ঠিক যেন এক দস্যি ছেলের দামালপনার পর শান্তি নেমে এসেছে চারদিকে। জাতপাত-ধর্ম-বিদ্বেষ-সাম্প্রদায়িকতার আঁচে নির্বাচনী উত্তাপ যখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময়ে প্রলয়ের ঘণ্টাধ্বনি শিখিয়ে দিয়ে গেছে প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটা অসহায়, অক্ষম। প্রলয়কে রোখা সম্ভব নয় ঠিকই, তবে হাতে-হাত মিলিয়ে একজোট হয়ে তার প্রকোপ থেকে একে অপরকে রক্ষা করাটা হয়তো অনেকটাই সম্ভব। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব লক্ষ লক্ষ মানুষের। দেশের পূর্ব উপকূলের এই ছোট্ট রাজ্য সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে।
১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনের পরে ঝড়ের এমন ধ্বংসলীলা দেখল ওড়িশা। আবহাওয়া দফতরের হিসেব বলছে এত ভয়ঙ্কর মাত্রার ঘূর্ণিঝড় গত ২০ বছরে এই এলাকায় হয়নি। ‘এক্সট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ ফণী যখন তার ফনা তুলে উপকূলে আছড়ে পড়ছে, তখন তার রূপই অন্য। খেলনার মতো ভেঙে পড়ছে মোবাইলের টাওয়ার, তাসের ঘরের মতো ভেঙেচুরে যাচ্ছে কাঁচা ঘরের দেওয়াল থেকে পাকা বাড়ির জানলার কাঁচ, ছাদের অংশ। বিশাল ঢেউ তুলে সমুদ্র ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট। উপড়ে পড়ছে বিদ্যুতের খুঁটি, ইটের বড় চাঙড় উড়ে এসে পড়েছে গাড়িতে। সর্বত্র শুধু ধ্বংসস্তূপ!
ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। এই দামাল ঝড়ের এক একটা ঝাপটায় লণ্ডভণ্ড হযে গেছে রাজ্য। তছনছ হয়ে গেছে মন্দিরনগরী পুরী। তবে প্রাণহানি রোখা গেছে অনেকটাই। কারণ এই দীর্ঘ ২০ বছরের জার্নিতে ওড়িশা অনেকটাই পরিণত। মৃত্যুর যে নির্মম রূপ এককালে সে দেখেছে, তার আর পুনরাবৃত্তি হতে দেয়নি সে। আগেভাগেই কোমর কষে নেমে পড়েছিলেন প্রশাসনিক কর্তা, আবহাওয়াবিদ থেকে স্থানীয় মানুষজন।
ফণীর ‘ল্যান্ডফল’ যে পুরী, তার সতর্কবার্তা আগেই দিয়েছিলেন আবহাওযাবিদেরা। পাশাপাশি উপকূলবর্তী শহর ভুবনেশ্বর, কটক, জাজপুর, ভদ্রক-সহ সর্বত্রই জারি হয়েছিল সতর্কতা। ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রস্তুতির অভাব ছিল না। ফণী ছোবল মারার ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকেই তৎপর ছিল প্রশাসন। প্রায় ১১ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিরাপদ স্থানে। সতর্কতার জন্য রাজ্যের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। বিপর্যয় মোকাবিলা দল, স্বেচ্ছাসেবী শিবির মিলিয়ে প্রস্তুত ছিল ৪৩,০০০ মানুষ, অন্তত হাজার খানেক লোককে আপৎকালীন অবস্থার জন্য তৈরি রাখা হয়েছিল। পুলিশ, নৌসেনা, হেলিকপ্টার উড়িয়ে বায়ুসেনা, উপকূলরক্ষী বাহিনী ঘিরে রণসাজে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি ছিল তুঙ্গে।
ফণীর তাণ্ডব ওড়িশায়:
সামুদ্রিক ঝড়ের মোকাবিলা কী করে করা যায়, তার জন্য দফায় দফায় হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আগেই জানিয়েছিলেন, দুর্যোগের পরে ত্রাণ ও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে আগাম ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ঝড় আছড়ে পড়ার আগেই প্রায় ৯০০টি আশ্রয় শিবির তৈরি রেখেছিল জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল (এনডিআরএফ)। আগে থেকেই বন্ধ করা দেওয়া হয়েছিল রেল যোগাযোগ, তালা পড়ে গিয়েছিল বিমানবন্দরেও। ফণীর মোকাবিলায় রাজ্যবাসীর স্লোগান ছিল, “ঝড় আসছে। কিন্তু ভয় পেও না তোমরা। শুধু সাবধান থাকো। দেখো আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।”
“আমরা পেরেছি। খুব কম জায়গায় এমন উচ্চস্তরের প্রস্তুতি দেখা যায়,”বলেছেন প্রাক্তন নৌসেনা কর্মী অভিজিৎ সিং। তাঁর কথায়, ঘণ্টায় ১৭৫-২০০ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় যখন স্থলভূমিতে উঠেছিল, তখন প্রশাসনিক নির্দেশ মেনেই রাস্তায় বার হননি কেউই। হাতে গোনা মানুষজন আর গাড়ি চলতে দেখা গেছে রাস্তায়।
আবহাওয়া দফতরের হিসেব অনুযায়ী, ঠিক আটটা নাগাদ চারদিক লন্ডভন্ড করে দিয়ে পুরো শক্তি নিয়ে পুরীতে থাবা বসায় ফণী। চারদিকে তখন শুধু বালির ঝড় আর বৃষ্টি। খড়কুটোর মতো সব কিছু হাওয়ায় এদিক ওদিক ভাসছে। ভুবনেশ্বরে ঝড় গতি ছিল ১৪০ কিলোমিটার গতিতে। পরে কটক ও জাজপুরের কাছে সেই গতি কমে ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। ওড়িশার স্পেশাল রিলিফ কমিশনের সূত্র অনুযায়ী, শনিবার পর্যন্ত মোট ১৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। জলে প্লাবিত হয়ে রয়েছে নীচু এলাকাগুলি। বিদ্যুৎ ও মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক জানিয়েছেন, দ্রুত মেরামতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে দিন-রাত কাজ করছেন কর্মী ও ইঞ্জিনিয়ারেরা।
ওড়িশার স্পেশাল রিলিফ কমিশনার বিষ্ণুপুরা শেট্টির কথায়, “এই দুর্যোগের মোকাবিলা করা ছিল আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ, কমিটমেন্ট। আমরা ঠিক করেছিলাম একটাও প্রাণহানি হতে দেওয়া যাবে না। সেদিক থেকে আমরা অনেকটাই সাফল্য পেয়েছি।”
একতা। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। সেখানে নাক গলাতে ভয় পেয়েছে ঝড়ের ভ্রুকুটিও। তছনছ হয়েছে শুধু বাইরেটা, সেটা খুব দ্রুত সামলে উঠবে বলেও জানিয়েছে ওড়িশা প্রশাসন। ভারতের আবহাওয়া দফতরের নির্ভুল তথ্য এবং আগাম সতর্কতাকে কৃতিত্ব দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জও। তাদের তরফে বলা হয়েছে, বিপর্যয়ের ঝুঁকি আগে থেকে বুঝতে পারাই শুধু নয়, তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে ওড়িশা। একটা ছোট্ট রাজ্য, যেখানে অধিকাংশ মানুষই দারিদ্যসীমার নীচে। পর্যটনকে কেন্দ্র করেই প্রাণ পায় রাজ্যের উপকূলবর্তী শহরগুলি, সেখানে নিরাপত্তার এমন বজ্র বেষ্টনী ও প্রশাসনিক তৎপরতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এই প্রয়াস হার মানিয়ে দেয় যে কোনও শক্তিশালী ও বিত্তশালী রাষ্ট্রকেও।