লা ম্যাঘ দে, পানি দে।” কোথাও বৃষ্টি নামাতে ব্যাঙের বিয়ে, ব্যাঙের উৎসব। এদিকে মেঘবৃষ্টির কামনায় বসুধারার ব্রত পালন করে বঙ্গ-রমণী। চৈত্র বৈশাখ মাসে বন্দোবস্ত করা হয় ‘তুলসী ঝারা’-র সংস্কৃতির। মেয়েলি মন্ত্র উচ্চারিত হয়, “গঙ্গা গঙ্গা ইন্দ্র চন্দ্র বাসুকি /তিন কুলে ভরে দাও/ধনে জনে সুখী।”
সাগরের জল থেকে পানীয়:
ভারতের প্রথম এবং সর্ব-বৃহৎ সমুদ্র-জলের নোনা-মুক্তি প্রকল্প রয়েছে চেন্নাই শহরের অদূরে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ৬০ একর জায়গা জুড়ে। Chennai Water Desalination Plant Limited এবং IVRCL উদ্যোগের এই প্রকল্প থেকে ২৫ লক্ষ চেন্নাইবাসীর জন্য দৈনিক ১০০০ লক্ষ লিটার পানীয়জল উৎপাদিত হয়; প্রতি ঘন মিটার জলের বিক্রয়মূল্য ৬০ টাকা। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে প্রকল্প শুরুর ২৫ বছর বাদে তা রাজ্য সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এখানে জল পরিবর্তিত হয় Reverse Osmosis প্রক্রিয়ায়, যাতে সাগর-জলের লবণ ও অন্যান্য অশুদ্ধি সরিয়ে ফেলা যায়। সাগর-জলকে তেড়ে প্রবেশ করানো হয় সেমি-পারমিয়েবল মেমব্রেনের মধ্যে। এই পদ্ধতিতে ডিস্টিলেশনের তুলনায় কম শক্তি ব্যয় হয়।
জলীয়বাষ্প শোষণ করে পানীয়:
ইজরায়েলী প্রযুক্তিতে তৈরি বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প রূপান্তর করে জল তৈরির কৌশলে রয়েছে খুব সহজ একটি বিজ্ঞানের প্রয়োগ। মেশিন জলীয়বাষ্পকে মানুষের ব্যবহারোপযোগী করে তুলছে। এই মেশিনের দুটি অংশ — Water Adsorption বা জলীয়বাষ্প শোষণ এবং Water Harvesting বা জল-চয়ন। শোষণ পর্যায়টি চলে মূলত রাতে, the device is opened, allowing air to flow into a porous MOF that grabs and holds water molicules. আর চয়ন পর্বটি সাধিত হয় মূলত দিনে, দিনের বেলায় চেম্বারটি বন্ধ রাখা হয়, সৌরশক্তির তাপ MOF কে উত্তপ্ত করে, তাতে তা জলকে বাষ্পে ছেড়ে দেয়, আর তা জমে জল হয়, সেটাই পাইপ-লাইনের কল দিয়ে ধরতে হয়।
“ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা:
সে পথে পথে বের হয়ে আপন-হারা, তার চলা যায় না বলা…… আসলে সময় আর স্রোত থেমে থাকার সত্তাই তো নয়! Time and tide wait for none. রবীন্দ্রনাথ তা অবিশ্বাস করেননি, তবুও তো তাঁকে লিখতে হল নদীবাঁধার নাটক, মুক্তধারা, আর অভিজিৎ নামক এক বাঁধ-ভাঙ্গা যৌবন এসে উন্মুক্ত করল জলধারা।
উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ ঝর্ণার জল অবরুদ্ধ করেছেন যন্ত্ররাজ বিভূতিকে দিয়ে। উদ্দেশ্য শিবতরাইবাসীকে জব্দ করা। রাজা বলছেন, “তৃষ্ণার শূলে শিবতরাইকে বিদ্ধ করে তাকে তিনি উত্তরকূটের সিংহাসনের তলায় ফেলে দিয়ে যাবেন।” ভিন রাজ্যের প্রজাকে দমন করতে তাদের উর্বর শস্যশ্যামলা ভূ-খণ্ডকে মরুভূমি করে দেবার এক অমানবিক নীতি হল নদীবাঁধ। শুধু শায়েস্তা করেই ক্ষান্তি নয়, উত্তরকূটের পাঠশালায় শিশুমনে বপন করে দেওয়া হয়েছে পর-জাতির প্রতি বিদ্বেষ।
রণজিৎ : বিভূতি কী করেছে এরা সবাই জানে তো?
ছেলেরা : (লাফাইয়া, হাততালি দিয়া) জানি, শিবতরাইয়ের খাবার জল বন্ধ করে দিয়েছেন।
রণজিৎ : কেন দিয়েছেন?
ছেলেরা : (উৎসাহে) ওদের জব্দ করার জন্যে
রণজিৎ : কেন জব্দ করা?
ছেলেরা : ওরা যে খারাপ লোক
রণজিৎ : কেন খারাপ?
ছেলেরা : ওরা খুব খারাপ, ভয়ানক খারাপ, সবাই জানে।
রণজিৎ : কেন খারাপ তা জান না?
গুরু : জানে বৈকি মহারাজ! কীরে, তোরা পড়িস নি? বইয়ে পড়িস নি? ওদের ধর্ম খুব খারাপ।
Rival কথাটির অর্থ প্রতিদ্বন্দ্বী, কথাটি ফরাসী ‘রিভেলিস’ শব্দ থেকে এসেছে, যারা একই নদীর জল ব্যবহার করে। নদীর জলবন্টন নিয়ে শুরু হয়েছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তাই আমরা দেখতে পাই মেসোপোটেমিয়া সভ্যতায় জলবণ্টনের শান্তিপূর্ণ কার্যক্রম করতে চালু হয়েছিল নিয়মকানুন। সেচের জল-চুরি এক শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল। আজকের দিনে জল নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে বিরোধ, দেশে দেশে বিরোধ, জল-পাওয়া ও না-পাওয়ার কাহিনী এক হাইড্রো-পলিটিক্সের গল্প।
ব্রহ্মপুত্রকে নানাভাবে বেঁধে চিন সেই জল-রাজনীতির প্র্যাকটিক্যাল শুরু করেছিল। আর প্রতিবেশী দুটি দেশের পাঠশালায় আজও কি শিক্ষা দেওয়া হয় যাতে ভারত বিরোধিতা পরতে পরতে ঠিকরে পড়ে! একটা দেশকে ভেতর ও বাইরে থেকে বিব্রত করার অর্থ হল তার অস্তিত্বকে ক্রমান্বয়ে বিপন্ন করা। রবীন্দ্রনাথ এ দুটোই যুগপৎ দেখালেন ‘মুক্তধারা’-য়। মুক্তিযুদ্ধ করে সে আপদ দূর হয়নি।
( গত ২৭ জুলাই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর হাওড়া শাখার সভায় জল সম্পর্কে কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর ভাষণের অংশবিশেষ)