অনেক পুরোনো দিনের কথা | সেই দিনেই নিজের স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি | সে দিন বিকেলে কলকাতার এক জমিদার বাড়ি থেকে তাঁকে প্রসব করানোর জন্য ‘কল’ দেওয়া হয় | সকালে স্বামীহারা চিকিৎসক বিকেলে তাঁর ব্যাগপত্র নিয়ে তাঁর টাট্টুঘোড়ায় টানা ফিটন চেপে সেখানে রওনা দেন। হতবাক ও অসন্তুষ্ট আত্মীয়দের বলেছিলেন, ‘‘যে গেছে সে তো আর ফিরবে না, যে নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসছে তাকে তো আনতে হবে!’’
যে সময়ে ভারতীয় মেয়েদের কর্মজগতের রেখচিত্র তেমন ভাবে তৈরিই হয়নি, ঘরের আঙিনা পেরিয়ে বহির্জগতে পা রাখতে ইতস্তত করছেন অধিকাংশ মহিলা, সেই সময়ে টাট্টুঘোড়ায় টানা ফিটন চেপে এক মহিলা যাচ্ছেন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, রোগী দেখতে। হাতে কুরুশ-কাঠি, অপূর্ব লেস বুনছেন রাস্তায়। আবার বিহার, ওড়িশায় খনিমজুর মেয়েরা কেমন আছেন, তা সরেজমিনে দেখে রিপোর্ট দিয়েছেন সরকারকে। প্রাইভেট চেম্বার খুলে কাগজে তার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন | নিয়মিত অস্ত্রোপচার করেছেন। নীলরতন সরকার-প্রাণকৃষ্ণ আচার্যের মতো দুঁদে ডাক্তারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্র্যাকটিস জমিয়েছিলেন কলকাতায়, নেপালে। বাংলার মেয়েদের শিল্পকৃতি নিজের উদ্যোগে সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকের প্রদর্শনীতে। অন্য জাতের পাত্রকে বিয়ে করেছিলেন প্রেম করে। ন’টি ছেলেমেয়ে মানুষ করেছিলেন, তাঁদের বিয়ে দিয়েছিলেন, নাতি-নাতনি নিয়ে সংসার করেছিলেন পুরোমাত্রায়।এমন মেয়েকে ঠাহর করা সহজ নয়।

২০শে ফেব্রুয়ারী,১৮৮৮ সালের একটা চিঠির বক্তব্য (ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদিত) দেখা যাক –
“কে এই মিসেস গাঙ্গুলী, আমায় কিছু জানাতে পারো? সে নাকি এর মধ্যেই ফার্স্ট লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি পাশ করে ফেলেছে আর আগামী মার্চ মাসে ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। এই তরুণী বিয়ে করে ফেলেছে, ডাক্তার হবে ঠিক করার পরে! তার পর অন্তত একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যদি না দুটি জন্মে থাকে। কিন্তু ছুটি নিয়েছিল মাত্র ১৩ দিন, আর শুনছি নাকি একটাও লেকচার মিস করেনি!’’
বিদেশের মাটিতে বসে এই কথাগুলো আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন | এর থেকেই বোঝা যায় ডাক্তার গাঙ্গুলি শুধু বাংলা কিংবা ভারতেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই সেই সময় আলোড়ন তৈরী করেছিলেন |

ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলি | কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ছাত্রী | প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার | তিনি এবং আনন্দী গোপাল জোশী প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তার, যাঁরা ওয়েস্টার্ন মেডিসিন নিয়ে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা অর্জন করেন। এর পর কাদম্বিনী ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন এবং এলআরসিএস এবং জিএফপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি ডাক্তারি শাস্ত্রের একাধিক বিদেশি ডিগ্রি অর্জনের দুর্লভ দক্ষতা দেখান। অথচ তাকেই ‘ব্যাচেলর অব মেডিসিন’ বা এমবি পরীক্ষায় পাশ করানো হয়নি ! গবেষক নারায়ণ চন্দ্রের লেখানুযায়ী, চিকিৎসক চন্দ্র মেডিসিন পড়াতেন। তিনি কাদম্বিনীকে মৌখিক পরীক্ষায় তাঁর পেপারে এক নম্বরের জন্য ফেল করিয়ে দেন।
ব্যঙ্গবিদ্রুপ সারাজীবন কাদম্বিনীর পিছু ছাড়েনি। অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে। স্ত্রী-রোগী দেখানোর নাম করে অনেক সময়ই তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বাধ্য করা হত যৌন রোগে আক্রান্ত পুরুষ রোগীকে দেখতে। গোঁড়া হিন্দুদের তো কথাই নেই, একটি বাংলা খবরের কাগজের এক সম্পাদক স্বচ্ছন্দে তাঁকে ‘বেশ্যা’ লিখেছিল। কাদম্বিনী তখন ডাক্তার, পাঁচ ছেলেমেয়ের মা। ছাড়েননি সম্পাদককে, মামলা করে জেল খাটিয়েছিলেন ‘বঙ্গবাসী’র সম্পাদক ‘মহেশচন্দ্র পাল’কে। লড়াইতে সবসময় পাশে পেয়েছিলেন স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়-কে |
১৯২৩ সালের ৩ অক্টোবর | হাসপাতালে জরুরি অস্ত্রপ্রচার শেষ করে গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাড়িতে ঢুকলেন | অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে কয়েকদিন ধরেই শরীর আর তাঁর সঙ্গ দিচ্ছিল না । পুত্রবধূ সরলাকে বলেছিলেন, ‘‘আজকের অপারেশন দেখলে আর কেউ বলতে পারবে না যে, ডাক্তার গাঙ্গুলির আর অপারেশনের হাত নেই।’’ তারপরে সরলাকে খাবার বাড়তে বলে স্নান করতে গিয়েছিলেন। খাবারের থালা সাজিয়ে নীচের তলায় সরলা অনেকক্ষণ বসে ছিলেন |শেষে শাশুড়ি আসছেন না দেখে দোতলায় তাঁর শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখেছিলেন, তাঁর শাশুড়ি বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। হার্ট অ্যাটাক ! মুহূর্তেই সব শেষ | আর চোখ খোলেননি ডাক্তার গাঙ্গুলি |

বড় আশ্চর্য ছিল তাঁর জীবন। জীবনে এত বিরোধিতা সত্ত্বেও কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ছিলেন বটবৃক্ষের মত অটুট | অন্য ধাতুতে গড়া ছিল মন। যে দক্ষতায় অস্ত্রোপচারে ছুরি চালাতেন, সেই দক্ষতাতেই তৈরি করতে পারতেন অপূর্ব সব লেসের নকশা। ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ প্রবাদকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি করে, সময় ও সমালোচনাকে পদানত করেছিলেন কাদম্বিনী!

আজ প্রয়াণদিবস | আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.