“ফাগুনে আগুন/চৈতে মাটি/বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি।” গ্রাম বাংলার একটি পরিচিত কৃত্য হল বাঁশ বাগানের মেঝেতে ফাগুনমাসের সন্ধ্যায় অগ্নিসংযোগ। শীতকাল থেকেই বাঁশঝাড়ের তলায় পুরু হয়ে থাকে পাতার রাশি। বাঁশবাগানে হাঁটলে পা দেবে যায়। তারই মধ্যেই খসখস আওয়াজ তুলে হেঁটে চলতে খুব পছন্দ করতাম। মা বলতেন, “ওদিকে যাস নে, চন্দ্রবোড়া সাপ থাকে।” বাঁশঝাড় পিট-ভাইপারের পছন্দের আস্তানা। গ্রামের ছেলের দল কিন্তু বাঁশবাগানে খেলে বেড়ায়। তার কারণ প্রতি বছর ফাগুনে আগুন জ্বালানোর বন্দোবস্ত করে সাপের চিরস্থায়ী বাসা ভেঙে ফেলা হয়।
বসন্ত ঋতুতে গ্রামাঞ্চলে সন্ধ্যা নামলেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে এক একটি বাঁশবাগান। গাঁয়ের মানুষ বলেন, বাঁশঝাড়ে পটাশ সারের চাহিদা নাকি এতে মেটে! বাঁশ পটাশ-প্রিয় গাছ। অযত্নে লালিত ঝাড়ে পটাশের সেই চাহিদা মেটাবে কে? ওই ইকোসিস্টেমে বর্ষাকালে পাতাপচে আপন মনেই সার হয়। আর বসন্তে পাতা পুড়িয়ে দিলে সারের যোগান বাড়ে। তারপর এক কোদাল, দুই কোদাল আশেপাশের মাটি তুলে দেওয়া হয় ছাইয়ের উপরে, বাঁশের গেঁড়োর গোঁড়ায়। দেখতে দেখতে তাগড়াই হয়ে ওঠে বর্ষার জল পেয়ে। এটা বাগানীদের দীর্ঘদিনের লোকজ্ঞান। খনার বচনে এভাবেই বাঁশঝাড় পরিচর্যার কথা আছে।
খড়দহের গ্রামাঞ্চলে বিশেষত কর্ণমাধবপুর গ্রামে প্রথম দেখেছিলাম এই কৃত্য। তখন হায়ার সেকেন্ডারিতে পড়ি। অচেনার আনন্দ তখন পেয়ে বসেছে আমাদের। রোজই নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কার করি। রোজই নতুন মানুষের সঙ্গে মিশি। প্রকৃতির কোলে চড়ে বসি অনবধানে। সাইকেল চালিয়ে মাঝ বসন্তের বিকেলে ঘোরাঘুরি করলেই, কোনো না কোনো ঝাড় জ্বলে উঠতে দেখতাম ফিরতি সন্ধ্যায়। আমরা ক’জন বন্ধুর নেশা ছিল লোকসংস্কৃতির গ্রামীণ ঝাঁপি খুঁজে বেড়ানো।
দোলপূর্ণিমার আগের দিন হিন্দু কিশোর-কিশোরীরা চাঁচড় বা বুড়ির ঘর পোড়ায়। মনে হত এও তেমনই এক প্রাচীন সান্ধ্য-কৃত্য। হোলিকাসুর বধ হয়তো অনেক পরের ঘটনা। আজ এ বাগান, কাল সে বাগান পোড়ে গ্রাম বংলায়। কিছু কঞ্চি-বাঁশ হয়তো পুড়ে যায়, গৃহস্থও সজাগ থাকেন। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজনে পুকুরের জল ব্যবহার হয়।
আমরা দোলের আগের দিন ন্যাড়াপোড়া করতাম, কোথাও একে ‘চাঁচড়’ বলে। বলে ‘বুড়ির ঘর’ পোড়ানো। পাড়ার দিদা-ঠাকুমাদের চোখে জল আসে সেদিন। অনেকেই পূর্ব পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। তাদের চোখের সামনেই খড়ের বাড়ি, দড়মার বেড়া, শোবার ঘর পুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছে এক একটি বীভৎস আক্রমণে। গতযৌবননা ছিন্নমূল উদ্বাস্তু রমণীরা আরও একপ্রস্ত কেঁদে নেন লুকিয়ে। জানি না, এর কোনো ফাইল প্রকাশিত হবে কিনা! তবে ছোটোরা এটা জানি, বাঁশপাতা আর কঞ্চি সাজিয়ে দারুণ ‘বুড়ির ঘর’ তৈরি হয়। দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় শুকনো নারকেলের পাতা, সুপারির খোলাসহ পাতা, আম-জাম-পেয়ারা পাতার স্তূপ, শুকনো কচুরিপানার ভাঁড়ার। নেড়াপোড়ার বহ্নিসজ্জা রীতিমতো পাহারা দিয়ে রাখতে হত আমাদের। এই পাহারা দুর্বলচিত্তের কাজ নয়। কারণ পাড়ার দুষ্টছেলের কাজই ছিল চুরি করে অন্যের চাঁচর জ্বালিয়ে দেওয়া। কোনো কোনো জায়গায় এই চুরির নাম বলা হত ‘যওন-জ্বালি’। এই ‘যওন’ কথাটি কী থেকে এসেছে ভাষাবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। অনেক সময় জোর করে চাঁচর জ্বালানো নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় অশান্তি হতো৷
তবে আনন্দের ঘাটতি থাকতো না মোটেই। চাঁচর জ্বলছে। ক্যাম্প-ফায়ারের মতো তার চারপাশে গোল হয়ে আয়োজকেরা দাঁড়িয়ে আছি। পূর্ণিমার চাঁদ আরও উজ্জ্বল, আরও মোহময় হয়ে উঠছে। হাততালি দিয়ে ছড়া কাটছি, “আজ আমাদের নেড়াপোড়া/কাল আমাদের দোল/পূর্ণিমার ওই চাঁদ উঠছে/বলো হরি বোল।” সমবেত কণ্ঠে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে আবারও বলি “হরি বোল। হরি বোল।” হরির মাধুর্য কিশোর কিশোরীর অন্তঃকরণে তখন টানাটানি করছে আবেগে। আগুনের আলো, পুবে পূর্ণশশী — এক অসামান্য ঐশী পরিবেশ। পরের দিন দোল। খেলার আয়োজন-পরিকল্পনা নিয়ে তাই আমরা আবারও মশগুল হই। আরেকপ্রস্ত আলোচনা চলে।
আজ ভেষজ আবীর নিয়ে হৈচৈ হলেও, চার দশক আগে আমরাই বাড়িতে ভেষজ আবীর বানিয়েছি কত! অভাবের সংসারে ওটুকু রঙ-আবীর সংগ্রহ করা তখন কঠিন হয়ে পড়তো। সরস্বতী পূজায় কাঁচা হলুদ, নিম, মুসুরি ভেজানো বেটে, তেল মিশিয়ে সারা গায়ে মেখে তবে স্নান করতে যেতাম। তখনই আইডিয়া হল, হলুদ-বাটা বেশ মানানসই রঙ। বেটে নিতাম শ্বেত আর রক্ত চন্দন, ওগোলো ছিল সুগন্ধি। নানান রঙের গাঁদার পাপড়ি, নীলকণ্ঠ, অতসী, কল্কে পাপড়িও বেটে নিতাম। পাপড়িড মণ্ডে আঠালোভাব আনতে তরি-তরকারির খোসার আঠা মিশিয়ে দিতাম। যেমন ঝিঙে, পটল, লাউ, শশা ইত্যাদির বোটার কাছটি কেটে নিলেই আঠা বেরিয়ে আসতো। আমরা চামচ দিয়ে চেঁচে নিতাম। একটি থালার মাঝে রেকাবিতে রাখা থাকতো সামান্য আবীর। বাকী ছোটো গোল বাটিতে উদ্ভিদ-মণ্ডগুলি সাজিয়ে নিয়ে দোল খেলতে বেরোতাম। দুষ্ট ছেলেরা হাসে৷ পাড়ার দিদিরা নিজেরাই এসে মেখে নেন ভেষজ আবীর। আর আমাদেরও বেশ করে মাখিয়ে দিয়ে যান। বলেন, “এই তো, রূপচর্চা হয়ে গেলো। এরপর যা বাঁদর রঙ খেলা হবে, তা এই মণ্ডের উপরই তো পড়বে। চামড়ার ক্ষতি হবে না কোনো।
আজকাল আমার কথা শুনে অনেকে গ্রামেগঞ্জে ভেষজ আবীর বানান। তাদের মূল উপাদান হচ্ছে লাল ও হলুদ পলাশের পাপড়ি, লটকনের পাকা বীজ, কমলা আর বাসন্তী গাঁদার পাপড়ি। বাজার থেকে আনা হয় ট্যালকম পাউডার। অনেক বুনো গাছের কাণ্ড-ছাল সেদ্ধ করলেও রঙ নির্গত হয়। তা ফুটিয়ে ঘন করে তাতে মেশানো হয় পাউডার। এরপর রোদে শুকিয়ে জল দূর করা হয়। পড়ে থাকে রং-বেরঙের আবীর। আতপ চাল পুড়িয়ে বা নেড়াপোড়ার ছাই সংগ্রহ করে আমরা কালো রঙ বানাতাম। অনেক পাকা বুনো ফলের থেকেও রঙ বের করতাম। কোনোটা বেগুনী, কোনোটা লাল, হলুদ।
নেড়াপোড়া হবার আগে আমরা বালতি করে জল রেডি রাখতাম। শেষে বাঁশ পিটিয়ে, জল দিয়ে আগুন নিবিয়ে দিতে হতো। আর খোঁজা হত মাটির হাড়িতে রাখা আলু-রাঙাআলু-কচু-খামালু। ওসব খোসা ছাড়িয়ে সৈন্ধবলবণ, লঙ্কা আর সরষের তেলে মেখে সমবেতভাবে খাওয়া হতো৷ পরদিন পাড়ার গরীব মানুষের ন্যাড়াপোড়া-স্থল থেকে সংগ্রহ করতে আসতেন কাঠকয়লা। আমরাও সকালে দোল-পরবর্তী রঙ খেলার কালি-ভূষো রঙ বানানোর জন্য ছাই সংগ্রহ করতাম।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।