১৯০৭ সালের শেষের দিকে সারা দেশে শুরু হয় ব্রিটিশ শাসক আর সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংঘর্ষ, ধরপাকড় আর নির্যাতন। স্বাধীনতাকামী বিপ্লববাদী দলগুলোকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে নিয়ে যেয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রুজু করে তাঁদের উপর চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। তাঁদেরকে আন্দামান, আলীপুরসহ বিভিন্ন জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে পাঠানো হয়।সুশীল সেন নামে ১৩ বছরের এক ছেলে ঘুসি মেরে পুলিশ সার্জেন্টের নাক ফাটিয়ে দেয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। বিচারক কিংসফোর্ড বিচারের পর তাঁকে ১৫টি বেত্রাঘাত মারার হুকুম দিলেন। রক্তাক্ত হলেন সুশীল সেন। দুঃসহ যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। খবরটি দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে । সকল তরুণ বিপ্লবী এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজকে বিতাড়িত করার সংকল্প করেন। বিপ্লববাদী দলের সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত, বারীন ঘোষ ও অরবিন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন কিংসফোর্ডকে হত্যা করার। মিটিংয়ে প্রশ্ন উঠল একাজের দায়িত্ব কাকে দেয়া হবে? আড়াল থেকে মিটিংয়ের কথা শুনে প্রফুল্ল চাকী বললেন, “আমি প্রস্তুত। বলুন কি করতে হবে আমাকে।” কিন্তু সবাই ভাবলেন একাজের জন্য আরো একজন দরকার। ভেবেচিন্তে ক্ষুদিরাম বসুর নাম ঠিক হলো।
ক্ষুদিরামের অভিভাবক সত্যেন বসুর কাছে চিঠি লিখে পাঠানো হলো। চিঠি অনুযায়ী ১৯০৮ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষুদিরাম কলকাতায় এসে পৌঁছলেন। কলকাতায় গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়িটি ছিলো বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বসেই হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর শক্তিশালী ‘book bomb’ তৈরী করলেন। এ বোমা বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত। বেশ কৌশলে একটি বই কিংসফোর্টের কাছে পাঠানো হলো। কিন্তু কিংসফোর্ড বই না খোলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন।
শুরু হলো আবার নতুন প্রস্তুতি। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম কলকাতা রেলস্টেশনে পৌঁছার পর বারীণ ঘোষ তাঁদের কাছে কিংসফোর্টকে মারার জন্য বোমা পৌঁছে দিলেন। বোমার সঙ্গে রিভলবার কেনার জন্য কিছু টাকা ও মজঃফরপুরে যাওয়ার মানচিত্র দেয়া হলো তাঁদেরকে। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম প্রথমবারের মতো একত্রিত হলেন রেলস্টেশনে। এর আগে কেউ কাউকে চিনতেন না। দুজনের মধ্যে কথা হলো। কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প করলেন তাঁরা। এরপর সতর্কতার সাথে চলে যান মজঃফরপুরে। কারণ এখানেই বাস করেন কিংসফোর্ড। প্রতিদিন ক্লাব হাউজ থেকে সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িতে করে নিয়মিত বাড়ি ফিরে আসেন কিংসফোর্ড। পাঁচ দিন অতিবাহিত হলো, কিন্তু তাঁকে হত্যা করার উপযুক্ত সুযোগ পেলেন না । ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল, ষষ্ঠ দিন এলো সেই সুযোগ। ক্লাব হাউজ থেকে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত যে পথ, সেই পথের মাঝখানে ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা একটি জায়গায় ওঁত পেতে ছিলেন তাঁরা। সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িটি তাঁদের কাছে পৌঁছামাত্র গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ওই গাড়িতে সেদিন কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন দু’জন বিদেশী। বিদেশী দু’জন মারা গেলেন। অতিদ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করলেন তাঁরা।
এই ঘটনার ১ ঘন্টা পর পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরদর্শন করেন। সকল রেল ষ্টেশনে খবর পৌঁছে গেলো। আততায়ীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হল।
ক্ষুদিরাম অনেক সতর্কতার সাথে মজঃফরপুর থেকে ২৪ মাইল পথ পায়ে হেঁটে ওয়ালি ষ্টেশনে পৌঁছেন। প্রচন্ড তৃষ্ণা মেটাতে একটি দোকানে যান তিনি। আততায়ীকে ধরার জন্য পুলিশ সমস্ত শহরে ওঁত পেতে ছিল। সাদা পোশাকের পুলিশ ওই ওয়ালি ষ্টেশনেও ছিল। তারা ক্ষুদিরামকে সন্দেহ করে এবং ঠিক জল পানের সময়ই ২ জন পুলিশ ক্ষুদিরামের দুই হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। সাথে সাথে আরো ৫/৬ জন পুলিশ ক্ষুদিরামকে ঘিরে ফেলে। ক্ষুদিরামও দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আত্মাহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র মুক্ত করে নেয়ায় তিনি আত্মাহুতি দিতে পারেননি । ক্ষুদিরাম বোমা হামলার সব দায় নিজের কাঁধে নেন। সহযোগীদের কথা বলেন না। ফলে বোমা হামলা ও দুজনকে হত্যার অপরাধে ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ হয়।অন্যদিকে প্রফুল্ল চাকী অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ছদ্মবেশে ট্রেনে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হন। মজঃফরপুর থেকে চারটে স্টেশন দূরে, সমস্তিপুরে গিয়ে পৌঁছলেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতেই। সেখানে, আশ্রয় নিলেন ত্রিগুণাচরণ ঘোষের বাড়িতে। রাতে ত্রিগুণাবাবুই প্রফুল্ল’কে তুলে দিলেন মোকামাঘাট গামী ট্রেনে।সেই ট্রেনে ছিলেন মজঃফরপুরের আরও এক প্রবাসী বাঙালি। নাম নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর। আগেই শুনেছিলেন মজঃফরপুরে দুই বাঙালির বোমা নিয়ে হামলার কথা। প্রফুল্ল’র সঙ্গে কথাবার্তায় তাঁর সন্দেহ হয়। তিনি তাঁর মাতামহের মাধ্যমে পুলিশের কাছে আর্জি জানান, সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করার জন্য। পরের দিন অর্থাৎ ২ মে সকালে মোকামা ঘাট স্টেশনে গ্রেপ্তারের অনুমতি মেলে।এর আগেই নন্দলালের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে প্রফুল্ল চলে গিয়েছিলেন ট্রেনের অন্য কামরায়। মোকামাঘাট স্টেশনে নেমে, নন্দলাল প্রফুল্ল’র কাছে আগের রাতের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চান এবং তাঁর মালপত্র একটু দেখে রাখতে বলেন। প্রফুল্ল সরল মনে দাঁড়িয়ে থাকেন। স্টেশন মাস্টারের ঘর থেকে দুজন সাক্ষী জোগাড় করে এনে, নন্দলাল প্রফুল্লকে বলেন ‘তোমার প্রতি আমার সন্দেহ হচ্ছে, তাই আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করব।’ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান প্রফুল্ল। এক বাঙালি তাঁকে গ্রেপ্তার করবে, তা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। প্রশ্ন করেন – ‘তুমি বাঙালি হয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করছ!’
বাকিটা শোনা যাক নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়ানেই। আলিপুর আদালতে ক্ষুদিরাম বসু’র মামলা চলাকালীন, প্রফুল্ল সম্পর্কে এই সাক্ষ্য দিয়েছিলেন নন্দলাল –
‘যুবকটি লাফ দিয়ে বিশ্রামকক্ষের দিকে ছুটল। আমি ও চতুর্বেদিও তার দিকে ছুটলাম। চিৎকার করছিলাম। চিৎকার শুনে রেলপুলিশ দৌড়ে এসেছিল। আমাকে বলা হল – যুবকটিকে ধরতে গেলে সে নাকি রিভলভার থেকে কনস্টেবলদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। কিন্তু যুবকটিকে জাপটে ধরতেই সে নিজের রিভলভারের গুলিতে আত্মহত্যা করে।’হ্যাঁ, পুলিশের হাতে ধরা দিতে চাননি প্রফুল্ল। নিজের দিকে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে, দু’বার গুলি ছোঁড়েন তিনি। একটি গুলি তাঁর বুক ভেদ করে যায়, অন্যটি মাথার খুলি। মোকামাঘাট স্টেশনে লুটিয়ে পড়েন প্রফুল্ল।প্রফুল্ল’র মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় মজঃফরপুর স্টেশনে। সেখানে তাঁকে শনাক্ত করেন ক্ষুদিরাম। এরপরও থামেনি ইংরেজদের ‘ভৃত্য’ পুলিশের নির্যাতন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, সেই নির্মমতা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। শনাক্তকরণের জন্য প্রফুল্ল’র মাথা কেটে নেওয়া হয়। ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেই মাথা একটা কেরোসিনের টিনে ভরে, স্পিরিটে চুবিয়ে পাঠানো হয় কলকাতায়, গোয়েন্দা দপ্তরে। সেখানে শনাক্ত হওয়ার পর, মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয় তাঁর মাথাটি।আর বাকি দেহ? ডোমের হাত দিয়ে সেই দেহ ফেলে আসা হয় শ্মশানে। বেওয়ারিশ হিসেবে। শিয়াল-কুকুরের মুখে।এই নির্মমতার পরে, বিপ্লবীরা অবশ্য চুপ থাকেননি। কয়েকমাস পরেই, ৯ নভেম্বর রাত্রে হত্যা করা হয় নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
প্রসঙ্গত, প্রফুল্ল’ই হলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ। ক্ষুদিরামকে যখন মজঃফরপুরে নিয়ে আসা হয় শনাক্তকরণের জন্য, প্রফুল্ল’কে দেখে তাঁর মনের কী অবস্থা হয়েছিল, তা লিখে গেছেন প্রফুল্ল’র ভ্রাতুষ্পুত্র হেমন্ত চাকী। তিনি লিখছেন – “পরলোকগত বন্ধুর মুখে তাঁহার চরিত্রের তেজঃপূর্ণ পুণ্যজ্যোতি মৃত্যুদ্বারাও কিছুমাত্র বিকৃত হয় নাই দেখিয়া ক্ষুদিরাম অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন। মৃতদেহের শিয়রে দাঁড়াইয়া বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন, ‘তুমি যেমন তোমার ব্রত পালন করিয়া সুখী হইয়াছ, আমিও যেন সেইরূপ আমার জীবনব্রত সাধন করিতে সমর্থ হই।’ এই প্রথম জানা গেল যে তাঁহার সহিত প্রফুল্লর কতটা অন্তরের যোগ হইয়াছিল এবং ইহারও জীবনের ইতিহাস কেমন আশ্চর্য ইতিহাস ছিল।” (তথ্যঋণ – অগ্নিযুগের প্রথম শহীদ প্রফুল্ল চাকী – হেমন্ত চাকী, মূল নথি থেকে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী – চিন্ময় চৌধুরী)
প্রফুল্লর শরীরে যে-দু’টি গুলির ক্ষতস্থান দেখা যাচ্ছে, ফরেনসিক ও বিভিন্ন সমীক্ষার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে খুবই বিরল ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে। কেননা, তিনি ডান-হাতি ছিলেন এবং ওই দু’টি স্থানে অর্থাত্ শরীরের বাঁ দিকে পিস্তলে নল ঘুরিয়ে নিজে-নিজে একটি নয় দু’টি গুলি করা রীতিমতো অসুবিধাজনক শুধু নয়, তা প্রায় অসম্ভবই (not within easy access)। এ ছাড়া গুলির ক্ষতের আকৃতি এবং ব্যাস দেখে মনে হয় না এগুলি near contact অথবা contact shot-এর কারণে ঘটেছে, যা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সব সময় হয়ে থাকে। কালো রঙের ছাপও সেখানে অনুপস্থিত।
ব্রিটিশ পুলিশের রেকর্ডের বয়ান অনুযায়ী, প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছিলেন এই নিশ্চিত-মত এ যাবত্ সকলেই পোষণ করেছেন। অথচ, যে-যে যুক্তিগুলি তাঁর আত্মহত্যার তত্ত্বকে সমর্থন করছে না সেগুলি সংক্ষেপে এইরকম–
১। সুদেহী প্রফুল্লর সঙ্গে গুলিভরা পিস্তল থাকতে বিনা বাধায় তিনি আত্মসমর্পণ করে স্বহননে প্রবৃত্ত হবেন এমন দুর্বল চিত্তের মানুষ তিনি ছিলেন না। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি পুলিশের উদ্দেশে গুলি ছুড়েছিলেন, তবে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। অথচ, অন্য তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি পিস্তল ছোড়ায় দক্ষ ছিলেন, গুলি ছোড়ার রীতিমতো অভ্যাস করতেন মুরারিপুকুর-বাগানবাড়িতে। তবে বিপদকালে উত্তেজনাবশে তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলেন, সেটাও হতে পারে!
২। তাঁর কাঁধে এক কনস্টেবল সজোরে লাঠির আঘাত করেছিল। শুধু একটিই? তা হলে নীচের ঠোঁটের গভীর ক্ষতের কারণ কী? কান-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুনোর অস্পষ্ট দাগ? এসব অত্যধিক দৈহিক পীড়নের ফল নয় কী?
৩। দু’টি গুলির ক্ষতের স্থান নির্দেশ করে একজন বাঁ-হাতির পক্ষেই এই স্থানে গুলি করে আত্মহত্যা করা সম্ভব। প্রফুল্ল স্বাভাবিক ডান-হাতি ছিলেন।
৪। vital organ-এ একাধিক গুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল, কেননা প্রথমটির পরে শারীরিক ক্ষমতা তেমন আর থাকে না।
৫। কোনও competent authority কেন, কোনও ডাক্তারের দেওয়া মৃত্যুর সার্টিফিকেটও নেই।
অতএব, প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছিলেন প্রচলিত এই ‘অতিসরল’ কথাটি মেনে নিতে প্রবল আপত্তি রয়েছে। বরং হত্যার লক্ষণগুলিই এখানে প্রকট। প্রফুল্ল মৃত্যুর ঘটনাটি সম্ভবত এই রকমভাবে ঘটেছিল বলে আমার অনুমান। মোকামা স্টেশনে প্রফুল্লকে বাগে পেয়ে কর্তব্যপালনে অবিচল পুলিশেরা সকলে মিলে লাঠি দিয়ে ও যথেচ্ছ দৈহিক পীড়নে তাঁকে কাবু করে এবং অর্ধচৈতন্য বা অচৈতন্য করে ফেলে। এর পর তাঁরই পিস্তল দিয়ে একটি ফাঁকা আওয়াজ এবং অবশেষে তাঁর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দু-দু’টি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। যদিও অনেকেই বলেছেন, পুলিশের উদ্দেশে প্রফুল্ল একটি গুলি করেছিলেন এবং তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এটা হয়ে থাকলে পুলিশ কোনওভাবে তাঁর হাত থেকে পিস্তলটি ছিনিয়ে নিয়ে সেটি দিয়েই তাঁকে হত্যা করে। প্রফুল্লর পিস্তলের ম্যাগাজিনে ৭টি কার্তুজ ভরার ব্যবস্থা ছিল এবং সম্ভবত প্রফুল্ল ৭টি কার্তুজ ভরেছিলেন। পিস্তলটি বাজেয়ান্ত করে দেখা যায়, সেখানে ৪টি কার্তুজ রয়েছে, অর্থাত্ ৩টি খরচ হয়েছিল। ছবিতে দু’টি গুলির ক্ষত শরীরে দেখা গেছে। তা হলে আর একটি গুলির লক্ষ্য জানা যাচ্ছে না, হতে পারে তা পুলিশের উদ্দেশেই, যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল, অথবা প্রফুল্লর শরীরের অন্য কোনও অংশে তা আছে, যা ছবিতে দেখা যাচ্ছে না। শুধু ফোটো নেওয়া ছাড়া (দু’টি ছবিরই শুধু সন্ধান মেলে) পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য-কর্তব্যের কোনওটিই পালিত হয়নি। এবং তাই আসল সত্য নিয়ে এই এত দিন পরেও ধোঁয়াশা রয়ে যায়।
জন্ম
প্রফুল্ল চাকী জন্মগ্রহণ করেন বগুড়া জেলার বিহার গ্রামে (বর্তমানে যা বাংলাদেশের অন্তর্গত)। তাঁর বাবার নাম রাজ নারায়ণ চাকী। তিনি বগুড়ার নবাব এস্টেটে কর্মরত ছিলেন। মাতা স্বর্ণময়ী চাকী। ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে প্রফুল্ল চাকী ছিলেন কনিষ্ঠ সন্তান। মাত্র ২ বছর বয়সে প্রফুল্ল চাকীর বাবা মারা যান।প্রফুল্ল চাকীর পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে, মায়ের কাছে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে বগুড়ার নামুজা জ্ঞানদা প্রসাদ ইংরেজী বিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। এই স্কুল থেকে তিনি মাইনর পাশ করেন। তারপর ১৯০২ সাল থেকে প্রায় ১৯০৫ সাল পর্যন্ত রংপুর জেলা স্কুলে পড়াশুনা করেন। এরপর ভর্তি হন রংপুর জাতীয় স্কুলে। রংপুর জাতীয় স্কুলে পড়ার সময় তিনি গুপ্ত সমিতির সভ্য হন।
১৯০৫ সালের ‘বঙ্গভঙ্গবিরোধী’ আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বদেশী আন্দোলন। যে আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করেন ছাত্ররা। বিশেষ করে স্কুলের কিশোররা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থনে সক্রিয় অহিংস সংগ্রাম যেমন পরিচালিত হয়, তেমনি সহিংস কর্মকাণ্ডভিত্তিক গোপন বিপ্লবী সংগঠনেরও জন্ম হতে থাকে।
১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন প্রফুল্ল চাকী। এ সময় প্রফুল্ল চাকী জিতেন্দ্রনারায়ণ রায়ের নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেন। এখানে তাঁর শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা এবং পিস্তল চালনার শিক্ষাও হয়। ওই সময় ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম শুরু হয়। বাংলার অসংখ্য তরুণ, যুবক এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে বৈপ্লবিক জীবন বেছে নেন। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের কারলিসল সার্কুলারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে প্রফুল্ল চাকীকে রংপুর জাতীয় স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি পুনরায় নবম শ্রেণীতে রংপুর ন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে পড়ার সময় জিতেন্দ্রনারায়ণ রায়, অবিনাশ চক্রবর্তী, ঈশানচন্দ্র চক্রবর্তীসহ অন্যান্য বিপ্লবীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। আর এসময় থেকে তিনি বিপ্লবী ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন। ১৯০৭ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময় প্রফুল্ল চাকী নবম শ্রেণীতে পড়তেন। ওই বছর বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ রংপুরে আসেন। রংপুরে পূর্বে যেসকল গুপ্ত সমিতি গঠিত হয়েছিল সেগুলোকে নিয়ে বারীন্দ্র কুমার ঘোষ নতুন আঙ্গিকে একটি বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি গঠন করেন। এর পূর্বে রংপুরে ঈশানচন্দ্র চক্রবর্তী ও তাঁর ছেলে প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সুরেশ চক্রবর্তী এবং প্রফুল্ল চাকীর চেষ্টায় একটি কুস্তির আখড়া গড়ে উঠে। এই আখড়ায় স্থানীয় ছাত্র- যুবকরা বিপ্লবাত্মক কাজে দীক্ষা নেন। তৎকালীন সময়ে বিপ্লবীদের মানসিক শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র্রের আনন্দমঠ, দেবীচৌধুরাণী উপন্যাস, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী এবং সখারাম গনেশ দেউস্করের লিখিত গ্রন্থ ‘দেশের কথা’ বিপ্লবীদেরকে পড়ানো হত।
প্রফুল্ল চাকী রংপুরের কুস্তির আখড়ার পরিচালক ছিলেন। এ সম্পর্কে প্রফুল্ল চাকীর বৈপ্লবিক সাধনার সহযোদ্ধা শ্রীযুক্ত সুরেশ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘রংপুরে আমাদের একটি বৈপ্লবিক দল ছিল। আমরা তিনজনেই (প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সুরেশ চক্রবর্তী ও প্রফুল্ল চাকী) অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। এই দলে প্রবেশের অনুষ্ঠান ছিল-বুক কেটে সেই রক্ত দিয়ে কয়েকটি প্রতিজ্ঞা সম্বলিত একখানি কাগজে স্বাক্ষর করা। এই প্রতিজ্ঞাগুলোর একটি ছিল- প্রয়োজন হলে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করবো’।ওই বছর শেষের দিকে প্রতিষ্ঠানিক পড়াশুনার ইতি ঘটিয়ে বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য কলকাতায় চলে যান প্রফুল্ল চাকী। শ্রী অরবিন্দর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে ও শ্রী অরবিন্দর অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছিল সশস্ত্র বিপ্লবী দল। কলকাতার ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি ছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের মূল কেন্দ্র। ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি ছিল অরবিন্দ, বারীন্দ্র, মনোমোহন ও বিনয় ঘোষের যৌথ সম্পত্তি। মুরারিপুকুরের বাগানের কেন্দ্রস্থলে ছিল ছোটো আকারের একটি বাড়ি। মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটিতে সাধারণত থাকতেন সশস্ত্র বিপ্লবী নেতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ।
কলকাতায় এসে প্রফুল্ল চাকী ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে উঠেন। বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নির্দেশে প্রফুল্ল চাকী ‘যুগান্তর’ দলে যোগ দেন। রংপুর থেকে আরো কয়েক জন কর্মী কৃষ্ণজীবন, নরেন বক্সী ও পরেশ মৌলিক কলকাতায় যান। তাঁরাও ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে উঠেন এবং বিপ্লবী কর্মকান্ডে যুক্ত হন। বারীন্দ্র ঘোষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শোষকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য মুরারীপুকুরের বাগানবাড়ীতে বোমা, পিস্তল প্রস্তুত ও সংগ্রহ, অস্ত্র ব্যবহারে তরুণ ও যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া, বিপ্লবের জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে থাকেন। ১৯০৬ সালে গুপ্ত সমিতির বিপ্লবীরা পূর্ব বঙ্গের ছোট লাট স্যার রামফিল্ড ফুলারকে দুইবার হত্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সফল হননি। ১৯০৭ সালে বারীন্দ্র কুমার ঘোষ পুনরায় ছোট লাট স্যার রামফিল্ড ফুলারকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। এজন্য টাকার প্রয়োজন। তাই বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ও অরবিন্দ ঘোষ রংপুরের বিপ্লবী দলকে রংপুরে গিয়ে এক জমিদার বাড়ীতে ডাকাতি করে টাকা সংগ্রহ করতে পাঠান। এই দলে ছিলেন নরেন বক্সী, হেমচন্দ্র দাস, মহেন্দ্র লাহিড়ী, পরেশ মৌলিক ও প্রফুল্ল চাকী। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রফুল্ল চাকী ও পরেশ মৌলিক। আর রংপুর থেকে যুক্ত হয়েছিলেন ঈশান চক্রবর্তী ও তাঁর ছেলে মনোরথ। সন্ধ্যার আগে মনোরথকে পাঠানো হয়েছিল জমিদার বাড়িতে। বিপ্লবী দল ডাকাতি করার জন্য প্রস্তুত। রাতে মনোরথ এসে খবর দেন যে, পূর্বেই ডাকাতির সংবাদ পেয়ে জমিদার বাড়ীতে পুলিশ এসেছে। এই খবর শুনে ডাকাতির পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। যে কারণে সেবারও ছোট লাট স্যার রামফিল্ড ফুলারকে হত্যা করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
এরপর আবার ফুলারকে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ফুলার সাহেব ধুবড়ী হতে যখন স্পেশাল ট্রেনে রংপুর আসবেন, তখন ধুবড়ী হতে একজন বিপ্লবী ফুলার সাহেবের আসার কথা টেলিগ্রাম করে জানাবেন। আর তখন রংপুর স্টেশনের একমাইল দুরে রেললাইনের নিচে ব্যাটারী সংযোগে একটি বোমা রাখা হবে। আর যদি বোমা না ফাটে তাহলে পরেশ মৌলিক ও প্রফুল্ল চাকী লাল লন্ঠন দেখিয়ে বিপদ সঙ্কেত বুঝিয়ে গাড়ি থামাবেন। তারপর প্রফুল্ল চাকী রিভলবার দিয়ে ফুলারকে হত্যা করবেন। কিন্তু এ যাত্রায়ও ফুলার হত্যা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। কারণ ওই দিন ফুলার ষ্টীমার দিয়ে চলে যান।
১৯০৭ সালের জুলাই মাসে ‘যুগান্তর’ সম্পাদক স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্র নাথ দত্তকে রাজদ্রোহমূল প্রবন্ধ লেখার জন্য কারদন্ড দেয়া হয়। কয়েক সপ্তাহ পর ‘বন্দেমাতরম’ সম্