১৯৪১ সালের ১৫ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র যখন গোপনে ভারত থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন তখন তাঁর অন্তরে দেশকে ইংরেজ মুক্ত করার তীব্র আবেগের সঙ্গে বহমান ছিল ইতিহাস-বিরল এক আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পরিকল্পনার ভাবনা।
বিচিত্র ছদ্মবেশে ২৮ মার্চ বার্লিন পৌছনোর পর তিনি তার যুদ্ধ পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার পথে মানসিকভাবে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন একথা সকলেরই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন জোর কদমে। পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় জাপান অক্ষশক্তির অংশ হিসেবে ইংরেজদের সঙ্গে কঠিন লড়াই করছে। জার্মানিতে নেতাজী ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সৈন্যদের (যে সব ভারতীয় ব্রিটিশের হয়ে সারা বিশ্বে যুদ্ধ করতে বাধ্য হতো) একটা বড়ো অংশকে জার্মানির হাতে বন্দি অবস্থায় দেখেন। এরা ছিল অফ্রিকা ফ্রন্টের দুধর্ষ জেনারেল রোমেলের হাতে ধরা পড়া সৈন্য। জার্মানিতে অবস্থানের সময় চার। হাজারের মতো যুদ্ধবন্দিকে নিয়ে তিনি ইন্ডিয়ান লিগ গঠন করেন যারা অদুর ভবিষ্যতে হিটলারের সৈন্যদের সহকারী হয়ে ভারত আক্রমণ করবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই আফ্রিকায় হিটলারের ফৌজ নাজেহাল হতে থাকে। পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। অন্যদিকে আর এক দুর্জয় বিপ্লবী রাসবিহারী বোস নানা ছদ্মবেশে জাপানে পৌঁছে জাপানের কাছে পরাজিত-ইংরেজ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে তাঁর ১৯৪২ সালে সিঙ্গাপুরে প্রথম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা সকলেরই জানা। অক্ষ শক্তির হয়ে জাপান একের পর এক সিঙ্গাপুর, মালেসিয়া, বার্মায় ইংরেজ সৈন্যকে পরাজিত করায় বিপুল সংখ্যক ব্রিটিশ সেনাবাহিনিতে নিযুক্ত ভারতীয় সেনারাও যুদ্ধবন্দি হয়ে যাবার অপমান ভুলতে নতুনভাবে আইএনএ সৈনিকের পোশাক ধারণ করছে। এই সময়েই রাসবিহারীর অনুরোধে জাপান সরকার হিটলারের কাছে নেতাজীকে জাপানে পাঠাবার আবেদন করে। এ খবর পাওয়ার পরই নেতাজী হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন। আজীবন বর্ণবিদ্বেষী (১৯৩৬ এর বার্লিন অলিম্পিকে সর্বাধিক পদকজয়ী জেমি ওয়েনমের সঙ্গে করমর্দন করেননি কালো হওয়ার কারণে) প্রথমে রাজি না হলেও পূর্ব এশিয়ায় জাপানি সাফল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকায় তিনি একবারই সুভাষের সঙ্গে দেখা করে জাপানে যাওয়ার একটি সাবমেরিন ও চালকের ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যের এই বন্দুক ঘুরিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করা যে একদিন সম্ভব হতে পারে একথা দামোদর বিনায়ক সাভারকরের মতো দুর্জয় ব্যক্তি দেশপ্রেমী সুভাষকে আগেই বলেছিলেন। ইংরেজ কবলিত সেই সমগ্র সমুদ্রপথে বিপদসঙ্কুল সাবমেরিন যাত্রার কথাও সুবিদিত, অবশ্য এই জার্মান সাবমেরিন মাঝে মধ্যে ভেসে উঠত। এমনই একটি দিনে তিনি তার সুদূর মাতৃভূমির দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন ‘জয় হিন্দ’। দেশকে অভিবাদন মন্ত্রের সেই ছিল জন্মক্ষণ৷৷ জাপান পৌঁছে INA-এর ভার তুলে নিয়ে এক উজ্জীবিত ভারতীয় ফৌজ তৈরির কাজে হাত দিলেন তিনি। ২১ অক্টোবর ১৯৪৩ ঘোষিত হয়ে গেল আজাদ হিন্দের প্রভিন্সিয়াল সরকার (আর্জি হুকুমত-ই-আজাদ হিন্দ)। জার্মানি, ইটালি, জাপান প্রভৃতি অক্ষশক্তি ভুক্ত দেশগুলি ও অন্যান্য আরও ৭টি দেশ সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানায়। তাহলে সেনা তৈরি, নেতা তৈরি, দেশপ্রেমের শিখা বহ্নিমান, শুধু নেই স্বাধীন দেশের কোনো নির্দিষ্ট ভূমিখণ্ড। জাতির প্রধানতম শর্ত হিসেবে State as a concept of political scienes & constitutional law in a community of persons …. parmanently occupying a definite position of territory। এই ভূমিখণ্ড অর্জন স্বাধীন দেশ হয়ে ওঠার আবশ্যিক শর্ত। ১১৪২ এর জানুয়ারিতে জার্মানি, জাপান, ইটালি পারস্পরিক যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তাতে ইয়রোপ ও আফ্রিকার বিজিত অঞ্চলগুলি তাদের অধিকারে থাকবে। পূর্ব দিকের অর্থাৎ এশীয় অঞ্চল থাকবে জাপানের আওতায়। এই সূত্রে যে আন্তর্জাতিক বিভাজনরেখা টানা হয় তাতে জাপান ইতিমধ্যেই পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বহু দেশ অধিকার করে নিয়েছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে একাত্মতা ও তাকে পূর্ণ মান্যতা দিতে জাপানি প্রধানমন্ত্রী ও জেনারেল হিদেকি তোজো ৬ই এপ্রিল ১১৪৩ এর ইস্ট এশিয়া কনফারেন্সে বিজিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কাজও সেই মতো হয়। নেতাজী আন্দামান পরিদর্শন করে দ্বীপ দুটির নাম শহিদ ও স্বরাজ বলে চিহ্নিত করেন। শর্ত পুরণ হয়ে গেল স্বাধীন দেশের। ভূমি এসে গেল অধিকারে।ঠিক আছে, বড় লড়াই সামনে প্রত্যাখান করেননি তিনি। কিন্তু বললেন আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপানি সেনার সঙ্গে কাধে কাঁধ মিলিয়ে ভারত ভূমির জলে জঙ্গলে লড়ে ইংরেজদের পরাজিত করেই স্বাধীন দেশের মর্যাদা চায়। নেতাজী বলেছিলেন INA should be the first to shed its blood on the soil of India. সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে এক ভাষণে প্রকাশ করলেন তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন “The future greatness of Indians who will be born, not as slaves but treemen because of your colossal sacrifice….. the darkest hour always preceds the dawn. India shall be free & before long.”
বলা দরকার সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, বার্মা জয় করার সময় সিঙ্গাপুর থেকে রেঙ্গুনের পথে ফৌজের রণধ্বনি ছিল রেঙ্গুন চল, রেঙ্গুন চল। এইবার আইএনএ এবং জাপানি ফৌজের মুখে এল সেই বিখ্যাত ‘চলো দিল্লি, চলো দিল্লি।
শুরু হল বার্মা থেকে কোহিমা, ইম্ফল হয়ে মৈরাং অভিযান। নেতাজী জাপানের সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে অভিযান শুরুর আগেই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন ‘‘The first flag planted on the Indian soil would be tricolour & the first bloodshed on the liberated area would be that of Indians.” —ঠিক সেই জায়গায় পতাকা আজও উড্ডীন আছে।
ভারতবর্ষের যে প্রান্ত দিয়ে নেতাজীকে ঢুকতে হতো তা সেই ৭৫ বছর আগে আক্ষরিক অর্থেই ছিল পর্বত, পাহাড়, জল, জঙ্গলের প্রাকৃতিক লীলাভূমি। জাপানি ট্যাঙ্ক বা কামান ছাড়া তার সৈন্যের লড়াই করা সম্ভব ছিল না, তাই জাপান যে পথে চলেছে সেই ছিলউইন নদী পেরিয়েই ছিল ভারতের প্রবেশদ্বার। আইএনএ-র মৈরাং ফ্রন্টের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য এইচ. সি. শোভার লেখা থেকে জানা যায় ১৫ই মার্চ ইন্দো-বার্মা সীমান্ত পেরিয়ে বাহিনী ১৯ তারিখে উমরূল আক্রমণ করে। ৩১ তম জাপানি ডিভিসন ও INA বাহিনী উমরূল অধিকার করেই ২১শে মার্চ কোহিমা অবরোধ করে। ২১শে মার্চ INA এর একটি রেজিমেন্ট ছিলউইন নদীর আর একটি দিক থেকে ঢুকে কোহিমা ইম্ফল রোড বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু এই লড়াইয়ে INA ও জাপ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। জঙ্গলের পথে বহু ভারতীয় সৈন্য আটকে পড়ে। ইংরেজ সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ শানায় অ্যাডমিরাল মাউন্টব্যাটেন বোমারু বিমান পাঠান। ইতিহাসের এ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তার বর্ণনার প্রয়োজন নেই। ইম্ফলে গুরুত্বপূর্ণ বার্মা টিডিস রোড অধিকার করার পর শিলচরের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা বিষেনপুরেই আটকে যায়। ১৩ই এপ্রিল INA ও জাপ বাহিনীইম্ফল থেকে ৪৫ কিলোমিটার দুরে প্রাচীন এই মৈরাং কাংলা’জনপদ সম্পূর্ণ দখল করে নেয়। নেতাজীর আমৃত্যু লালিত স্বপ্ন সফল করে ১৪ই। এপ্রিল ১৯৪৪ এর এক রক্তাক্ত অপরাহ্নে আজাদ হিন্দ ফৌজের সুভাষ ব্রিগেডের কর্নেল সৌকত আলি মালিক মৈরাংয়ের এই ভূমিকে চিরস্মরণীয় করে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা তোলেন। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে বিপুল উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়েছিল বলে জানালেন সেই সময়ে কর্নেল মালিকের সঙ্গে থাকা সাগবা সিংহ, কাংলেন সিংহ, কেলিরেন সিংহ প্রমুখের পরিবারের পরবর্তী সদস্যরা।
বর্তমানে মৈরাংয়ে একটি ত্রিস্তর সংরক্ষণাগার নির্মিত হয়েছে। প্রথমটি INA War Musium. এখানে যুদ্ধে ব্যবহৃত বেয়োনেট, গোলা, হেলমেট, পিস্তল, আমেরিকান ট্যাঙ্কের দরজা, হাত বোমা, জাপানি রাইফেল রয়েছে। রয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য ছবি। নেতাজীর নিজের হাতে স্বাক্ষর করা Circular। এই মৈরাংয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন ভারত সরকারের প্রথম প্রধান কার্যালয়। যে বাড়িতে দপ্তর স্থাপিত হয়েছিল বেশ কিছু বুলেটের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে তা আজও বিদ্যমান। তবে সংগ্রহালয় বা বাড়ি কোনো কিছুরই ছবি তোলা বারণ বলে সেটি করা যায়নি। হ্যা, মিউজিয়ামে রয়েছে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিভিন্ন সামরিক মর্যাদার ফলক। আজাদ হিন্দের যুদ্ধে যাওয়ার আদেশনামা। এগুলি দেখলে অনুভূতিতে হঠাৎ যে ফারাক টের পাওয়া যায় সেগুলি লিখে বোঝানো অবান্তর।
সবচেয়ে বড় কথা, আজাদ হিন্দ ফৌজের এই সরকার ছিল সব দিক দিয়ে সংগঠিত। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিভক্ত ও নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্বে ভাগ করা। যে সরকারের প্রথম কর্তব্য ছিল দেশ থেকে বিদেশি ইংরেজকে উৎখাত করা। সরকারের ছিল নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা ১০ হাজার টাকা মানের নোট পর্যন্ত বাজারে ছিল। কিছু জাপানি নোটও চলত। আজাদ হিন্দ সরকার তখনকার মূল্যমান ১, ৩, ৮ ও। ১২ আনা দামের পোস্টেজ স্ট্যাম্পও চালু করে। এগুলি সবই মিউজিয়ামে দেখা যাবে। সরকারের অধীনে ছিল ৫০ বর্গমাইল এলাকা। জনসংখ্যা ছিল ১৫০০০। মণিপুর ও বিষ্ণুপুরের অঞ্চলই ছিল সরকারের অধীনে। যুদ্ধে জাপানের অবস্থার অবনতি ও ইংরেজদের তুমুল আক্রমণের মুখে ৩ মাসের বেশি এই প্রথম ভারতীয় স্বাধীন সরকার টিকে থাকতে পারেনি। তবে এমন দুর্গম পথে এই সফল অভ্যুত্থানে ইংরেজের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছিল। ত্বরান্বিত হয়েছিল ভারতীয় স্বাধীনতা। আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতিতে নির্মিত ইত্তেফাফ, ইত্তেমাদ, কুরবানি সমেত প্রথম ফলকটি প্রথমে ব্রিটিশরা পুনর্দখলের পর ধ্বংস করলেও পরবর্তী ভারত সরকার সেটি পুনর্নির্মাণ করেই নেতাজীর প্রতি দায় রক্ষা করেছে। জাতির এমন পুণ্যতীর্থের আরও প্রচার দেশের স্বার্থেই কাম্য।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
2019-08-09