৭৫তম স্বাধীনতা দিবসকে স্বাগত জানাতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে ভারত। পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হয়েছে বেদী। যেখানে শহিদ বিপ্লবীদের স্মরণ ও ভারতের গৌরব উদযাপনে তেরঙা পতাকা উত্তোলন করা হবে। সেই রঙে রঙিন হবে দেশ। আলোকিত হবে ভাবনা। যে অপূর্ব সুন্দর পতাকাকে বিশ্বসেরা বলে মনে করেন ভারতবাসী, যা নিয়ে গর্বের শেষ নেই, তার বিবর্তন দেখে নেওয়া যাক।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিবেদিতার অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি করলেন বিখ্যাত “ভারত মাতা”চিত্রটি । রামানন্দ চট্যোপাধ্যায় ও নন্দলাল বসু তাঁর কাজে আগ্রহী ছিলেন ।নন্দলাল বসুকে নিজের খরচায় তিনি পাঠান অজন্তা য় । বিদেশী চিত্রকর ওকাকুর কাকুজার লিখিত বই এ তার অবদানের স্বীকৃতি আছে ।।রবীন্রনাথ তাঁকে উপাধি দিলেন “লোকমাতা”, স্বয়ং বিবেকানন্দ তাঁর মধ্যে দেখেছিলেন “সিংহিনী”। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত ও যদুনাথ সরকার তাঁর কর্মের ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন।
তিনি সুবক্তা , সুলেখিকা , সঙ্গীতজ্ঞা এবং চিত্রকর ছিলেন । তাঁর লেখা "কালী দী মাদার ", "ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ","ক্রেডল্ টেইলস্ অফ হিন্দুইজম্," "মাই মাস্টার অ্যাজ আই স হিম্", এই বইগুলি প্রমান করে তিনি ভারতের ভাবধারা কে কতখানি অন্তর থেকে গ্রহন করেছিলেন । তিনি একাধিকবার কালীঘাটে যেতেন এবং তাঁর লেখা কালী দী মাদার তখন স্বদেশপ্রেমি দের বীজমন্ত্রের কাজ করতো ।শ্রী অরবিন্দ ও এই বইএর দ্বারা বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনে তিনি বিপ্লবাগ্নির মতো জ্বলে উঠে সেই তেজরাশি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের মধ্যে ।
গুরুর মৃত্যুর তাঁর অসম্পূর্ণ কাজের ভার গ্রহণ করে শিব জ্ঞানে জীবসেবা , আপামর হিন্দু ও ভারতবাসীকে নিজের ভাই বলে আপনকরে নেওয়া , দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করাই ছিল তাঁর ব্রত । গুরুর মত ই শরীর চর্চা ও খেলাধূলাকে তিনি প্রধান্য দিতেন এবং দেশের যুব সম্প্রদায়কে নিজের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় জাগিয়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ। অমৃতবাজার ও বিভিন্ন ইংরাজি পত্র পত্রিকায় তিনি লিখতেন তাঁর জ্বালাময়ী লেখা ।
তিনি প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকার নকশা অঙ্কন করেন । লাল রঙের পতাকায় সোনালী রেশমের বজ্র দিয়ে। লাল রঙ স্বাধীনতা ও হলুদ বা সোনালী রঙ বিজয়ের প্রতীক । ।স্বার্থশুন্য মানুষ ই বজ্র, সেই নিঃস্বার্থপরতার সন্ধান আমাদের করতে হবে যাতে দেব হস্তের বজ্র হয়ে উঠতে পারি - এই ছিল তাঁর ভাবনা । কারণ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের পর ভারত সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। তার আগে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন রাজ্যের শাসকরা নানা নকশা ও রঙের পতাকা ব্যবহার করতেন। ভারত পুরোপুরি পরাধীন হলে ব্রিটিশরা গোটা দেশের জন্য একটাই পতাকা তৈরি করেছিল। পাশ্চাত্যের হেরাল্ডিক আদর্শে নির্মিত স্টার অফ ইন্ডিয়া ছিল কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া সহ অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশের পতাকাগুলির মিশ্রনে তৈরি। নীল ও লাল এনসাইন পতাকার ঊর্ধ্ব-বাম কোয়াড্র্যান্টে থাকত ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ। দক্ষিণার্ধ্বের মধ্যভাগে রাজমুকুট-বেষ্টিত একটি স্টার অফ ইন্ডিয়া প্রতীক রাখা হত।
১৯০৬ সালের ৭ অগাস্ট কলকাতার পার্সিবাগান স্কোয়ারে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এক সভায় প্রথম ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেছিলেন বিপ্লবী শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু। যেটি কলকাতা পতাকা নামে পরিচিত হয়েছিল। পতাকাটি ওপর, মাঝখান ও নিচে যথাক্রমে কমলা, হলুদ ও সবুজ রঙে রঞ্জিত ছিল। কমলা ডোরায় আটটি অর্ধ-প্রস্ফুটিত পদ্ম এবং সবুজ রঙে সূর্য ও অর্ধচন্দ্র আঁকা হয়েছিল। মাঝের হলুদ রঙে দেবনাগরী হরফে লেখা হয়েছিল বন্দে মাতরম। ১৯০৭ সালের ২২ জুলাই জার্মানির স্টুটগার্টে ভিখাজি কামা, বীর সাভারকর ও শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মার উদ্যোগে অন্য একটি ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। যার ওপরে ছিল সবুজ রঙ (ইসলামের প্রতীক)। পতাকার মাঝখান ও নিচে যথাক্রমে গেরুয়া (হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের প্রতীক) ও লাল রঙে রঙিন করা হয়েছিল। সবুজ রঙের ওপর ব্রিটিশ ভারতের আটটি প্রদেশের প্রতীক হিসেবে আটটি পদ্মের সারি অঙ্কন করা হয়েছিল। মাঝে দেবনাগরী হরফে বন্দে মাতরম কথাটি লেখা হয়েছিল। নিচের অংশ অর্ধচন্দ্র ও সূর্য অঙ্কন করা হয়েছিল।
১৯১৭ সালে বাল গঙ্গাধর তিলক ও অ্যানি বেসান্তের হোমরুল আন্দোলন থেকে এক নতুন পতাকার জন্ম হয়েছিল। যাতে পাঁচটি লাল ও চারটি সবুজ আনুভূমিক ডোরা ছিল। উপরের বাঁদিকে আয়তাকার ইউনিয়ন পতাকা ছিল আন্দোলনের ডোমিনিয়ন মর্যাদা লাভের লক্ষ্যের প্রতীক। হিন্দুদের পবিত্র সপ্তর্ষি মণ্ডলের প্রতীকরূপে সাতটি সাদা তারা পতাকায় আঁকা হয়েছিল। এর এক বছর আগে অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনমের ভাটলাপেনামারু গ্রামের পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া জাতীয় পতাকার নতুন রূপদানের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি, উমর সোবানি ও এস বি বোমানজির মিলে ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। ভেঙ্কাইয়া এই পতাকার জন্য অনুমোদন চাইতে গেলে মহাত্মা গান্ধী তাতে চরকার ছবি যোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। হস্তচালিত ওই চরকা ছিল ভারতের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক। ভেঙ্কাইয়া লাল ও সবুজ প্রেক্ষাপটে চরকার ছবি সম্বলিত পতাকাটি প্রস্তুত করেছিলেন। তাতে দেশের সকল ধর্মের প্রতিফলন ঘটেনি বলে মনে করেছিলেন মহাত্মা। এরপর নতুন তৈরি করা ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার ওপরে সাদা (সংখ্যালঘু সম্প্রদায়), মাঝে সবুজ (মুসলিম) ও নিচে ছিল নীল রঙ (হিন্দু)। পতাকার তিনটি ধাপ জুড়ে খচিত ছিল চরকার ছবি। যেটি আয়ারল্যান্ডের জাতীয় পতাকার সমরূপ ছিল। জাতীয় কংগ্রসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে পতাকাটি উত্তোলন করা হয়েছিল।
ভারতের পতাকা ধর্মের রঙে রঙিন করার বিপক্ষে সরব হয়েছিল দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। তার জেরে ১৯৩১ সালের করাচি কংগ্রেস অধিবেশনে পতাকা সংক্রান্ত শেষ প্রস্তাবটি পাস করা হয়েছিল। পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার অঙ্কিত নতুন একটি ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা গৃহীত হয়েছিল। এই পতাকার ওপর থেকে নিচে গেরুয়া, সাদা ও সবুজ রঙে রঙিন করা হয়েছিল। সাদা রঙে আঁকা হয়েছিল চরকা। গেরুয়া ত্যাগ, সাদা সত্য-শান্তি এবং সবুজকে বিশ্বাস-প্রগতির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ২৩ জুন ভারতের জাতীয় পতাকার বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য গণপরিষদ স্থাপিত হয়েছিল। রাজেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বে গঠন করা ওই কমিটিতে ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সরোজিনী নাইডু, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, কেএম মুন্সি ও বিআর আম্বেদকর। ১৯৪৭ সালের ১৪ জুলাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাটি উপযুক্ত সংস্কারের পর সব দল ও সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণীয় করে তুলে সর্বোতভাবে গৃহীত হবে। চরকার পরিবর্তে পতাকায় সারনাথ স্তম্ভ থেকে ধর্মচক্রটিকে গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীন ভারতে প্রথমবার এই পতাকাটি উত্তোলিত হয়েছিল।