পুরুলিয়া জেলার পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে নিতুড়িয়া থানার অন্তর্গত গোবাগ গ্রামের কাছে এই গড়পঞ্চকোট জায়গাটি অবস্থিত। বর্তমানে, যা পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রাচীন অযাচিত ইতিহাসের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে এই স্থানটি।
খুঁজে পাওয়া গড়পঞ্চকোট দুর্গের ভগ্ন ইতিহাস-
পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত রহস্যাবৃত ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গটি গড়পঞ্চকোট দুর্গ নামে পরিচিত। গড় শব্দের অর্থ দুর্গ, পঞ্চ মানে পাঁচ আর কোট কথাটি এসেছে গোষ্ঠী থেকে। শোনা যায়, রাজা দামোদর শেখর ৯০ খ্রিস্টাব্দে পুরুলিয়া জেলার ঝালদা অঞ্চলের ৫ জন আদিবাসী সর্দারের সাহায্য নিয়ে এই স্থানে তাঁর রাজত্ব গড়ে তোলেন এবং সেই থেকেই এই জায়গাটির নাম হয় গড়পঞ্চকোট। পরবর্তীতে রাজবংশের উত্তরসূরিরা পঞ্চকোটে ছোট-বড় মোট ৪০ টি পাথর এবং পোড়ামাটির মন্দির তৈরি করেন। কারও কারও মতে, এই মন্দিরগুলি রাজার নন বরং ধনী বণিকেরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। অনুমান করা হয়, প্রায় পাঁচ মাইল বিস্তৃত এই দুর্গটির ১২ বর্গ মাইল বিস্তৃত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। দুর্গের পিছনে ছিল পঞ্চকোট পাহাড় আর বাকি তিন দিক গভীর পরিখা দ্বারা আবৃত ছিল। মূল দুর্গ ঘেরা ছিল পাথরের দেওয়াল দ্বারা। তাই এই গড়পঞ্চকোট দুর্গটি বেশ সুরক্ষিত বলে মনে করা হত।
তবে এই সমস্ত এখন ইতিহাস! স্থাপত্য প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবলুপ্তির পথে। পড়ে রয়েছে হাতে গোনা দুই-একটি ভগ্নপ্রায় মন্দির। আর সেই রাজ দুর্গ, তার অবস্থা তো আরও খারাপ। কিন্তু কী এমন ঘটনা ঘটেছিল, যার জন্য আজ পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোটের অবস্থা এইরূপ হয়ে উঠল?
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে জানা যায় ১৭৪০ সালে সরফরাজ খাঁ কে হত্যা করে আলিবর্দি খাঁ বাংলার সিংহাসনে বসেন। সেই সময় বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বর্গী ভাস্কর পণ্ডিত লুটপাট চালানো শুরু করেন। আলিবর্দি খাঁ কে প্রতিহত করার জন্য ওড়িশার নায়েব নাজিম রুস্তম জং ব্যবস্থা নিতে শুরু করলে, তা জানতে পেরে আলিবর্দি খাঁ তাঁকে উড়িষ্যা থেকে বিতাড়িত করেন। রুস্তম সং নাগপুরের মারাঠা শাসক রঘুজী ভোঁসলের সাহায্যে আলিবর্দি খাঁ কে পুনরায় প্রতিহত করতে সমর্থ হন। এইসময় রঘুজি একদল মারাঠা অশ্বারোহীকে বাংলায় পাঠিয়ে ভয়ানক হত্যাকার্য এবং লুটপাট শুরু করেন। এই মারাঠা অশ্বারোহীরা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে এবং তারপর ১০ বছর ধরে তারা সেখানে নৃশংস হত্যাকার্য এবং ধ্বংসলীলা চালায়। এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় বর্গী আক্রমণ নামে পরিচিত হয়। এই বর্গী আক্রমণের ফলে বাংলা প্রায় ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ১৭৫১ সালে আলিবর্দি খাঁ-এর সঙ্গে মারাঠাদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তখন বাংলায় বর্গী আক্রমণের অবসান হয়। বাংলায় প্রবেশের সময় এই বর্গীরা পঞ্চকোটে তাদের অত্যাচারে ছাপ রেখে আসে। গড়পঞ্চকোট প্রাসাদে ঢুকে প্রহরী এবং প্রাসাদ রক্ষীদের হত্যা করে লুটপাট চালায়। এখানকার সমস্ত স্থাপত্য ভাস্কর্যকে বিনাশ করে দিতে উদ্যত হয় এবং তাই দেখে তখনকার রাজা তাঁর ১৭ জন রানিকে নিয়ে আত্মসম্মান বাঁচাতে কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আর এইভাবে গড়পঞ্চকোট অবহেলিত ধ্বংসপ্রাপ্ত মৃত ভগ্নপ্রায় অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রায় বারো হাজার বর্গফুট অঞ্চল জুড়ে পড়ে থাকায় ধ্বংসস্তূপ প্রমাণ করে দেয় প্রাসাদের সুবিশাল বিস্তৃতি।
2022-05-19