প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আগামী ২০১৪ সালের মধ্যে দেশের সমস্ত বাড়িতে নলবাহিত জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ও রূপায়ণের রূপরেখা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে নতুন জল শক্তি মন্ত্রণালয় নামে আলাদা একটি মন্ত্রকও খোলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাম্প্রতিকতম ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে দেশবাসীকে জল সংরক্ষণের উপযোগিতা ও অতীতে জলসংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে সকলের ধ্যানধারণা ও জ্ঞান নিয়ে পারস্পরিক বিনিময়ের অনুরোধও করেছেন। দেশের ২৫৫টি জলাভাব আক্রান্ত জেলাতে জলশক্তি প্রকল্পের অধীনে জল সংরক্ষণ বাড়াতে নির্দিষ্ট প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
জলই ভারতের উচ্চহারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা নিতে চলেছে। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জনজীবনের সার্বিক মানোন্নয়নের ক্ষেত্রেও জল সংরক্ষণের বড়ো ভূমিকা থাকে। পৃথিবীর মোট লোকসংখ্যার ১৭ শতাংশ ভারতে বসবাস করে কিন্তু বিশ্বের মোট জল সম্পদের মাত্র ৪ শতাংশ ভারতে রয়েছে। আজকের দিনে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের পানীয় জলের নিজস্ব কোনো উৎস নেই। আবার গ্রামের দিকে শতকরা ৯০ শতাংশ পরিবারে পাইপে করে জল আসা কেউ চাক্ষুষ করেনি।
সারা বিশ্বে ভারত কিন্তু বর্তমানে ভূগর্ভস্থ জলের একাই ২৫ শতাংশ উত্তোলন করে থাকে। বিশ্বের ২০টি জল সংকটে পড়া বৃহত্তম শহরের মধ্যে ৫টি ভারতে অবস্থিত। বিশাল সম্মান নিয়ে এই সংকট- শীর্ষে আমাদের মধ্যে দিল্লি দ্বিতীয়। দিল্লিতে ২০ মিলিয়ন (২ কোটি) স্থানে মাটির নীচে থেকে জল উত্তোলিত হয়। এর জন্য ইলেকট্রিক পাম্পের খরচ সরকার বহন করে থাকে।
ধান ও আম এই দুটি চাষের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত বেশি সেচের জলের প্রয়োজন হলেও জলাভাব পীড়িত কয়েকটি রাজ্যে এর বড়ো বড়ো চাষ হয়ে থাকে। হেক্টর প্রতি এখানে জলের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। পঞ্জাবে এক কিলো চাল উৎপাদনে বিহারের চেয়ে তিনগুণ আর পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে দু’গুণ বেশি জল খরচ হয়। পঞ্জাবের সেচের জলের ৮০ শতাংশই ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার থেকে নেওয়া হয়। আমরা জানিই না বাসমতী চাল রপ্তানি করার মাধ্যমে বাস্তবে বছরে আমরা ১০ ট্রিলিয়ন জলসম্পদ চিরতরে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাহলে, ভারতের মুখোমুখি হওয়া এই বিরাট চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা দেশ কীভাবে করবে?
প্রথমত, আমাদের যে সমস্ত জলাশয় ও জল ধরে রাখা যায় এমন স্থানগুলি আছে বা কিছুটা পরিত্যক্ত হয়েছে সেগুলির পুনরুদ্ধার। যা আছে তার পূর্ণ সংরক্ষণ ও যেখানে জল ধারণ ক্ষমতা বাড়াবার সুযোগ আছে তার সদ্ব্যবহার। প্রত্যেকটি পঞ্চায়েতের অধীনে নদী, পুকুর, বড়ো নালা, সরোবর ও পাতকুয়ো অবশ্যই আছে। উদাহরণ হিসেবে তেলেঙ্গানার ‘মিশন কাকতেয়’র অধীনে ৪৬ হাজার জলাশয় পুনরুদ্ধার হয়েছে। ধন ফাউন্ডেশনের অধীনে কাজ করা ভায়লাগাম ট্যাঙ্কফেড এগ্রিকালচারাল উন্নয়ন পর্ষদের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে ভূগর্ভস্থ জল না তুলে এই সংগৃহীত জলের মাধ্যমে চাষ সফল হয়েছে। জলাশয়গুলির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণও চলছে। এই উদাহরণ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া একান্ত দরকার।
দ্বিতীয়ত, কৃষিক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এখন একান্ত প্রয়োজনীয়। প্রযুক্তির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে আগাম কৃষকদের ওয়াকিবহাল করে দেওয়া যে নির্দিষ্ট এলাকায় জল ভাণ্ডার কতটা আছে আর সেই অনুসারে তাদের সংরক্ষণের জন্য কী ব্যবস্থা। নিতে হবে। অন্ধ্রপ্রদেশ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তার জল সম্পদে বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলস্তর বাস্তবে বেড়েছে। এই সূত্রে প্রযুক্তিবিদদের মত নিয়ে। গুজরাট সরকার চাষের জল দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সংবাহনে সম্পূর্ণ আলাদা feeder changing পদ্ধতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও জল উভয়ের খরচেই রাশ টানতে পেরেছে।
তৃতীয়ত, সমবায় ভিত্তিতে জলের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুষ্ঠ পরিচালনা (বড়ো বড়ো বহুতলের ক্ষেত্রে) জল ব্যবহারকারীদের অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করে নিয়মিতভাবে নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করে অনেক সাশ্রয় করা যায়। মহারাষ্ট্রের হিওয়ারে বাজার গ্রামে গ্রামবাসীরা নিজেরা জলের সুষ্ঠু বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে এসে গভীর নলকূপ খনন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। এঁরা নিজেদের মধ্যে জল বিভাজনের নিজস্ব বাজেট তৈরি করেছে। তারা তুলো ও আমের মতো বিপুল জলভোগী কৃষিপণ্যের চাষই বন্ধ করে দিয়েছে। এই গ্রামটির উদ্ভাবনী সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার ৫০০০ গ্রামে জলের অপচয় রুখতে জলকষ্টের গ্রামগুলিতে বাজেট তৈরিতে উৎসাহ দিয়ে সুফল পেয়েছে।
চতুর্থত, ভারতকে চাষের ক্ষেত্রে জল। ব্যবহারের দক্ষতায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সারা বিশ্বে দক্ষতার নিরিখে ভারত নিম্নতমদের মধ্যে রয়েছে। একই শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে চীন, ইজরায়েল বা আমেরিকার চাষিদের থেকে ভারতের চাষিরা তিন থেকে ৫ গুণ বেশি জল ব্যবহার করে থাকে। বিশ্বে চালু হওয়া agro climatic Zoning-এর উপদেশ অনুযায়ী চাষিদের নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট পণ্যেরই চাষ করলে সুফল পাওয়া যাবে। দুর্ভিক্ষপ্রবণ বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে মেথির চাষ হয় যেখানে ১৮ থেকে ২০ বার জল দিতে হয়। এক্ষেত্রে ভারতের চাষিদের প্রশিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজন আছে। চাষিরা যাতে জল কম ব্যবহার হয়। এমন শস্যের চাষ বাড়ায় এবং সেই ধরনের শস্যের ক্ষেত্রে ভরতুকি ও ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য (এম এস পি) বাড়িয়ে তাদের উৎসাহিত করা দরকার। এই সূত্রে মিলেট অর্থাৎ জোয়ার, বাজরা, রাগি এবং ডালের মধ্যে কলাই, অড়হর, ছোলা বা মুগের চাষ বাড়ানো দরকার। প্রথমত এগুলিতে প্রোটিনের মাত্রা বেশি থাকায় ‘মিড ডে মিল-এর এবং আই সি ডি এস প্রকল্পের ক্ষেত্রেও বেশি ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে শিশুদের পুষ্টি বাড়ে। সব চেয়ে বড়ো কথা, এগুলি জল সাশ্রয়কারী উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ কৃষি পণ্য।
পঞ্চমত, ভারতের ভূগর্ভস্থ জল সংকোচন সমস্যার একটা বড়ো কারণ দেশের প্রচলিত আইন। বর্তমানে যিনি জমির মালিক তার জমির ওপর পূর্ণ মালিকানা থাকার সঙ্গে সঙ্গে মহারাষ্ট্রের ভূমিজ জল উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপন সংস্থা রাজ্যে কূপ খননের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নতুন কূপ খননের অনুমোদন তখনই দেওয়া হয় যখন একই জায়গায় ভূমি থেকে উত্তেলিত জলের পুনরায় চক্রাকারে ভূমিতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়।
ষষ্ঠত, জল ব্যবহারকারীদের থেকে জল বাবদ মূল্য নেওয়ার একটি যুক্তিসঙ্গত ও সময়পোযোগী নীতি দরকার। এটা বলা যায় যে সময়মতো, সহজে পর্যাপ্ত জল পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে অনেকেই জল বাবদ অর্থ দিতে উৎসুক। কিন্তু ভয়ানক রাজনৈতিক অনিচ্ছা ও প্রশাসনিক উদাসীনতা এর। অন্তরায়। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। জলের মূল্য ধার্য করলে জলজনিত পরিকাঠামো নির্মাণ ক্ষেত্রে বড়ো বিনিয়োগ আনতে পারে।
সপ্তমত, সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে যে চমৎকার ঘটে গেছে সেটি অনুসরণযোগ্য। প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়ার ওপর বরাবরের নির্ভরতা ঝেড়ে ফেলে সিঙ্গাপুর ব্যবহৃত জলের পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা ফেরানো, বৃষ্টির জল নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ, জল যাওয়া ও নিষ্কাশনের সমান্তরাল পাইপ বসানো, জল সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, জলের পরিস্থিতি অনুযায়ী মূল্য হার নির্ধারণ, জল চেতনার জাগরণ ও নিরন্তর এই সংক্রান্ত গবেষণার মাধ্যমে তারা জলাভাব চিরকালের জন্য মিটিয়ে ফেলেছে।
একটা ভালো খবর যে বাস্তবে তৃণমূল স্তরে সদর্থক কিছু কিছু জিনিস ঘটতে দেখা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যগুলি যথাযোগ্য গুরুত্ব অনুসারে জলসংরক্ষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প গুলির রস পায়ণে আন্তরিকতা দেখাচ্ছে। জলের পুনর্ব্যবহার যোগ্যতার প্রকল্পগুলিও হাতে নেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রে জলযুক্ত সিভার, তেলেঙ্গানার মিশন কাকতেয়, রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী জল স্বাবলম্বন অভিযান, গুজরাটে ‘সুজলাং সুফলাং প্রকল্পগুলি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। মহারাষ্ট্রের প্রকল্পটি চাষের সময়ে ক্ষেত্রের জলের যে ব্যবস্থা করেছে তাতে ১১ হাজার গ্রাম খরার কবলমুক্ত হয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলস্তরেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। জব্বলপুর, ইন্দোর ও গোয়ালিয়রে যদি বৃষ্টির জল সংরক্ষণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা থাকে সেক্ষেত্রে সম্পত্তি করে বাড়তি ছাড়া দেওয়া হচ্ছে। তেলেঙ্গানায় ১৭ হাজার ছোটো ছোটো ডোবাকে সেচের জলাধারে পরিণত করে প্রায় ১৯ লক্ষ একর কৃষি জমিতে সঞ্চিত বৃষ্টির জল সরবরাহ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নীতি আয়োগ জল সংরক্ষণের ২৮টি নির্দিষ্ট মানদণ্ড ঠিক করে বিভিন্ন রাজ্যগুলির পারস্পরিক অবস্থান যাচাইয়ের ব্যবস্থা করেছে।
আমরা একটি জলসঙ্কটহীন ভারত গড়তে চাই। আমাদের নিজস্ব জল সম্পদের সুষ্ঠু ও দক্ষ ব্যবহারই ঠিক করে দেবে ভারতের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ।
অমিতাভ কান্ত
2019-07-12