চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস- হিন্দুদের বিরুদ্ধে ১৬ ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিলেন জিন্না

দাঙ্গা দাঙ্গা আর দাঙ্গা !!
হিন্দুর খুনে চাঙ্গা –
সেকুলার সুরাবর্দী তোমরা এমনই নাঙ্গা ?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন সবেমাত্র শেষ হয়েছে৷ এদেশের বাতাসে তখন আসন্ন স্বাধীনতার ঘ্রান।  বহুইপ্সিত সেই স্বাধীনতা এল বটে, তবে তা দেশকে খন্ডিত করার বিনিময়ে । ভারত আবার বিভাজিত হল । পুর্ব আর পশ্চিম বাংলা পৃথক হয়ে গেল। সেই বিভাজনের আগের কথা…..
জিন্নাকে প্রথম মুসলিমদের জন্য পৃথক আবাসভূমি পাকিস্থানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন রহমত আলী। জিন্না প্রথমে তার বাস্তবতা অস্বীকার করলেও পরে পাকিস্থান রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে আগুয়ান হন। এই দেশভাগের পটভূমি তৈরি হচ্ছিল অনেকদিন আগে থেকেই৷ দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ভারত ভাগ হয়ে তৈরি হোক পাকিস্তান, এই ছিল জিন্না-র প্রস্তাব৷
মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়
জিন্না বল্লেন আমি নীতিকথা বুঝিনা। হাতে বন্দুক আছে তরবারি আছে আর তার ব্যবহারও জানা আছে। কল্পনার আসমানি রং নয় হিন্দুর খুনে হাত লাল করতে হবে । সামনে নতুন ভোর।
কলকাতার ময়দানে জমায়েত হলো প্রায় পঞ্চাশ হাজার সস্শত্র মুসলিম জনতা । মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকে ক্ষেত্র প্রস্তুত ।হিন্দুদের বিরুদ্ধে সরাসরি জেহাদের ডাক দেওয়া হলো । মঞ্চে আসীন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ হোসেন শহীদ সুরাবর্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন , আবু হাসেন, তফসিলি মোর্চার যোগীন্দ্রনাথ মন্ডল। সুরাবর্দী মুসলিম জনতার উদ্দেশ্যে বল্লেন “পুলিসকে সংযত করা হয়েছে। ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে যা করতে পারিস কর।”
এই ভাবেই হিন্দু নিধনের পটভূমি রচিত হলো। খোদ কলকাতার বুকে ১৯৪৬ এর ১৬ই আগস্ট জাতি দাঙ্গায় যে নারকীয় হত্যালীলা সংঘটিত হয়েছিল তাতে বেধোরে প্রাণ দিতে হয়েছিল শত শত নিরপরাধ নরনারীকে। এর ভয়াবহতা ও বিভীষিকা বোধহয় জিন্নারও কল্পনায় ছিল না। উস্কানিমুলক “Direct Action Day”র ডাক দেবার মাধ্যমে আন্দোলন করার প্রস্তাব দিলেন।


১৬ অগস্ট ১৯৪৬৷ দিন শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে মারদাঙ্গার খবর আসতে শুরু করল৷
“দীর্ঘ ছুরিকার সপ্তাহ” (“The Week of the Long Knives”) নামে পরিচিত কুখ্যাত সপ্তাহকালের প্রথম দিনটি ছিল ১৬ অগস্ট ১৯৪৬।
প্রথম ছুরিকাঘাত করা হয় ভোর পাঁচটার আগে প্রাতভ্রমনে বের হওয়া এক হিন্দু পুরুষকে।এরপর সকাল ছটার পরেই অসংখ্য মুসলমান আক্রমণ করে মানিকতলা বাজার, হিন্দুদের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুন্ঠন হতে থাকে।এরপর দুজন হিন্দু মহিলা মুসলমানদের হাতে আক্রান্ত হন আর এক হিন্দু পুরুষ ছুরিকাঘাতে নিহত হয়।
বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে কলকাতা কার্যত অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল৷ পথে বিপথে প্রান্তরে পড়ে রইল অগুন্তি লাশ । দিনের শেষে পাল্টা প্রতিরোধে নামল হিন্দু মহাসভাও৷ শহরজুড়ে শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা৷ পরের দিন স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রথম পাতায় বড় করে শিরোনাম : গ্রেট ক্যালক্যাটা কিলিংস৷ দাঙ্গা চলতে থাকল টানা কয়েকদিন৷ কমপক্ষে দশহাজার মানুষ নিহত হলেন, জখম হলেন অসংখ্য । আর মায়েরা হলেন গনধর্ষিতা ৷ সুরাওয়ার্দি পুলিশের রাশ টেনে রেখেছিলেন, সেনার সাহায্য চাইতে দেরি করেছিলেন এবং পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে তাঁর দুর্বৃত্ত অনুচরদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে সুযোগ করে দেওয়া হল।
কিন্তু কেউই বুঝতে পারেননি যে ঐ দিনটিই অগনিত নিরীহ নিস্পাপ হিন্দুদের রক্তের লালে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা কালো দিনের দলিল হয়ে থাকবে।

কলকাতার পথে ঘাটে তখন শুধুই লাশের পাহাড় ….শকুন আর শকুনের লোলুপতা।

মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আছিলায় যুদ্ধর নেশা আর রক্তের স্বাদে মৌলবাদীদের প্রত্যক্ষ মদত দিয়েছিলেন জিন্না থেকে সুরাবর্দী সকলেই।

ঘটনার আগেই স্টেটসম্যান পত্রিকায় সুরাবর্দী লিখলেন, “হিংসা এবং রক্তপাত অন্যায় নয়, যদি তা মহৎ উদ্দেশ্যে করা হয়। মুসলমানদের কাছে আজ পাকিস্তান আদায় করা ছাড়া অন্য কোন প্রিয় কাজ নেই।” পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম ইনস্টিউটে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডদের এক সমাবেশে বলেন, “মুসলিম লীগের এটা পরম সৌভাগ্য যে, এই রমজান মাসেই সংগ্রাম শুরু হবে। কারণ এই রমজান মাসেই জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লা।” ঐ সময়েই কলকাতার মুসলমান মেয়র ওসমান খান তরোয়াল হাতে জিন্নার ছবিসহ উর্দুতে একটি প্রচারপত্র বিলি করেন যাতে লেখা ছিল, “আশা ছেড়ো না, তরোয়াল তুলে নাও, ওহে কাফের, তোমাদের ধ্বংসের দিন বেশী দূরে নয়।” এ ছাড়া মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে হিন্দুদের কিভাবে ধ্বংস করা যাবে সেই রকম ২৩দফা নির্দেশ সংক্রান্ত একটি লিফলেট বিলি করা হয়। রাজনৈতিক উসকানির প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি আঙুল ওঠে দাঙ্গার রূপকার সুরাওয়ার্দির দিকে।
আচমকা মুসলিম লীগ ১৬ই আগস্ট বাংলা বন্ধের ডাক দেয়, আর সুরাবর্দী ঐ দিন ঘোষণা করেন সরকারী ছুটি যাতে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে মুসলমানরা হিন্দুদের সংহার করতে পারে ও অবাধ লুঠতরাজ করতে পারে।

বন্ধ শান্তিপূর্ণ হবে বলে জিন্না ও মুসলিম লীগ গান্ধীজিকে মিথ্যা প্রতাশ্রুতি দিয়েছিলেন।
১৫ই আগস্ট রাতে সমস্ত মসজিদে মুসলমানদের জড় করা হয়েছিল। ভোরের নামাজ শেষে খোলা তরবারি হাতে মুসলমানাদের রাস্তায় আক্রমন করতে পাঠানো হলো। হাওড়ার দিক থেকে কাতারে কাতারে মিছিল আসতে শুরু করলো, মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবাঙ্গালি মুসলমান গুণ্ডারা চৌরঙ্গী, চিৎপুরে, বৌবাজারে জড়ো হওয়া মুসলমানদের সঙ্গে মিশে গেলো। শুরু হলো গনহিন্দুহত্যা লীলা কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের হিন্দুপাড়ায়। মধ্যবিত্ত হিন্দু বাড়িগুলিতে নৃশংস হত্যালীলা চলতে থাকে।
বীভৎস আর নৃশংস সেই দৃশ্যর প্রমান মেলে রাজাবাজারে।হাত পা কাটা হিন্দু মেয়েদের চুল বেঁধে সব ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সপ্তাহব্যাপী দাঙ্গা চলতে থাকল। হাজারে হাজারে মানুষ নিহত হলেন,আহত হলেন অজস্র আর শত শত মহিলারা ধর্ষিতা হলেন।
১৬ই আগস্টের পরের দিনগুলোতেএ একইভাবে হিন্দুদের হত্যা, মেয়েদের ধর্ষণ, প্রাণের ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তর ,অগ্নি সংযোগ এবং লুঠতরাজ অবাধে চলতে থাকে। বাংলা ছবির কিংবদন্তি অভিনেতা ছবি বিশ্বাস কলকাতার মুসলমানপাড়া পার্ক সার্কাসে থাকতেন। তাঁর বাড়ীতেও অবাধ লুঠ হয় ও যথাসর্বস্য খেয়া যায়। গণিতসম্রাট যাদব চক্রবর্তী, রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক বা ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস.এন. মুখার্জি কাউকেই রেহাই দেওয়া হয়নি । পার্ক সার্কাস থেকে শুরু করে বেলেঘাটা মেন রোড, চিৎপুর, কলুটোলা, নারকেল ডাঙ্গা, মেটিয়াবুরুজ সর্বত্র অতর্কিতে বাছাই করে হিন্দু বাড়ীগুলিতে প্রানঘাতী হামলায় অগুন্তি পুরুষ প্রাণ হারালেন। মহিলাদের ধর্ষন করে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হলো আর অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো । পথঘাট “ নারায়ে তকবীর – আল্লা-হু -আকবর”…রবে বিদীর্ন হতে লাগলো ।
এভাবেই গৃহহীন হলেন হাজার হাজার হিন্দু। ধর্ষিতা এবং অপহৃতা মহিলাদের কোনো হিসেব ছিল না। কলকাতার রাস্তায় এখানে সেখানে জমে উঠেছিল লাশের পাহাড়। দাঙ্গায় নিহতদের এক জায়গায় জড়ো করে তার ওপর আক্ষরিক অর্থেই কাঠখড় ঢেলে গনচিতা প্রস্তুত করা হয়েছিল দাহ করার জন্য৷ এমনি শত শত ছবি প্রকাশ পেয়েছিল সংবাদে। নীচে লেখা হলো : মেন অ্যাড উড এন্ড স্ট্র টু ফিউনারেল প্রেয়ার্স ইন প্রিপারেশন ফর ক্রিমেশন অব করপসের আফটার ব্লাডি রায়টস৷

বৃটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি আর কেবলই দুটি বিবাদমান প্রতিহিংসাপরায়ণ ধর্ম নয় বরং দ্বিজাতিতত্ত্বই ভারতীয় মুসলিমদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে শনাক্ত করে তাদের জন্য ভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রর দাবিই মানুষ মারার , ধর্ষণ করার, আগুন লাগানোর সেই পৈশাচিকতার কারন ছিল ।
সেই সময়ে মধ্য কলকাতায় গোপাল মুখোপাধ্যায় তখন হিন্দুদের ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন৷ তাঁর একটি মাংসের দোকান ছিল৷ তিনি তাঁর সীমিত ক্ষমতায় আক্রান্ত মানুষদের বাঁচাতে প্রতিরোধ গড়বার চেষ্টা করেছিলেন। রাত জেগে রাতজেগে অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকতেন পাড়ার লোকেরা৷ 

দাঙ্গার পরেই ব্রিটিশের পরিকল্পনায় দেশভাগের প্রস্তাবে মুসলিম লিগ এবং জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা কাল বিলম্ব না করেই সম্মতি জানালেন। দেশভাগই যে ‘একমাত্র’ পথ তা সব পক্ষই মেনে নিলেন।

১৯৪৬ সালে কলকাতায় এবং নোয়াখালী দাঙ্গার ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে -এর পর, এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে উল্লেখযোগ্য ভরবেগ অর্জন এবং ২০ জুন ১৯৪৭ সালে সমগ্র বাংলাপ্রদেশ পাকিস্থানে অন্তর্ভূক্তির বিপক্ষে রায় দেয় আইনপ্রনেতারা। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা পাকিস্থানের অন্তর্ভূক্তি থেকে বিরত হয় প্রশাসন। হিন্দু মহাসভা প্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন
আর বঙ্গভঙ্গের মধ্যমে হিন্দু বাঙালিরা পায় বাংলার পশ্চিম অংশ আজকের পশ্চিমবঙ্গ।

শুধু রক্তের দাগ, গনধর্ষন, গনহত্যা লীলা, গনচিতায় শবদাহের কটু গন্ধ , “…নারায়ে তকবীর – আল্লা -হু -আকবর” এর রণহুংকার আর আক্রান্ত কলকাতার হিন্দুদের গগনভেদী আর্তনাদের সঙ্গে সাবেক বাঙ্গালীর মনের গভীরে ব্যথাতুর স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আজও বেঁচে আছে

সৌমিত্র সেন (Soumitra Sen)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.