নির্বোধের রোমান্টিসিজমের ফল কোনদিনও ভাল হয়নি।

কয়েকদিন আগে চারু মজুমদারের মৃত্যুদিন ছিল। এক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের নক্সাল আন্দোলন নিয়ে এই পোস্ট করেছিলাম। টাইম পাসের জন্য পড়তে পারেন।

লাল চীন থেকে আমদানিকৃত নক্সাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপট…

কার্ল মার্ক্সের সাধনা ছিল ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে খারিজ করে সমাজ বিবর্তনে জনগণের ভূমিকাকে বড় করে দেখানোর। তাছাড়া ব্যক্তির ভূমিকা বেশি বড় হয়ে গেলে তা পতনের সম্ভাবনাও থাকে বেশি। কারণ পারসোনালিটি কাল্ট অথবা ব্যক্তির ভাবমূর্তি হলো ক্ষণভঙ্গুর। তাই মার্ক্স স্বতঃস্ফূর্ত সমাজ বিবর্তনের কথা বলতেন এবং ব্যক্তির ভূমিকাকে যথাসম্ভব খাটো করে রাখার প্রয়াস করতেন। এর পেছনে অবশ্য উনার একটা দার্শনিক তত্ত্বও ছিল।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্ম নিয়েছে সমাজ বিবর্তনের ফলে তাই এখানে এমন কোন ব্যক্তি নেই যার ভাবমূর্তি ভঙ্গ হয়ে গেলে পুরো ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়বে। তাই সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও ব্যক্তির ভূমিকা যাতে কম হয় এবং সামাজিক বিবর্তনের ধারায় যখন অবজেক্টিভ সিচুয়েশন তৈরি হবে তখনই প্রোলেতারিয়েতের স্বতঃস্ফূর্ত উত্থানকে তিনি মান্যতা দিতেন। মার্ক্সবাদের এই ধ্যানধারণা থেকে সরে এসে মার্ক্সবাদীরা ব্যক্তি পূজায় মন দেন তাই তারা মার্ক্সবাদী, লেনিনবাদী কিংবা মাওবাদী। তবে এই ব্যক্তিবাদের সমস্যা আছে। যে গৌতম বুদ্ধ অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন সেই বুদ্ধের মন্দিরে গিয়ে জাপানী সৈন্যরা চীনা শত্রুদের মুণ্ডু কাটতে পারার আশীর্বাদ চাইত। এটা জানার পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন চীনকে উহারা শক্তিশেল মারিয়াছে আর বুদ্ধকে মারিয়াছে ভক্তিশেল। তেমনি চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি সমাজতন্ত্রকে গুড়িয়ে দিয়েছে বটে তবে কারেন্সি নোটে মাও জে দঙের ছবি ছাপিয়ে রেখেছে। এছাড়া মাও জে দঙের বিশাল বিশাল ছবি পুঁজিবাদী কম্যুনিস্টরাই টাঙ্গিয়েছে বেশি। অর্থাৎ মাওবাদকে তাহারা শক্তিশেল মারিয়াছে বটে তবে মাওকে মারিয়াছে ভক্তিশেল।

আসলে ষাটের দশকে মাও জে দঙের মাথায় এই ধারণার জন্ম নেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে এবং এর প্রভাব এসে পড়েছে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টিতে। তাই কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে এই সংশোধনবাদীদের বিতাড়িত করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে, সেই সঙ্গে এলিট বুদ্ধিজীবীদেরও খতম করতে হবে কারণ তারা ভেতরে ভেতরে পুঁজিবাদকে সমর্থন করেন। তবে এলিট বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বিচিত্র জীব। তারা কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে পুঁজিবাদের ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে কমিউনিজমের সমর্থক। এছাড়া মাওয়ের মাথায় এই চিন্তা আসে যে দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডকে বিফল করে দিতে বুর্জোয়াশ্রেণিরাই ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করেছেন তাই তাঁর ভাবমূর্তি অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে। এই মর্মে চীনাবাসীদের মগজে নিজেকে ঈশ্বরতূল্য করে তোলার জন্য তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেন। বর্তমানে ওনার এই ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়েই পুঁজিবাদ রমরমিয়ে চলছে। হায় রে বিধির বিধান। আসলে মাওবাদের মধ্যে উত্তাপ যতটা আছে আলোক ততটা নেই। তাই উন্মাদনা শেষ হয়ে গেলে আর বিশেষ কিছুই থাকে না। তাই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উন্মত্ততা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণপন্থীরা অতি সহজেই চীনের কম্যুনিস্ট পার্টিকে কব্জা করে নিয়েছেন। তবে এমনটা যে হতে পারে এই আশঙ্কা মাও জে দঙের মাথায় ছিল এবং ওনার নিজেরই নির্বুদ্ধিতার কারণেই এই কাজটি ত্বরান্বিত হয়েছে।

মাও ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেন। এই মর্মে তিনি ‘রেড গার্ড’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন মূলত প্রতিবিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য। মাওয়ের এই রেড গার্ডে এমন কি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও সামিল করা হয়। এছাড়া যুবকরাতো ছিলই। এদের প্রাথমিক কাজ ছিল বৌদ্ধ মঠ ও মন্দির, গির্জা, মসজিদ আদি সমস্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে গুড়িয়ে দিয়ে এর দালানগুলোকে অন্য কাজে লাগানো। ধর্মগ্রন্থ, কনফুসিয়াসের রচনা ও প্রাচীন সমস্ত পুঁথি পুড়িয়ে ফেলা এবং বুদ্ধ কিংবা যিশুর মূর্তিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া। এছাড়া বিপ্লবের আগের যা কিছু যার প্রতি মানুষের ভালবাসা আছে সেগুলিকে প্রতিবিপ্লবী জ্ঞান করে নষ্ট করে ফেলা। সমাজের শিক্ষক, ধার্মিক ব্যক্তি যেমন বৌদ্ধ শ্রমণ, গির্জার পাদ্রী কিংবা মোল্লাদের মারধর, হত্যা কিংবা শ্রমদাসে পরিণত করা।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হওয়ার পরই ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার’ উৎস নামক উগ্র মাওবাদী আদর্শে হত্যালীলা শুরু হয়ে যায়। তবে এক বছরের মধ্যেই দেখা গেল অন্য খেল। অর্থাৎ রেড গার্ডের ছেলেরাই শহরের সড়কগুলোতে শুরু করে দিল নিজেদের মধ্যে লড়াই। সারা চীন জুড়ে তখন চলছে মারামারি কাটাকাটি। পরিস্থিতি দেখে আর্মি জেনারেল বলতে বাধ্য হলেন যে যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। এই সব পাগলামি বন্ধ হওয়া উচিত। এটা শোনার পর গ্যাং অব ফোরের অন্যতম প্রধান মাওয়ের পত্নী জিয়াং কিউইং রেড গার্ডদের আদেশ করলেন সৈন্যবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পিপলস লিবারেশন আর্মির বিরুদ্ধে প্রয়োজনে লড়াই চালাতে। এই পিপলস লিবারেশন আর্মিদের নিয়েই এক সময়ে বিপ্লব হয়েছিল।

১৯৬৮ সালেই মাও বুঝে যান যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের কারণে অর্থব্যবস্থা আগে থেকেই অত্যন্ত খারাপ হয়েছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে অবস্থা আরো খারাপের দিকে চলে যায়। মাত্র দু’বছরের মধ্যেই চরম অরাজকতার কারণে শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন আরো ১২ শতাংশ হ্রাস পায়। উঠতি বয়সীদের নিয়ে রেড গার্ড তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কাকে ধরে আর কাকে মারে তার কোন ঠিক নেই। আর নিজেদের মধ্যে মারামারিতো আছেই। এই পরিস্থিতিতে এই রেড গার্ডদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে মাও তখন ‘গ্রামে যাওয়ার’ নীতি ঘোষণা করেন। এই কথা জানার পর পশ্চিমবঙ্গের নক্সাল নেতারাও ক্যাডারদের গ্রামে যাওয়ার স্লোগান দেন। নির্বোধের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

মাও জে দঙের এই রেডগার্ডদের গ্রামে পাঠানোর নীতিতে বিশেষ কাজ হয় নি। মোট দশ বছরের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রথম সাত-আট বছর কম্যুনিস্ট পার্টির ক্যাডাররা নিজেদের মধ্যেই আঞ্চলিক স্তরে দলীয় নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য একে অন্যকে হত্যা করেছে। ১৯৭১ সালে মাও ও কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হিসেবে খ্যাত লিন বিয়াও একে অন্যকে খতম করার চক্রান্ত করেন কারণ লিন তখন মাও বিরোধী হয়ে গেছেন। এই কারণে লিন বিয়াও সোভিয়েত রাষ্ট্রের মদত নিতে মস্কো যাওয়ার জন্য একটি প্রাইভেট প্লেনে করে ওড়ান নেন। সঙ্গে তাঁর পরিবারও ছিল। কিন্তু সেই প্লেন মাঝপথে ক্রাশ ল্যান্ডিং করায় তিনি পরিবার সহ নিহত হোন। এই ক্রাশ ল্যান্ডিঙে কার হাত ছিল এটা জানা যায় নি। ‍

একদিকে দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের চরম ব্যর্থতা ও অন্যদিকে কালচারেল রিভলিউশনের চরম দুর্দশার কারণে মাও জে দং ১৯৭১ সালেই বুঝে যান যে তিনি একজন প্রশাসক হিসেবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাই তিনি মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েন। তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল দিন কে দিন। এই সুবাদে গ্যাং অব ফোর নামে কুখ্যাত চারজনের গ্রুপটি পুরো চীনের দখল নিয়ে নেয়। অবশেষে চরম হতাশার মধ্যেই ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাও জে দং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ওনার মৃত্যুর এক মাসের মধ্যেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবও শেষ হয়ে যায়। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার হিসেব হয়ত কোন দিনও পাওয়া যাবে না। তবে এখানে অতি সংক্ষেপে কিছুটা ব্যক্ত করব।

সমস্ত শিক্ষকদের মাওবাদী মগজ ধোলাইয়ের জন্য রি-এডুকেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল তাই এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলাকালীন সময়ে দশ বছর সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এই কারণে একটা পুরো জেনারেশন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকেছে। যে সব শিক্ষকরা জীবিত ছিলেন তাদের পরে গ্রামে গঞ্জে পাঠানো হয় শিক্ষার প্রসারের জন্য। এর মধ্যে অনেক উচ্চশিক্ষিতরা ছিলেন যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ করতে বাধ্য হন। রেড গার্ডের যুবকরা মিউজিয়ামে ঢোকে অনেক প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করে দিয়েছে কারণ তাদের বলা হয়েছিল প্রাচীন বস্তু মানেই প্রতিবিপ্লবী। চীনের অনেক প্রাচীন গ্রন্থ, দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি ঐতিহাসিক দিক থেকে দুর্মূল্য এবং মানব সভ্যতার ঐতিহ্যশালী চিন্তন যা লিপিবদ্ধ ছিল তা আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয়েছে। এই সব ভস্মীভূত পাণ্ডুলিপির মধ্যে কনফুসিয়াসের রচনাও ছিল। এই সব আর উদ্ধার হবে না।

চীনের এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে লোকক্ষয় কতটা হয়েছে তার সঠিক হিসেব পাওয়া মুস্কিল। অন্তত ২০ লক্ষ লোক মারা গেছেন বলে অনুমান করা হয়। এছাড়া যাদের নির্মমভাবে অপমান ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে তাদের অনেকেই পরে আত্মহত্যা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, গির্জার পুরোহিত, মোল্লা, মৌলভী ও বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা। চীনের এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব যে ভাবে হিংসাত্মক হয়ে ওঠেছিল তা এক সময়ে কারোরই নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তবে মাও জে দঙের মৃত্যুতে কি করে জানি এই উদ্দাম নৃত্যের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু এর প্রভাব থেকে গেছে দীর্ঘ দিন ধরে। বিশেষত চীনের প্রাচীন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার এই নীতিকে কোন অবস্থাতেই সমর্থন করা যায় না কারণ শিকড় ছাড়া গাছ দাঁড়াতে পারে না। মানব সভ্যতা যে একটি চলমান ধারা লেনিন সেটা বুঝতেন তাই রুশ বিপ্লবের পরই তিনি কম্যুনিস্টদের বলেছিলেন সমস্ত প্রাচীন ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং করেওছিলেন। মাও জে দঙের সঙ্গে লেনিনের এইখানেই তফাৎ।

এদিকে মাও জে দং সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধাচরণ করে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে ভারতের একদল রোমান্টিক বিপ্লবীরা চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান স্লোগান দিয়ে নক্সালবাদী আন্দোলন শুরু করে দেন। বাংলার সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই নক্সাল আন্দোলনকে রোমান্টিসাইজ করেছেন বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে। বাংলার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় রোমান্টিক হয়ে কবিতা লিখেছেন ওরা বিপ্লব চেয়েছিল বলে ওদের মরতে হলো। কিন্তু বিপ্লব চাই বলে যদি অন্যদের হত্যা করার অধিকার জন্মায় তাহলে তোলাবাজ, কিডন্যাপার ইত্যাদি অপরাধীরা রাতারাতি বিপ্লবী সেজে নিজেদের কাজ করতে শুরু করে দেবে। তবে ভারতে আজও অনেক মানুষ নানা ধরণের বৈষম্যের শিকার। এর প্রতিকার আমিও চাই কিন্তু এরজন্য সঠিক নেতৃত্বদানের প্রয়োজন। নির্বোধের রোমান্টিসিজমের ফল কোনদিনও ভাল হয়নি।

রজত কান্তি দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.