স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, একনায়কতান্ত্রিক শাসন থেকে উদ্ভুত খাদ্যসংকট, আর্থিক সংকট ও তাঁর থেকে ত্রাণ পেতে টাকা ছাপানোর মত ফাঁকিবাজির রাস্তা এবং পরিণামে চূড়ান্ত মুদ্রাস্ফীতি, আজ শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক জরুরি অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে

স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, একনায়কতান্ত্রিক শাসন থেকে উদ্ভুত খাদ্যসংকট, আর্থিক সংকট ও তাঁর থেকে ত্রাণ পেতে টাকা ছাপানোর মত ফাঁকিবাজির রাস্তা এবং পরিণামে চূড়ান্ত মুদ্রাস্ফীতি, আজ শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক জরুরি অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে l খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে l দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে l বিদেশী মুদ্রার ভাণ্ডারে মাত্র 2.8 বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে আগামী 12 মাসে তাঁদের 3 বিলিয়ন ডলার ঋণের কিস্তি বাবদ চোকাতে হবে l দেশবাসীকে পেট্রল ডিজেল কম খরচ করতে বলা হয়েছে l জারি হয়েছে আর্থিক জরুরি অবস্থা l

আজকের শ্রীলঙ্কার দুটি মূল সমস্যা l এক, খাদ্য সংকট, দুই, আর্থিক সংকট l

প্রথমে আসা যাক খাদ্য সংকটে l একনায়ক রাজাপক্ষে ঘোষণা করলেন, তিনি দেশকে রাতারাতি জৈব চাষের যুগে নিয়ে যাবেন l রাতারাতি বন্ধ হল রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ l এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, ভারতীয় বামপন্থীদের ভগবান তথা মাও সে তুং এর এক ঐতিহাসিক তুঘলকি সিদ্ধান্ত l কালচারাল রেভলিউশনের সময় উনি দেশবাসীকে নির্দেশ দেন দেশের সব পোকা, ইঁদুর এবং চড়াই মেরে ফেলতে l কিন্তু চড়াই মেরে বস্তুতন্ত্রে এক বড় ক্ষতি হল l বহু কিটপতঙ্গ, যাদের ওই চড়াই খেয়ে ফেলত, তাঁদের উপদ্রপ বাড়লো l ফসলের ক্ষতি আরও বাড়লো l এবার মাও তাঁর পিতৃভূমি রাশিয়া থেকে চড়াই আমদানি শুরু করলেন কোটি কোটি রুবেল খরচা করে l মাওবাদী রাজাপক্ষের সিদ্ধান্তেও সেই বিপদ এলো ওই দেশে l কমল কৃষি ফলন l দেশের চা, এলাচ ইত্যাদি অর্থাকারী ফসলের (ক্যাশ ক্রপ) ফলন ঠেকলো তলানিতে, যা রপ্তানি করে তারা বিদেশী মুদ্রা আয় করত l কিন্তু একনায়কের ভুল ধরাবে কে? সরকার মিলিটারিকে দায়িত্ব দিয়েছে সব হিমঘরকে নিজের অধীনে নিতে l রাস্তায় লম্বা লাইন দুধ, তেল, চিনির জন্য l

শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় সমস্যা বিদেশী মুদ্রার ভাণ্ডার খালি হয়ে যাওয়া, যার ফলে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির রাস্তাও বন্ধ l একদিকে রপ্তানি বন্ধ, অন্যদিকে প্রচুর আমদানি এবং সর্বোপরি চীনের ঋণের ফাঁদে শ্রীলংকার আজ ডলার রিজার্ভ তলানিতে l তার উপর এই অর্থবর্ষেই তিন বিলিয়ন ডলার ধার শোধ করতে হবে l এছাড়া আছে অভ্যন্তরীণ ঋণ l 1991 তে ভারতের এই অবস্থা হয়েছিল l এই প্রসঙ্গে চীনের আর্থিক আগ্রসন নীতির ব্যাপারে আলোচনা করা যাক l চীন কোন দেশকে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলার জন্য সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে ঘুষ দিয়ে সেই দেশের অলাভজনক প্রকল্পে ঋণ দেয় l যেমন ধরা যাক, পশ্চিমবঙ্গে হিঙ্গলগঞ্জ, সাগরদিঘি, ইসলামপুর এবং ঘাটালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বানানোর জন্য চীন থেকে ঋণ নেয়া হল l আগামীদিনে সরকার কখনোই বিমান পরিষেবা দিয়ে এই লোন শোধ করতে পারবে না l সেই অবস্থা আজ ওই দেশের l শ্রীলঙ্কাও চীনের এই ঋণে জর্জরিত l আর এর হাত থেকে বাঁচার জন্য যে রাস্তা সবার শেষে নেয়া উচিৎ, চীনপন্থি রাজাপক্ষে সেই রাস্তাটিই নিলেন প্রথমেই l উনি টাকা ছাপালেন l 2020 তে শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল ব্যাংক 650 শ্রীলঙ্কা রুপি ছাপিয়ে, সেই টাকায় ডলার কিনে তার থেকে 213 খরচা করে l কিন্তু বাজারে ‘ শ্রীলঙ্কান রুপি ‘ বাড়ায় বাড়লো মুদ্রাস্ফীতি l এটা ম্যানেজ করতে সরকার SRR দ্বিগুন করলো, যাতে লিকুইডিটি নিয়ন্ত্রণে আনা যায় l এছাড়া তাঁরা আন্তর্জাতিক বাজারে বন্ড ছেড়েছিল ডলার আয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে l কিন্তু তাও অসফল হয় l 92% বিক্রি হয়নি l আজ কলোম্বা বন্দর সহ শহরের একটা বড় অংশ চীনের হাতে তুলে দিয়েছে রাজাপক্ষে l আগামীদিনে দেশের বহু পরিকাঠামো চীনের হাতে চলে যেতে বসেছে l

এই প্রসঙ্গে একবার গত বছরের নির্মলাজির 20 ট্রিলিয়ন আর্থিক প্যাকেজ এবং শক্তিকান্ত দাসের কিছু বাস্তব সিদ্ধান্তের কথা ভাবা যাক l বামপন্থী অর্থনীতিবিদদের অবজ্ঞা করে, টাকা ছাপিয়ে মানুষের হাতে না দিয়ে, পরিকাঠামো, কৃষি, গোপালন, মৎসচাষ, MSME, কেমিকাল, ফার্মাসি সহ প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য আলাদা প্যাকেজ ঘোষণা করে আমাদের অর্থমন্ত্রক l এর পরেই 24% জিডিপি হ্রাসের জন্য কঠোর ভাবে সমালোচিত হন দুজনেই l ব্যাংকের সুদ কমানো এবং মোরাটোরিয়াম দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থাকে বাঁচিয়ে দিলেও, শক্তি দাসের মত সিনিয়র আইএএস অফিসারকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় l যে প্রেসিডেন্সির স্পেশাল আইএএস ট্রেনিং সেন্টার থেকে টানা দুই দশকে আইএএস পরীক্ষার সাফল্য প্রায় শূন্য ছিল, তারাও নির্লজ্জের মত একজন সিনিয়র আইএএস অফিসারকে অশিক্ষিত বলতে পিছপা হয়নি l বাংলার সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ, চীনের বন্ধু রাজাপক্ষের ব্যর্থতা নিয়েও গবেষণা করুন যদি বিন্দুমাত্র সৎসাহস থাকে এবং জনগণকে জানান l তবে আপনারা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না জানি l আপনাদের পত্রিকা পুরো দায় চাপাচ্ছে কোভিড পরবর্তী পর্যটন শিল্পের মন্দায় l কিন্তু শ্রীলঙ্কা কি একা এই সমস্যার সম্মুখীন?

সুদীপ্ত গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.