আটজন বেশ মোটাসোটা পালোয়ান লোককে সঙ্গে নিয়ে, জেল সুপার, ডাক্তার, জেলের সেলে মধ্যে ঢুকলেন | কিছু বুঝতে না বুঝতেই ওই আটজন লোক, সাতদিন ধরে না খাওয়া দুর্বল মানুষটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল | দুজন দুটি হাত, দুজন দুটি পা এবং দুজন পুরো শরীরটা চেপে ধরল। এছাড়াও একজন মাথা ও অন্যজন চিবুক ধরে জোড় করে হা করাল। সেই সুযোগে ডাক্তার একটি সরু নল দিয়ে দুধ ঢালতে শুরু করলেন। আর কোনো উপায় না দেখে ওই মহান মানুষটি তাঁর আমরন অনশনকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছাকৃতভাবে জোরে জোরে কাশতে থাকলেন, এটা ভেবে যে, যদি কোনোভাবে ওই দুধ ভর্তি নলটি খাদ্যনালী থেকে সরে গিয়ে শ্বাসনালীতে চলে যায় | দুধ ফুসফুসে চলে গেলে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে কিন্তু তিনি সংকল্পে অটুট | যেমন ভাবা তেমন কাজ, আরও জোরে জোরে কাশতে থাকলেন, ফলে কিছুটা দুধ ফুসফুসে ঢুকেও গেল এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ফলে তাঁর আমরন অনশন বজায় থাকল।
৪৮ ঘন্টা ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করার পর, মানুষটির জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলতেই তিনি লক্ষ করলেন-
তাঁকে প্রলুব্ধ করার জন্য তাঁর সেলে নানা ধরনের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এদিকে নলটি জোড়পুর্বক খাদ্যনালী থেকে শ্বাসনালীতে ঢুকে যাওয়ায় তাঁর গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না |তিনি বুঝতে পারলেন সারাজীবন তিনি আর কোনোদিন কথা বলতে পারবেন না।
স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর পাশে রাখা রয়েছে একটি শ্লেট আর পেনসিল | জেল সুপার বললেন,
— আপনার কি খেতে ইচ্ছা করছে ওই শ্লেটে লিখে দিন। আপনার যা ইচ্ছা তাই খেতে পারেন।
যে মানুষটি ছোটোবেলা থেকে খেতে ভালবাসতেন, পকেটে পয়সা থাকলেই বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে খেতে যেতেন, সেই মানুষটিই নয় দিন অভুক্ত থেকেও তাঁর সামনে পরে থাকা তার পছন্দের খাবারগুলির দিকে তাকিয়ে শুধু একবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন। কোনো কিছুই মুখে তোলেননি |
জেল সুপার তার ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন, তাকে কিছু বুঝিয়ে-সুজিয়ে খাওয়ানোর জন্যে। কিন্তু তাঁর অদম্য জেদ, তাঁর ইচ্ছা শক্তি, আর অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কাছে সবাই হার মানল। এইভাবেই চলতে থাকল তাঁর আমৃত্যু অনশন |
আস্তে আস্তে তাঁ শরীর সবদিক থেকে ভেঙে পরছে, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন, একটু একটু করে পক্ষাঘাত তাঁর শরীরকে গ্রাস করে ফেলছে। যেদিন ওই পক্ষাঘাত হৃদযন্ত্র স্পর্শ করবে সেদিন তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। ভয় পেয়ে জেলার তাঁকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে রাজী হয় কিন্ত বেঁকে বসেন পাঞ্জাবের গভর্নর মোরেন্সী।
পরের দিন জেল সুপার, ডাক্তার ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে তার সেলে ঢুকলেন। তখন তাঁকে ঘিরে ব্যারিকেড করে শুয়ে রয়েছেন তাঁর সহযোদ্ধারা। ডাক্তার বললেন- “কোনো ভাবেই উনাকে উত্তেজিত করা যাবেনা, তাহলেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাবে।” তাই জেল সুপার আর কোনো চেষ্টাই করেন নি।
পরের সাতদিন গোটা ভারতবর্ষের মানুষ দারুন উদবেগ ও উৎকন্ঠায় দিন কাটাতে থাকলেন। অবশেষে এলো সেই ভয়ংকর দিনটা- ১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর | শনিবার | ঠিক দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে অমর বিপ্লবী যতীন দাস ৬৩ দিন অনশনের পর লাহোর জেলে মাত্র ২৪ বছর বয়সে চির নিদ্রায় ঢলে পড়লেন।
#
১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে ২৭শে অক্টোবর কলকাতার শিকদার বাগানে মাতুলালয়ে জন্ম যতীন দাসের। পিতা বঙ্কিমবিহারী দাস এবং মাতা সুহাসিনী দেবীর প্রথম সন্তান যতীন | বাবার আদরের খেদু | যতীন যেমন মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তেমনি শারীরিক দিক থেকেও ছিলেন বলিষ্ঠ। কুস্তির আড্ডায় যাওয়া, ফুটবল খেলা, নিয়মিত ব্যায়াম অনুশীলন করা – এগুলো তাঁর রুটিন ছিল। মাত্র ৯ বছর বয়সেই মাতৃহারা হন যতীন। বাবার কাছেই তাঁর আদরের খেদু শুনত ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী , কানাইলাল দত্ত , সত্যেন্দ্রনাথ বসুদের গল্প | ছোট্ট খেদুর মনে এইসব ঘটনা ভরে দিয়েছিল দেশপ্রেমের চেতনা |
ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশান থেকে ১৯২১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন প্রথম বিভাগে। সে সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন গান্ধীজি। যুগের দাবীতে স্বাভাবিকভাবেই যতীন দাসও এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। দোকানে পিকেটিং করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ছয় মাস কারাদন্ড ভোগ করতে হল। মেয়াদ পূর্তির আগেই ছাড়া পেয়ে যতীন আবার কংগ্রেসে যোগ দিলেন। বাবা এ সময় কড়াভাবে পড়াশুনো ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করলে ষোল বছরের যতীন দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, “পড়াশুনো নিশ্চই করব, কিন্তু দেশের কাজের ডাক এসেছে যখন, সে কাজ ছাড়তে পারবো না”।
বাবা রেগে গিয়ে বেরিয়ে যেতে বললে, তিনি এক কাপড়ে দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস অফিসে গিয়ে উঠেছিলেন। এই সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌছেছিল। কিন্তু চৌরিচৌরার সামান্য একটা ঘটনাকে অযুহাত করে গান্ধিজী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে হতাশ যতীন গান্ধিজীকে আর নির্ভরযোগ্য নেতা মনে করতে পারেন নি। তিনি বাড়ি ফিরে এলেন।
#
এরপর যতীন অনুশীলন সমিতির সাথে জড়িত হন । তখন তিনি বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র | ১৯২৫ সালে প্রথম পুলিশের নজরে আসেন এবং তাকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ জেলে পাঠানো হয় । জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের পথে বিশ্বাসী হন এবং গোপনে আয়ত্ত করেন বোমা বানানোর কৌশল ।
ভবানীপুরের গিরীশ মুখার্জী রোডের একটি বাড়িতে থাকাকালিন যতীন কাছেই সুবার্বান রোডের জনৈক দেবেন বোসের বাড়িতে নিয়মিত যেতেন। এখানেই তিনি পরিচিত হন রাসবিহারী বসুর শিষ্য বিপ্লবী নেতা শচীন্দ্র নাথ সান্যালের সঙ্গে। ইস্পাত কঠিন দৃঢ় মানসিকতার যতীন দাসকে চিনতে ভুল করেননি বিচক্ষন শচীন সান্যাল। তাঁর গড়া হিন্দুস্থান রিপাবরিক্যান এ্যাসোসিয়েশনে কুড়ি বছরের যুবক যতীনকে অন্যতম সহকর্মী হিসেবে তিনি টেনে নেন।
ইতিমধ্যেই হিন্দুস্থান সোসালিষ্ট রিপাবরিক্যান এ্যাসোসিয়েশনে এর বিপ্লবীরা লাহোর, দিল্লী ও সাহারাণপুরে গোপন অস্ত্র কারখানা তৈরি করে ফেলেছিল, উদ্দেশ্য ভগত সিংহের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বৃটিশরাজ উৎখাত! সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল কিন্ত এক সহযোদ্ধার ভুলে পুলিশ জেনে ফেললো তাদের গোপন কারখানার খবর । যৌথ তল্লাশি চলল তিন জায়গাতেই | ১৪ই জুন ১৯২৯ ধরা পড়েন যতীন । দিল্লীতে বোমা ফেলার সময় আগেই ধরা পড়েছিল ভগৎ আর বটুকেশ্বর, মোট চুয়ান্ন জন অভিযুক্তকে নিয়ে শুরু হল লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা, অভিযোগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘোষিত লড়াই ।
#
লাহোর জেলে সবাইকে রাখা হলো পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গে । অবর্ণনীয় সেখানকার পরিবেশ, রান্নাঘরে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে টিকটিকি আরশোলা ইঁদুর সেই সাথে অখাদ্য খাবার । কয়েদীদের না আছে কাপড় কাচার সুযোগ না তাদের দেওয়া হয় কোন বই বা পত্রিকা । অথচ পাশের ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডে ভি আই পি ব্যবস্থা । এরই প্রতিবাদে যতীন শুরু করেছিলেন অনশন ।
যতীন দাস– ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়। ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে’ তিনি পরাধীনতার অন্ধকারকে ঘোঁচাতে চেয়েছিলেন, তার খবর আমরা ক’জন রাখি? আজ তিনি নেই, কিন্তু রয়েছে তাঁর আদর্শ।