স্বদেশী বিপ্লবী থেকে আধ্যাত্মিক যোগী – সবেতেই মুক্তির দিশারী ছিলেন অরবিন্দ  

Story image

অরবিন্দ ঘোষকে তাঁর বাবা পুরোপুরি ব্রিটিশ সাহেব বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি হলেন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী, চিরন্তন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার সাধক। অরবিন্দ ঘোষের জীবন এমনই বর্ণময়।

বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন বিলেতফেরত ডাক্তার। মা স্বর্ণলতা দেবী কলকাতার প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। অরবিন্দ এবং তাঁর দুই দাদাকে কৃষ্ণধন ভর্তি করে দেন দার্জিলিং-এর লরেটো কনভেন্ট স্কুলে। ১৮৭৯ সালে তাঁদের পাঠানো হয় ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার শহরে। ড্রিউইট পরিবারের সঙ্গে থেকে তাঁরা পাশ্চাত্য শিল্প-সংস্কৃতি আত্মস্থ করতে থাকেন। ১৮৮৪ সালে অরবিন্দ ভর্তি হন লন্ডনের সেন্ট পলস স্কুলে। তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কিংস কলেজের বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন। আইসিএস-এর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসনের সেবাদাস হয়ে থাকতে আগ্রহী ছিলেন না তিনি। ইতিমধ্যেই স্বদেশী চিন্তাধারা জন্ম নিয়েছিল তাঁর মনে। তাঁর বাবাও ভারতীয়দের প্রতি অত্যাচারের কথা ছেলের কাছে তুলে ধরতেন। অরবিন্দ আইসিএস পরীক্ষার অংশ অশ্বারোহণ প্রতিযোগিতায় হাজির হননি। এরই মধ্যে ইংল্যান্ডে তিনি এক ব্রিটিশ বিরোধী গুপ্তসমিতি তৈরি করেছিলেন।

তখন বরোদার মহারাজ তৃতীয় সায়াজিরাও গায়কোয়াড় ছিলেন লন্ডনে। তাঁর সঙ্গে দেখা করে বরোদার স্টেট সার্ভিসে নিযুক্ত হন অরবিন্দ। রওনা দেন ভারতে। তাঁর বাবা ভুল খবর পেয়েছিলেন যে পর্তুগালের উপকূলে অরবিন্দের জাহাজডুবি হয়েছে, এই শোক সহ্য করতে না পেরে কৃষ্ণধন মৃত্যবরণ করেন। যদিও অরবিন্দের জাহাজ নির্বিঘ্নেই ভারতে পৌঁছয়। বরোদায় সার্ভিস অ্যান্ড সেটলমেন্ট বিভাগে কাজ শুরু করেন। পরে কোষাগারের কাজ করেছেন।  বরদা কলেজে অধ্যাপক ও পরবর্তীকালে উপাধ্যক্ষের দায়িত্বেও নিয়োজিত হন। এই সময়ে তিনি ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম নিয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা করতে থাকেন। ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বাংলায় পাঠান। 

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল গোটা দেশ। অরবিন্দ বরোদা ছেড়ে বাংলা চলে এলেন। দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত করতে জাতীয় কংগ্রেসের নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে লাগলেন। কংগ্রেসের নরমপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। কলকাতার জাতীয় কলেজ অর্থাৎ এখনকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ হলেন তিনি। তারই সঙ্গে চলতে থাকে ব্রিটিশ বিরোধী সংবাদপত্রে লেখালিখি, সম্পাদনা। 

অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ১৯০৮ সালে মুজফফরপুর গিয়েছিলেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকি। কিন্তু ভুলবশত তাঁদের বোমায় দুই ব্রিটিশ মহিলা নিহত হন। এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে অরবিন্দকেও গ্রেফতার করে সরকার। মামলায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁদের আইনি সাযায্য করেছিলেন। অরবিন্দ-সহ কয়েকজন শেষপর্যন্ত ১৯০৯ সালে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়ে মুক্তি পান।

কারাগারে থাকাকালীনই অরবিন্দের মনে আধ্যাত্মিক চিন্তার পরিস্ফূরণ হতে থাকে। জেল থেকে বেরিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। কয়েকদিন চন্দননগরে থাকার পর চলে যান পন্ডিচেরি। পরম মুক্তির খোঁজে যোগ সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। পরিণত হন ‘ঋষি অরবিন্দ’-তে। যদিও তিনি সারা ভারতের রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। প্রয়োজনে মতামত দিতেন। বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। দার্শনিক ভাবনার ইতিহাসে তাঁর ‘অতিমানস’-এর তত্ত্ব বিশেষ অবদান রাখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.