১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হল। পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হল স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান। যার প্রধানমন্ত্রী হলেন দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক মহম্মদ আলি জিন্না। খণ্ডিত ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন জওহরলাল নেহরু। কট্টরপন্থী পাকিস্তান ও স্বার্থান্বেষী কংগ্রেস নেতৃত্বের জাঁতাকলে পড়ে রাষ্ট্র বা দেশ পেল না জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ। মহম্মদ আলি জিন্নার প্ররোচনায় পা দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নেতৃত্ব যুক্ত হতে চাইলেন না ভারতের সঙ্গে । পৃথক জম্মু-কাশ্মীরের দাবিতে তাঁরা গোঁ ধরে রইলেন। জিন্না বা জওহরলাল নেহরুর কাছে জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকদের দাবি দাওয়া কখনই তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার মধ্যে ছিল না। ধুরন্ধর এই দুই নেতার একমাত্র লক্ষ তখন প্রধানমন্ত্রিত্বের কুর্শি। উভয়েই তা হাসিল করতে সমর্থও হন। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যায়।
ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মতো অতি অযত্নে লালিত-পালিত হতে থাকলেন। তখন ‘না ঘর কা না ঘাট কা’ অবস্থা জম্মু-কাশ্মীরবাসীর। জম্মু-কাশ্মীরে বসবাসকারী হিন্দু্ নাগরিকদের মধ্যে চরম হতাশজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। পাকিস্তানের অংশ না হয়েও মহম্মদ আলি জিন্নার মুসলিম লিগ জম্মু-কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনবরত মাথা গলাতে থাকে। দেশীয় রাজ্য, অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীর তখন ব্রিটিশ অধীনস্ত স্থানীয় শাসকের নিয়ন্ত্রণাধীন ভূখণ্ড মাত্র। তখন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে শাসক হলেন মহারাজা হরি সিং। স্বাধীনতার আগে থেকেই জম্মু-কাশ্মীরে ইসলামিক মৌলবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। স্বাধীনতার পর তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। হিন্দুদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে মৌলবাদীদের অন্যায় আবদার ও বিভিন্ন ফরমান। সেই সময় ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য জম্মু-কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রবল দাবি জানায়। মহারাজা হরি সিং ভারতের দিকে পা বাড়াতেই পাক হানাদাররা জম্মু-কাশ্মীর আক্রমণ করে।
তৎকালীন দিল্লি সরকার মহারাজা হরি সিংকে বাধ্য করে শেখ আবদুল্লাকে জম্মু-কাশ্মীরের উজির-এ-আজম বানাতে।
স্বাধীনোত্তর ভারতর্ষে মুসলিম লিগের মধ্যে মহম্মদ আলি জিন্নার সব থেকে বড় প্রতিযোগী ছিলেন শেখ আবদুল্লা। জওহরলাল নেহরু যেভাবে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে মহাত্মা গান্ধীর আশীর্বাদে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তেমনি শেখ আবদুল্লাকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্শি থেকে দূরে রাখতে পৃথক জম্মু-কাশ্মীর ভূ-খণ্ডের দাবি খুঁচিয়ে তোলেন মহম্মদ আলি জিন্না। জম্মু-কাশ্মীরকে পৃথক রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন দেখান ধূর্ত জিন্না। শেখ আবদুল্লা সেই টোপও গেলেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যায়। জম্মু-কাশ্মীরকে কোনও ভাবেই পৃথক রাষ্ট্রের চেহারা দেওযা যে সম্ভব নয় তা বিলক্ষণ জানেন জিন্না। তাই ভারতবর্ষের সঙ্গে এবিষয়ে বিবাদ না বাড়িয়ে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খবরদারি চালাতে থাকে পাকিস্তান। শেখ আবদুল্লাও দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোকেই শ্রেয় মেনে নিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই মহারাজা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন তিনি। নিজেই নিজেকে ‘শের-ই-কাশ্মীর’ উপাধিতে ভূষিত করে মহারাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৯৪৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে রাজদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার হন তিনি। সে যাত্রায় মহারাজের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পান শেখ আবদুল্লা। কিন্তু মনে মনে হরি সিংকে মানতেই পারতেন না তিনি। জিন্নার সঙ্গে ফন্দি এঁটে জম্মু-কাশ্মীরে পাক হানাদার ঢুকিয়ে হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু করেন। হানাদারদের সঙ্গে পরে যোগ দেয় পাক সেনা। বেগতিক দেখে মহারাজ হরি সিং ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চান। হরি সিংয়ের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের মানুষকে খেপিয়ে তোলেন শেখ আবদুল্লা।
রাজদ্রোহিতার অপরাধে শেখ আবদুল্লাকে গ্রেফতার করেন মহারাজা হরি সিং। সেই সময় জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন সরকার চাইলেই নিঃশর্তে মহারাজা হরি সিংকে সেনা বাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে পারত। কিন্তু কট্টরপন্থী জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতাদের অন্যায় আবদার মেনে নেয় জাতীয় কংগ্রেস। শেখ আবদুল্লার নিঃশর্ত মুক্তির বিনিময়ে জম্মু-কাশ্মীরের মাটিতে প্রবেশাধিকার পায় ভরতীয় সেনা। ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেশন চুক্তির মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর দেশীয় রাজ্যকে সহযোগিতার অধিকার পায় ভারত। কিন্তু মহারাজা হরি সিংয়ের ক্ষমতা খর্ব করা হয়।
কংগ্রেস নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের জন্য মহারাজা হরি সিং চরম স্বার্থত্যাগ করেন।
পাক হানাদারদের অত্যাচারে জম্মু-কাশ্মীরের হিন্দু জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে খুন, জখম, রাহাজানি নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাজার হাজার হিন্দু মহিলাকে অপহরণ করে গণধর্ষণ করেছে পাক হানাদর ও উপত্যকার ইসলামি মৌলবাদীরা। শিশুদের হত্যা করেছে নির্মমভাবে। আনাজপাতির যোগান বন্ধ করে জম্মু-কাশ্মীরবাসীকে অভুক্ত মারার ষড়যন্ত্র রচনা করে পাকিস্তান সরকার। জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করেছিলেন হরি সিং। ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে ভারত সরকারের সঙ্গে ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেশন চুক্তি সাক্ষর করেন। জওহরলাল নেহরুর দাবি মেনে তিনি শেখ আবদুল্লার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। শেখ আবদুল্লাকে মুক্তি দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের এমার্জেন্সি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রমুখ ঘোষণা করেন। জম্মু-কাশ্মীরবাসীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে, তিনি এসমস্ত কিছু করতে সম্মত হন।
১৯৪৮ সালের ৫ মার্চ জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন শেখ আবদুল্লা।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু সরকারের চাপে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং শেখ আবদুল্লাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করতে বাধ্য হন। মহারাজা এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৯৪৮ সালের ৫ই মার্চ শেখ আবদুল্লার শপথ সমারোহের নির্দেশ জারি করেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের প্রমুখকে মুখ্যমন্ত্রী না বলে প্রধানমন্ত্রী বলা হত।
মহারাজা হরি সিং ভারত সরকারের আনুগত্য পালন করলেও জওহরলাল নেহরু অবশ্য সঙ্গ দেন শেখ আবদুল্লাকেই!
তৎকালীন দিল্লির সরকার অসহযোগিতা করে মহারাজাকে হতাশ করে তুলেছিল। শেখ আবদুল্লাকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করতে তাঁকে বাধ্য করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। মহারাজা হরি সিং আক্ষেপ করে বলেছেন “তাঁর পরিবারকে বন্ধক রেখে দিল্লির সরকার শেখ আবদুল্লাকে সঙ্গে নিয়ে যে নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতেছে, তাতে ভারতের আদৌ কোনও লাভ হবে কি?” “রাষ্ট্রসংঘে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেখ আবদুল্লা ভারতকে সহযেগিতার যে আশ্বাস দিয়েছে তাতে ভারতের স্বপ্ন পূরণ হবে কি?” ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেশন চুক্তি অনুযায়ী ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মীরে সেনা পাঠায় পাক হানাদারদের শায়েস্তা করতে।
পাকিস্তান সরকারও আন্তর্জাতিক সীমারেখা চুক্তি লঙ্ঘন করে জম্মু-কাশ্মীর ভূখণ্ডে ঢুকে হানাদারদের সাহায্য করে। ফলস্বরূপ প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সংগঠিত হয়। পাকিস্তান সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসঙ্ঘে আবেদন জানায় ভারতবর্ষ। পাকিস্তানের পক্ষে পাল্লা ভারী থাকায় রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে শেখ আবদুল্লার সমর্থন দিল্লির মান বাঁচাতে পারে, এমনই ভেবেছিল কংগ্রেস নেতৃত্ব। জওহরলাল নেহরু দ্বিপাক্ষিক বিষয়টিকে রাষ্ট্রসংঘে টেনে নিয়ে গিয়ে জম্মু-কাশ্মীর সমস্যাটিকে স্থায়ীরূপ দেন। সমস্যাটিকে আরও জটিল আকার দিয়ে আজকের বর্তমান সমস্যার জন্ম দিয়ে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রীই।