১৯৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধে পাক সেনাধ্যক্ষ জেনারেল নিয়াজি এক সম্পূর্ণ অসহায় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ৯৩ হাজার সৈন্যের বিশাল সংখ্যা নিয়ে তিনি ভারতের কাছে চরম অবমানাকর আত্মসমর্পণ করেন। এই ঘটনা পাকিস্তানের কাছে চির কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে। তবে তার বলার জায়গা ছিল এটাই যে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও আক্রমণাত্মক পূর্ব পাকিস্তানিদের মোকাবিলায় তার সৈন্যের কোনো রসদ ছিল না আর তারা ছিল বহু দূরে। এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকা ছিল অসম্ভব। তিনি আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনো বিকল্প খুঁজে পাননি। কিন্তু এই মানদণ্ডে ভারতের দারিদ্য দূরীকরণ কিন্তু আদৌ অসম্ভব কোনো দায় নয়। যার ফলে গরিবদের কোনো কাজের সংস্থান ছাড়াই ‘ন্যায়’নামাঙ্কিত প্রকল্পে তাদের চিরকালীন দান দিয়ে সমস্যার সমাধান করা হবে। এর পরিণতিতে আমাদের দেশে সুযোগের যে পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে তা অব্যবহারে ধ্বংস হয়ে যাবে। ভাবা দরকার, ভারত এখনও দরিদ্র কেন? ইংরেজ আমলের বহু আগে থেকেই আমাদের এখানে উত্তরাধিকার সূত্রে শাসন ক্ষমতা পরিচালিত হওয়ার (রাজরাজড়ার মাধ্যমে) ট্রাডিশন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও কী করে আমরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এত সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছি। অথচ এত শক্ত কাজ করতে পারলেও দেশের অর্থনীতিকে কেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ করতে পারিনি? না, ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বলা যাবে না কেন ১৩০ কোটি মানুষের দেশের পক্ষে ৭ কোটি মানুষের দেশব্রিটেনের জিডিপি-কে অতিক্রম করতে ৭২ বছর লাগল। এই সূত্রে প্রাচীন হিসেব মতো Hindu rate of growth হালে ১৯৯১ সালে শতকরা ২ থেকে ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ভারতে তবু দারিদ্র্য রয়েছে। এর মূল কারণ স্বাধীনতার পরের অসাধারণ অর্থনৈতিক নীতির অনুসরণ যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল রাজনীতির মিশেল। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসাকে কোনো উৎসাহ দেওয়া হয়নি। উৎসাহ দেওয়া হয়নি উদ্যোগপতি তৈরি করার ওপর আর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বিষয়টা তো ছিল সিলেবাসের বাইরে।
বহু ভারতীয় অত্যন্ত কম উৎপাদনশীলতার পরিবেশে কাজ করেন। কর্ণাটক উত্তরপ্রদেশের তুলনায় মাত্র এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা নিয়েও মাথাপিছু উৎপাদনশীলতায় এগিয়ে রয়েছে। দেশের ৫০ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ কৃষিকাজ করলেও সামগ্রিক জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে আই টি সেক্টরে মাত্র ০.৭ শতাংশ লোক নিযুক্ত থাকলেও জিডিপি-তে এঁদের অবদান ৮ শতাংশ। অন্যদিকে কলকারখানার ক্ষেত্রে আমাদের ৬ কোটি ৩০ লক্ষ উদ্যোগের মধ্যে মাত্র ১৯৫০০ কোম্পানির মূলধন ১০ কোটি, এখানেও কম উৎপাদনশীলতার বিষয়টি রয়েছে। অত্যন্ত উদ্বেগজনকভাবে আইটিআই থেকে প্রশিক্ষিত প্রয়োগকর্মীদের যাঁরা চাকরিতে ওপরে দিকে উঠেছেন তাদের ১০ শতাংশের মাইনে তথাকথিত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা যাঁরা সংস্থার নীচের স্তরে চাকুরিরত তাঁদের থেকে বেশি। অর্থাৎ প্রয়োগ কুশলতা বা উৎপাদনশীলতায় তারা পিছিয়ে আছে।
এই নিশ্চিত আয় প্রকল্পের ভাবনা স্ক্যানডিনেভিয় ছোটো ছোটো সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দেশ থেকে প্রভাবিত। মনে রাখতে হবে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের ব্যবসা পরিচালনার স্বাচ্ছন্দ্যের হিসেবে ১৯০টি দেশের মধ্যে ডেনমার্ক তিনে। নরওয়ে ৭ বা সুইডেন ১২ নম্বরে রয়েছে। তাদের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের সাফল্য অনেকটাই জড়িয়ে আছে সেখানকার মুক্ত অর্থনীতির ওপর। যেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ, আইন কানুনের প্রয়োগ ন্যূনতম। এই আইনি বেড়াজালের প্রভাব আমাদের কৃষিক্ষেত্রের দুর্দশার ওপরও পড়েছে। দেশে চাষিকে বাঁচাতে হলে তাদের একটা অংশকে কৃষিক্ষেত্র থেকেই তুলে নেওয়া জরুরি। কিন্তু অকৃষি ক্ষেত্রে কাজের পর্যাপ্ত সংস্থান না থাকাটা বড়ো সমস্যা।
ধনী দেশগুলির ক্ষেত্রে আয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হয় যাতে তারা দারিদ্র্যের জালে না পড়ে। কিন্তু ভারতের মতো দেশ যেখানে মানুষকে দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে নেওয়ার সফল প্রয়াস চলছে তা এখানে কখনই প্রয়োগ হতে পারে না। আমরা উৎপাদনশীলতার মানদণ্ডে পিছিয়ে। উপযুক্ত উপকরণও সব সময় উপলব্ধ নয়, তাই চোখ কান বুঝে পাশ্চাত্যের অনুকরণ আমাদের আধুনিক করে তুলতে পারে না। ১৯৫৫ সালে জওহরলাল নেহর বলেছিলেন আমাদের জাতীয় আয় না বাড়লে আমরা কিছুতেই কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারব না। আমাদের হাতে এমন সম্পদ নেই যে তা আমরা সকলের মধ্যে সহজেই বিতরণ করে দিতে পারে। হ্যা, কেবলমাত্র দারিদ্র্যই আছে যা ভাগ করে দেওয়া যায়। এই কারণেই আমাদের অর্থনীতির অভিমুখ এমনটাই হওয়া উচিত যা আমাদের দেশে প্রাচুর্য এনে দেবে।” এই বিশ্লেষণের নিরিখে তিনি বেঁচে থাকলে মেনে নিতেন যে প্রস্তাবিত ‘নিশ্চিত আয়’ প্রকল্পে ৪ লক্ষ কোটি টাকা ভরতুকি না কমিয়ে বা বিপুল মুদ্রাস্ফীতি না ঘটিয়ে বা আয় করের হার না বাড়ালে দেশের অর্থনীতির পক্ষে বড়ো বিপদ ডেকে আনবে।
দারিদ্র্য কিন্তু ক্যান্সার নয় যে প্রত্যেকটি দূষিত সেলকে বাদ না দিলে তা আবার ফিরে আসবে। বরঞ্চ দারিদ্র্যকে বেশি ওজনের লোকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ওজন কমানোর প্রক্রিয়াটা খুব কঠিন ও দীর্ঘকালীন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই জারি রাখলে ধীরে হলেও ওজন কমার মতো দারিদ্রও কমে আসবে। কালক্রমে খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম যেমন জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠে, শরীরকে স্বাস্থ্যবান করে তুলতে নানা কাজে সক্ষমতা এনে দেয়। দারিদ্র্য থেকে ধীরে নিজ প্রচেষ্টায় বেরিয়ে আসা মানুষও দেশের সম্পদ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখবে।
এ কাজে সাফল্য পেতে গেলে এমন একটা অর্থনীতি দরকার যেখানে পরিকাঠামো উন্নয়নে থাকবে গুরুত্ব, যা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সহায়ক হবে, মুদ্রাস্ফীতি থাকবে নিম্নমুখী, সরকারি নিয়মের বেড়াজাল শিথিল হবে, বাড়াতে হবে ফর্মাল সেক্টর, বৃদ্ধি ঘটাতে হবে করদাতার সংখ্যা, গড়ে তুলতে হবে আরও শহরাঞ্চল। অবশ্যই উৎপাদন ক্ষেত্র বাড়িয়ে। সেখানে নিয়োগ বড়ো গুরুত্বের। টাকা লেনদেনে digitisation কালোটাকা সৃষ্টিতে বড়ো বাধা হয়ে উঠবে। বলার বিষয় অনেক সেগুলিই উন্নত দেশের লক্ষ্যে অগ্রসরমান। একটি দেশের সামগ্রিক শাখা পরিচালনার অগ্রাধিকার।
আর একটা অদৃশ্যমান জিনিসকে ভুললে চলবে না। ভারতবাসী বিশ্বাস করে একটা সুস্থ কর্ম নিযুক্তি থেকে সে শুধু টাকা রোজগার করে না। সে রোজগার করে তার আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস, সৃষ্টি করে নিজস্ব পরিচয় ও বাড়তি দক্ষতা। তাই বিশাল সংখ্যক মানুষকে কর্মহীন রেখে তাকে দানের টাকা দিয়ে যাওয়া দেশ সম্পর্কে এক অন্তহীন আতঙ্কিত নিরাশার সৃষ্টি করবে। আর সেই অর্থে দেশের মানুষও তাদের আশাআকাঙ্ক্ষা নিয়েও বিশ্বব্যাপী হতাশাজনক ভাবমূর্তি তৈরি হবে। অবশ্যই এই চিত্রকল্প বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য উচ্চ যেথা শির’-এর কল্পনার সম্পূর্ণ বিরোধী। এ বিষয়ে নিরাশাবাদীদের কথাবার্তা কিন্তু আপনাদের হিতকারী বলে মনে হতে পারে, কেননা তাদের বক্তব্যে আপনাকে নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস আছে। কিন্তু আশাবাদীদের বক্তব্যে রয়েছে আপনাকে কোনো কিছু বিক্রি করার এককালীন কৌশল। আমার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন wall street কাগজের প্রথম পাতায় একবার বেরিয়েছিল ভারত যতটা না ইম্পোর্টেন্ট তার থেকে অনেক বেশি ইম্পোর্টেন্ট একটা দেশ। সেই সাংবাদিক নিশ্চিত তার এই খেলো মন্তব্য এতদিনে গিলে ফেলেছেন। সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক গতিবিধির অন্যতম সূচক। ‘শেয়ার বাজার’ যা ভারতে ডলারের নিরিখে নাগাড়ে সেরা বৃদ্ধির স্থান ধরে রেখেছে বিগত ২৫ বছর ধরে।
মনে রাখা দরকার, শেয়ার বাজার কিন্তু বর্তমানের থেকে ভবিষ্যৎকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ভবিষ্যতের সম্ভাবনাই তার কেনা-বেচা, লগ্নির মানদণ্ড। শেয়ার বাজার আশা করে ভারত বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধির অর্থনীতির গৌরব ধরে রাখবে। বিশ্বের অর্থনীতি বিশারদরা বুঝতে পারছেন উৎপাদনশীলতায় পিছিয়ে থাকাটা ভারতে এক যুগ বা এক শতাব্দীর বিষয় হয়তো ছিল কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাটা কিন্তু দেশের পক্ষে চিরস্থায়ী হতে চলেছে। অনতিবিলম্বে ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতির পরিধি জাপান, ফ্রান্স, জার্মানিকে অতিক্রম করে যাবে।
তাই আবারও বলছি পরিকাঠামো উন্নয়নে সরকার যে ভাবে লেগে আছে আরও দৃঢ়ভাবে তাতে মনোনিবেশ করাটাই হবে সুযোগের সদ্ব্যবহার। দয়ার দান দিয়ে মানুষকে চির কর্মহীন করে রাখাটা কোনো কথাই নয়।
মণীশ সাভারওয়াল
2019-05-03