১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর নেতৃত্বে স্কুলের প্রায় সকল ছাত্রছাত্রী ইংরেজি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বয়কট করেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রামে বার্মা অয়েল কোম্পানির ধর্মঘট, স্টিমার কোম্পানির ধর্মঘট ও আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ধর্মঘট প্রভৃতিতেও সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। অবশেষে মাষ্টারদা সূর্যসেনের পরামর্শ অনুযায়ী ১৯২২ সালে তিনি কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউশনে (যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) ভর্তি হন। এখানে এসে তিনি বিপ্লবী দলের কাজে যুক্ত থাকার পাশাপাশি ছাত্রদের নিয়ে বিপ্লবী দল গঠনের কাজে নিয়েজিত হন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় ১৯২৩ সালে মানিকতলা বোমা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিছুদিন জেলে থাকার পর প্রমাণাভাবে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে বিপ্লবীদের সাংগঠনিক শক্তির মতাদর্শিক পার্থক্যের কারণে চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দেন। এর কিছুদিন পর সূর্যসেন ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ‘যুগান্তর’ দল গঠন করেন। এই বিপ্লবী দলের সভাপতি হন সূর্যসেন, সহসভাপতি অম্বিকা চক্রবর্তী, শহর সংগঠক হন গনেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং এবং গ্রাম সংগঠক হন নির্মল সেন। এদলে পরবর্তীতে লোকনাথ বলকে যুক্ত করা হয়।
‘ভারত রক্ষা আইন’-এ ১৯২৪ সালের ২৫ অক্টোবর গণেশ ঘোষ, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং সহ আরো কয়েকজন গ্রেফতার হন। এসময় গণেশ ঘোষ চার বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন কারাগারে কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯২৮ সালের শেষের দিকে মুক্তিলাভ করেন তিনি।
১৯২৪ সালে ভারত উপমহাদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন। ভারত জুড়ে বিপ্লবীরা গড়ে তোলেন সশস্ত্র সংগ্রাম। ধীরে ধীরে সর্বত্র সংগঠিত হতে থাকেন স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা। এ সময় সংগঠিত হয় বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক ডাকাতি। বিপ্লববাদীদের এই ধরণের সশস্ত্র কার্যকলাপের কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ সরকার ‘১ নং বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ‘রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা’।
১৯২৮ সালে কলকাতায় সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। গণেশ ঘোষ প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেসের এই অধিবেশনে যোগ দেন। এই অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ও পরিচালনায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর চরিত্র ছিল সামরিক। ‘হিন্দুস্থান সেবক দল’ নামে আরেকটি বাহিনী সেসময় তৈরী হয়। কিন্তু সে দলের সাথে এ দলের পার্থক্য হল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিল। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বাহিনীকে সামরিক মানসিকতায় শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হয় । গণেশ ঘোষ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনীর জি.ও.সি. মনোনীত হন।
কলকাতা কংগ্রেসের পর গণেশ ঘোষ চট্টগ্রামে চলে আসেন। গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং এর প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামে ছাত্র, যুবক ও নারীদের সমন্বয়ে এক জনসংগঠন গড়ে ওঠে। ১৯২৯ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিতে নির্বাচিত হন। আর সূর্যসেন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্যদিকে সূর্য সেন পাঁচজন বিপ্লবীকে (মাস্টারদা নিজে, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন, গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং) নিয়ে বিপ্লবী পরিষদ গঠন করেন। তাঁদের মধ্যে গণেশ ঘোষ ছিলেন অন্যতম। এই পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাস্টারদা সূর্যসেনের দলের নাম রাখা হয় ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা’। চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে এক স্বাধীন বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের দুঃসাহসী পরিকল্পনা নেয় এই বিপ্লবী পরিষদ। সেই পরিকল্পনা অনুসারে একটি বিপ্লবী বাহিনী গঠন করার কাজ শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে এই দলে যুক্ত হন নির্মল সেন, ধীরেন চক্রবর্তী, উপেন চক্রবর্তী, নগেন সেন, বিনয় সেন, মধু দত্ত, রাজেন দে, লোকনাথ বলসহ আরো অনেকে। ওই সময় পর্যন্ত দলে কোনো মহিলা সদস্য ছিল না। সচ্চরিত্র, স্বাস্থ্যবান, সাহসী যুবক ও স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরই নেয়া হতো এই বিপ্লবী দলে। বিপ্লবীদের নানাভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পর এই দলে তাঁদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হতো। নিয়মিত অস্ত্রচালনা শিক্ষা চলতে থাকে এবং অস্ত্রশস্ত্র, বোমা ইত্যাদিও সংগৃহীত হতে থাকে। প্রায় ৫০ হাজার টাকাও সংগৃহীত হয়ে যায়। সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সূর্যসেনের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আইরিশ বিপ্লবীদের ‘ইস্টার বিদ্রোহের’ স্মৃতি বিজড়িত ‘গুডফ্রাইডের’ দিনে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাত দশটায় চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের অত্যন্ত সুপরিকল্পিত অভিযান শুরু করার বিষয়ে বিপ্লবীদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করেন বিপ্লবীরা। গণেশ ঘোষ ছিলেন এই অভিযানের ফিল্ড মার্শাল। রাত দশটা পনের মিনিটে বিপ্লবীরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন। বিপ্লবীরা একের পর এক অতর্কিত আক্রমণ করে সরকারি অস্ত্রাগার, টেলিফোন কেন্দ্র, টেলিগ্রাফ ভবনসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে নেন, যা ছিল দেড়শত বছরের ইতিহাসে ইংরেজদের জন্য খুবই অপমানজনক ঘটনা। এটি ছিল সরাসরি ইংরেজ বাহিনীর প্রথম পরাজয়।
১৯ এপ্রিল সকাল বেলা অগ্নিদগ্ধ তরুণ বিপ্লবী হিমাংশু সেনকে নিয়ে গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং, মাখন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্ত শহরে আসেন। ওই দিন বিকেল বেলা গণেশ ঘোষের বাবা বিপিন বিহারী ঘোষের ‘স্বদেশী বস্ত্রভাণ্ডারে’ পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্রাগার দখল কর্মসূচির ‘মবিলাইজেশন’ তালিকা পায়। কিন্তু ওই তালিকায় বিপ্লবীদের ডাক নাম থাকায় পুলিশ তেমন কাউকে চিনতে পারে না। তাই পুলিশ ওই অঞ্চলের প্রায় সকলের বাড়ি তল্লাসী চালায় এবং অনেক পরিবারের লোকজনকে মারধর করে। এদিকে বিপ্লবীরা সারারাত অভিযানের ফলে ক্ষুধার্থ থাকায় খাবারের উদ্দেশ্যে আনন্দ গুপ্তের পেরেডের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে টিলার উপরের বাসায় গিয়ে উঠার কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং অন্য দুই সাথীকে নিয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আনন্দ গুপ্তের বাসার পিছন দিক দিয়ে দেবপাহাড়ের জঙ্গলে চলে যান। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর তাঁরা শহরের দক্ষিণ দিকে ফিরিঙ্গিবাজারের কাছে বিপ্লবী রজত সেনের বাবার বাসায় গিয়ে উঠেন। রজত সেনের মা তাঁদের আশ্রয় দেন। তিনি রজতের খোঁজ নিলে গণেশ ঘোষ জানান, সে মাষ্টারদা’র সঙ্গে আছেন। সেখানে খাওয়া-দাওয়ার পর তাঁরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছেন, এমন সময় সেখানে পুলিশ আসে। রজতের মা নিজের ছেলের মতো এই বিপ্লবীদেরকে বাঁচানোর জন্য ঘরের মাচার মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। পুলিশ ঘরে প্রবেশ করলে বিপ্লবীরা মাচার ভেতরেই রিভলবার নিয়ে প্রস্তুত হন। পুলিশ মাকড়শার জাল ও পুরানো ময়লা জড়ানো মাচার দিকে তাকিয়ে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে যায়। এরপর বিপ্লবীরা গায়ে ধূলাবালি ও ময়লা মেখে পুরানো ছেঁড়া কাপড় পরে এখান থেকে দক্ষিণ কাট্টলীতে পূর্ব-পরিচিত এক বিপ্লবীর বাড়িতে গিয়ে উঠেন। ২০ ও ২১ এপ্রিল গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং অনেক চেষ্টা করেও মাষ্টারদাসহ অন্য বিপ্লবীদের সাথে মিলিত হতে পারলেন না। অবশেষে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন ২২ এপ্রিল গ্রাম্যচাষীর ছদ্মবেশে তাঁরা চট্টগ্রামের বাইরে চলে যাবেন। ওই দিন তাঁরা ট্রেনে করে কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ফেনী স্টেশনে পৌঁছার পর পুলিশ তাঁদেরকে ট্রেন থেকে নামিয়ে টিকিট মাষ্টারের ঘরে নিয়ে যায়। পুলিশ তাঁদের শরীর তল্লাশী করার জন্য হাত দিবেন এমন সময় অনন্ত সিং এর রিভলবার গর্জে উঠে। মুহুর্তের মধ্যে এক পুলিশ লুটিয়ে পড়ে এবং অন্যদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকেন। এসময় প্রথমে অনন্ত সিং পরে গণেশ ঘোষ বিছিন্ন হয়ে যান। আনন্দ গুপ্ত ও মাখন ঘোষাল মাথায় আঘাত নিয়ে দুই সহযোদ্ধাকে খুঁজতে থাকেন। অনেক খোঁজাখুজির পর গভীর রাতে গণেশ ঘোষের সাথে দেখা হয় তাঁদের। এরপর তাঁরা অনন্ত সিংকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথাও পেলেন না। অবশেষে তাঁরা কলকাতার যুগান্তর অফিসে চলে যেতে সক্ষম হন। অন্যদিকে অনন্ত সিং পাগল বেশ ধারণ করে বন্ধুদের খুঁজতে থাকেন। দুদিন পার হয়ে যাওয়ার পর তিনি তাঁর বাবার এক বন্ধুর সহযোগিতায় কলকাতায় চলে আসেন।
১৮ থেকে ২১ এপ্রিল এই চারদিন চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন কার্যত অচল ছিল। বিপ্লবীদের এ বিজয় ছিল গৌরবগাঁথা। ২২ এপ্রিল ভোর ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে চট্টগ্রাম নাজিরহাট শাখা রেললাইনের ঝরঝরিয়া বটতলা স্টেশনে একটি সশস্ত্র ট্রেন এসে থামে। বিপ্লবীদের তখন বুঝতে বাকি রইল না যে তাঁদের সম্মুখযুদ্ধের ক্ষণ আসন্ন। ওইদিন ব্রিটিশ সরকার সূর্য সেন, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং ও লোকনাথ বলকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ হাজার টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে।
২২ এপ্রিল সকালে বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন কয়েকজন কাঠুরিয়া ওই পাহাড়ে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে যায়। খাকি পোশাকে রাইফেলধারী কিছু যুবককে সেখানে দেখে তারা দ্রুত লোকালয়ে ফিরে গিয়ে লোকজনের কাছে বলে দেয়, স্বদেশীরা ওই পাহাড়ে আছে। এই খবর পুলিশের কাছে পৌঁছার পর সেনাবাহিনীর সশস্ত্র রেল গাড়ি জালালাবাদ পাহাড়ের কাছে এসে থামে।
জালালাবাদ পাহাড়ে তখন বিপ্লবীরা কেউ রাইফেল পরিষ্কার করছে কেউ বা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। গাছের ডালে পাহারারত বিপ্লবীরা দেখতে পায় সামরিক ট্রেনটি কোন স্টেশন না থাকা সত্ত্বেও অদূরে রেল লাইনের উপর থেমে গেল। ঝোপের আড়াল থেকে বিপ্লবীদের ছোঁড়া হঠাৎ গুলির আঘাতে সৈন্যদল বিভ্রান্ত হয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। সৈন্যরা এরপর জালালাবাদ পাহাড়ের পূর্ব দিকে ছোট্ট একটি পাহাড়ের উপর লুইসগান বসিয়ে বিপ্লবীদের দিকে গুলিবর্ষণ করে। দেশপ্রেম আর আত্মদানের গভীর আগ্রহে তরুণ বিপ্লবীরা পাহাড়ের বুকের উপর শুয়ে সৈন্যদের লুইসগানের গুলিবর্ষণের জবাব দিচ্ছিলেন। তিন প্রধান নেতা সূর্য সেন, নির্মল সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী সঙ্গে থেকে ঘন ঘন তাঁদের উৎসাহিত করছেন, গুলি এগিয়ে দিচ্ছেন। জীবিত বিপ্লবীরা শহীদদের লাশ পাশাপাশি শুইয়ে রেখে সামরিক কায়দায় শেষ অভিবাদন জানান। পাহাড়ে সুর্যসেনের নেতৃত্বে কয়েকশ পুলিশ আর সেনা বাহিনীর সাথে বিপ্লবীদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৮০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ব্রিটিশ বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এরপর গণেশ ঘোষ ও অপর তিনজন প্রধান বিপ্লবী কলকাতায় পৌঁছনোর পর ‘যুগান্তর’ দলের নেতাদের সহায়তায় ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়। ১৯৩০ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাতে এক বৃহৎ পুলিশবাহিনী চন্দননগরের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। গণেশ ঘোষের পরিচালনায় পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের এক ভয়ঙ্কর খণ্ডযুদ্ধ হয়। সংঘর্ষে মাখন ঘোষাল নিহত হন। পুলিশ অন্যান্য কয়েকজন বিপ্লবীসহ গণেশ ঘোষকে গ্রেফতার করে। তাঁদের উপর চলে অসহনীয় নির্যাতন। অবশ্য এরপূর্বেই অনন্ত সিং স্বেচ্ছায় পুলিশের হাতে ধরা দেন। কেন ধরা দেন এবিষয়ে তখন তিনি কাউকে কিছু বলেননি। এমনকি পুলিশকে তাঁর নাম পর্যন্ত বলেননি। পুলিশ তাঁকে সনাক্ত ও বিচার করার জন্য চট্টগ্রাম জেলে পাঠিয়ে দেয়। অন্যদিকে গণেশ ঘোষকে গ্রেফতার করার পর কোনো কিছুর স্বীকারোক্তি না করাতে পারায় তাঁকেও চট্টগ্রাম জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দুজনে চট্টগ্রাম জেলে দিন কাটাচ্ছেন। ততদিনে ব্রিটিশ সরকার ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’ মামলার বিচার কাজ শুরু করে।
বিচারকালে গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং জেল ভাঙার এক নতুন পরিকল্পনা করেন। আত্মগোপনকারী মাষ্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গেও তাঁদের গোপন যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে পরিকল্পনাটি বানচাল হয়ে যায়। স্পেশাল ট্রাইবুনাল গণেশ ঘোষকে যাবজ্জীবন নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করে। ১৯৩২ সালে তাঁকে আন্দামান সেলুলার জেলে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
১৯৩২-১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর বিপ্লবী জীবনের হিসেব-নিকেশ করলেন। ভাবনা-চিন্তা করতে থাকলেন সকল স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের নিয়ে। বিপ্লববাদী পথ নিয়েও ভাবলেন। এ সময় তিনি রাজনৈতিক পড়াশুনাও বাড়ালেন। ১৯৩৫ সালের এপ্রিল মাসে আন্দামান সেলুলার জেলে দুই কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আব্দুল হালিম ও সরোজ মুখার্জী রাজবন্দী হয়ে এলেন। এই দুই বিপ্লবী আন্দামানে বন্দীদের রাজনৈতিক পড়াশুনা ও সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ সম্পর্কে ধারণা দিলেন। বন্দীদের মধ্যে প্রতিদিন গোপনে গোপনে বৈঠক হতো। এভাবে তাঁরা গঠন করলেন কমিউনিস্ট গ্রুপ। যে গ্রুপের মধ্যে যুক্ত হলেন গণেশ ঘোষ।
বন্দীদের নূন্যতম বেঁচে থাকার অধিকার আদায় ও সেলুলার জেল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৯৩৮ সালের ২৫ জুলাই বন্দীরা আমরণ অনশন শুরু করেন। বার বার অনশন এবং প্রথম অনশনের জন্য ৩ জন বিপ্লবীর মৃত্যুর ফলে কিছু দাবিদাওয়া পূরণ হয়। অন্যদিকে অনশনকারীদের সমর্থনে ভারতব্যাপী উত্তাল আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল যুগান্তর, অনুশীলন ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ। ফলে ১৯৩৮ সালের ১৯ জানুয়ারী ব্রিটিশ সরকার চাপের মুখে আন্দামান বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। কিন্তু গণেশ ঘোষসহ ৩০ জনকে দেশে এনে মুক্তি না দিয়ে আলীপুর, দমদম, প্রেসিডেন্সি ইত্যাদি কারাগারে পাঠানো হয়। অবশেষে ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তি পান। মুক্তিলাভের পর তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ায় ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। তিনি তিনবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন (১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালে)। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজনের পর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) নামক নবগঠিত দলে যোগ দেন। এরপর তিনি ১৯৬৭ সালে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের সহকর্মী ও অনুরাগীদের নিয়ে গঠিত ‘বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা’-র সভাপতিত্বের ভার গ্রহণ করেন।
জন্ম
বিপ্লবী গণেশ ঘোষ জন্মেছিলেন যশোহর জেলার বিনোদপুর গ্রামে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে গণেশ ঘোষকে তাঁর বাবা চট্টগ্রামের মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। দুরন্ত ও চঞ্চল এই বালক পড়াশুনায় মেধাবী হওয়ায় স্কুলের শিক্ষকরা ও সহপাঠীরা তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। এই স্কুলের ছাত্র অনন্ত সিং ছিলেন তাঁর অন্যতম বন্ধু । আর এই অনন্ত সিং এর মাধ্যমেই মাস্টারদা সূর্যসেনের সংস্পর্শে আসেন গণেশ ঘোষ। বন্ধু অনন্ত সিং এর কাছেই মূলত তাঁর রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়। আর এই বন্ধুটিকে স্বাধীনতার সশস্ত্র আন্দোলনে সবসময় পাশে পেয়েছেন তিনি। খুব অল্প বয়স থেকে গণেশ ঘোষ দেশকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। সেই বয়স থেকেই শুরু হয় তাঁর বিপ্লবী দলের কঠোর নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন।
………………….
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা (https://www.facebook.com/pratapcsaha)। ধন্যবাদ ।
2022-06-22